শিল্পী সংসদের অনুষ্ঠানে তারকার মেলা।
শেষ আপডেট: 26th July 2024 17:44
২৪ শে জুলাই দিনটা চুয়াল্লিশ বছর পার করে আর বাঙালির কালো দিন নেই। উত্তমকুমারের জন্মদিনের মতোই তাঁর মৃত্যুদিনও বাঙালির কাছে স্মরণ উৎসব। মহানায়কের মৃত্যু হয়? হতে পারে? তাঁদের কালজয়ী কাজেই তাঁরা জীবন্ত। মহানায়কের প্রয়াণ দিবসে আমরা তাঁর নানা গানে কথায় জীবন্ত উত্তমকুমারকে যেন ফিরে পাই।
১৯৬২ সালে দুঃস্থ শিল্পীদের পাশে দাঁড়াতে মহানায়ক তৈরি করেন 'শিল্পী সংসদ'। মহানায়কের আদর্শে আজও শিল্পী সংসদের অস্তিত্ব বজায় রেখে চলেছেন সম্পাদক সাধন বাগচী। তাঁর কথায়, "যতদিন চলচ্চিত্র বেঁচে থাকবে, ততদিন উত্তমকুমার বেঁচে থাকবেন । মানুষের মনে তিনি চিরকাল আছেন,থাকবেন। আজকাল তারকারা সংবাদমাধ্যমকে ডেকে নিয়ে গিয়ে দানধ্যান করেন। মহানায়ক দান করতেন লুকিয়ে। কারও অসুবিধা হলে খামে করে টাকা দিয়ে বলতেন, বাড়িতে গিয়ে খাম খুলবে। আর যদি কাউকে বলো, তাহলে তোমার কাজ এখানে বন্ধ হয়ে যাবে৷ তুলসী চক্রবর্তীর স্ত্রী থেকে শুরু করে ঋত্বিক ঘটক... কে না পেয়েছেন শিল্পী সংসদের সাহায্য!"
শিল্পী সংসদের লেনিন সরণীর ভগ্ন বাড়িটি আজ ধুঁকছে। তবু তাঁরা উত্তমকুমারের জন্মদিন ও মৃত্যুদিনে রবীন্দ্রসদনে অনুষ্ঠান সাড়ম্বরে করে থাকেন। ২৪ শে জুলাই ২০২৪ সকালে টালিগঞ্জ মোড়ে উত্তমকুমারের মূর্তিতে মাল্যদান করে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। দুপুরে ছিল নন্দন ১ এ 'সাড়ে চুয়াত্তর' ছবির প্রদর্শন ও গুণীজন সংবর্ধনা।
২৪ জুলাই সন্ধ্যেয় রবীন্দ্রসদনে শিল্পী সংসদের অনুষ্ঠান ছিল তারকাখচিত। ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর নেতৃত্বে এসেছিলেন সব শিল্পীরা। নবীন থেকে প্রবীণ শিল্পীদের সমাহার। যদিও ঋতুপর্ণা নিজে সিঙ্গাপুরে থাকায় তাঁর প্রতিনিধিত্ব করে সবটা সামলালেন পরিচালিকা রেশমি মিত্র। অনুষ্ঠানের শুরুতেই ব্যাকস্টেজ আলো করে বসেছিলেন 'ছদ্মবেশী', 'শঙ্খবেলা' ছবির নায়িকা, উত্তমের 'বিরাজ বৌ' মাধবী মুখোপাধ্যায়। তাঁর পাশে ভগ্নীসমা রত্না ঘোষাল। রত্না বললেন "আট বছর বয়সে উত্তমকুমারের সঙ্গে অভিনয় করেছি। তখন কার সঙ্গে কাজ করেছি বুঝিনি। 'এখানে পিঞ্জর' ছবিতে অপর্ণা সেনের ছোট বোন হয়েছিলাম আমি। তারপর তো 'মৌচাক' এর চাঁপাকে দর্শক আজও মনে রেখেছেন"।
এদিন মাধবী মুখোপাধ্যায় মঞ্চে এসে যেভাবে মুক্ত কন্ঠে আবৃত্তি করলেন 'থাকব না ভাই, থাকব না কেউ, থাকবে না ভাই কিছু' তা এতই অসাধারণ যে কে বলবে মাধবী আশি পেরিয়েছেন! তিনি প্রাণশক্তিতে অষ্টাদশী। কী তেজ অশীতিপর অভিনেত্রীর কন্ঠে। এ দিন বেশ কয়েকজনকে 'জীবনকৃতি' সম্মানে ভূষিত করে বাংলা চলচ্চিত্র প্রচার ও প্রসার সমিতি। তাঁদের মধ্যে ছিলেন রত্না ঘোষাল, সঙ্গীত পরিচালক ও গিটারিস্ট বুদ্ধদেব গাঙ্গুলি, গিটারিস্ট স্বপন সেন, প্রিয় চট্টোপাধ্যায়-গৌতম সুস্মিত প্রমুখ। অনুষ্ঠানে 'মৌচাক', 'অগ্নীশ্বর', 'ধন্যি মেয়ে'-খ্যাত কিংবদন্তী পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের পরিবার উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানের শুরুর সুরটি 'শঙ্খবেলা' র 'আজি ঝরঝর মুখর বাদর দিনে' রবিগানে ধরলেন প্রবীণ গায়ক ডাঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। দাগ কাটল যাঁদের গান, তাঁদের মধ্যে ছিলেন মনোময় ভট্টাচার্য, সৈকত মিত্র, রাজ্যশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়, রূপরেখা চট্টোপাধ্যায়, ঋক, নূপুরছন্দা ঘোষ, শমীক পাল। সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের নিবেদন ছিল যথেষ্ট মার্জিত ও স্নিগ্ধ। উল্লেখ করলেন তাঁর মা স্বর্গীয়া সুচেতা চট্টোপাধ্যায়ের কথা, যিনি উত্তমকুমারের বড় ভাগ্নীর চরিত্র করেন 'জয়জয়ন্তী'-তে। 'বনপলাশীর পদাবলী' ছবির শুরু সুচেতা দেবীকে দিয়েই। পেশাদার গায়ক না হয়েও 'আরো দূরে চলো যাই' গেয়ে দর্শকদের নস্ট্যালজিক করে দিলেন সুজয়প্রসাদ। পেলেন ভালবাসাও।
শেষ দিকে মঞ্চে এলেন স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত। তিনি রবীন্দ্রনাথের গানে নয় ,লতা মঙ্গেশকরের 'মন নিয়ে' ছবির গান 'চলে যেতে যেতে দিন বলে যায়' গাইলেন। নিমগ্ন উপস্থাপনে দর্শক নতুন করে পেলেন স্বাগতালক্ষ্মীকে।
অম্বরীশ ভট্টাচার্য এ যুগের ব্যস্ত শিল্পী তবু তিনি ঝাঁকিদর্শনে এলেন। কর্তব্যে ত্রুটি নেই তাঁর। বাসবদত্তা বেশ সুন্দর বক্তব্য রাখলেন। তাঁর বাবা ছিলেন এক সময়ের চলচ্চিত্র সাংবাদিক। বাবার কাছ থেকেই উত্তমকুমারকে চেনা শুরু বাসবদত্তার। ইন্দ্রাণী দত্তকেও সম্মানিত করা হল। পায়েল সরকার অনেকদিন পর স্নিগ্ধ সাবেকি সাজে ধরা দিলেন। উত্তম কলারত্ন পুরস্কারে সম্মানিত করা হল মনামী ঘোষকেও।
সঙ্গীত পরিচালক কল্যাণ সেন বরাট একটা দারুণ মজার কথা বললেন। তিনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ভক্ত। কিন্তু তাঁর বাবা, মা, স্ত্রী, মেয়ে তিন প্রজন্মের পছন্দ উত্তমকুমার। তাই তাঁকেও গৃহশান্তির স্বার্থে উত্তম-ভক্ত হতে হয়েছে। তিন প্রজন্মের চোখে মহানায়ক উত্তমকুমার। এটাই উত্তম ম্যাজিক।
উপস্থিত ছিলেন উত্তমকুমারের নাতবৌ দেবলীনা ও তাঁর বাবা দেবাশিস কুমার। সতীনাথ মুখোপাধ্যায় ও মধুমিতা বসুর অনবদ্য সঞ্চালনা সমগ্র অনুষ্ঠানের সুর ধরে রেখেছিল।
বিকেল পাঁচটা থেকে রাত নটা পেরিয়ে একটি মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান উপহার দিল শিল্পী সংসদ ও তাঁর সভ্যবৃন্দ। অনুষ্ঠানে তারকার সমাহার থাকলেও ভীষণ আন্তরিক পারিবারিক অনুভূতি ছিল। শিল্পী সংসদ উত্তমকুমার চলচ্চিত্র উৎসবও করছে। ২৪শে জুলাই থেকে ৭ই অগস্ট রোজ দুটি করে উত্তমকুমারের ছবি নন্দন ২ ও ৩ এ দেখানো হচ্ছে। দেখা-অদেখা ছবির স্বাদ নিতে সেখানেও দর্শকের ভিড়। এই উত্তম উৎসবে নন্দনে ঢুঁ মেরে আসুন।