শেষ আপডেট: 23rd June 2023 11:03
'শিবপুর 'জার্নি অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ের (Swastika Mukherjee) কাছে মনে রাখার মতো। একজন আটপৌরে গৃহবধূ থেকে গ্যাংস্টার মন্দিরা বিশ্বাস হয়ে ওঠার জার্নি পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন স্বস্তিকা। শুধু কী তাই? শাড়ি পরে দুর্ধর্ষ অ্যাকশন দৃশ্যে তাঁকে অভিনয় করতে হয়েছে। স্বস্তিকা মানেই ছকভাঙা কাজ,বিতর্ক আর বিস্ময়।'শিবপুর' রিলিজের আগে দ্য ওয়ালের সামনে অকপট স্বস্তিকা। কথা বলেছেন চৈতালি দত্ত।
বাংলা ছবিতে প্রথম মহিলা গ্যাংস্টার, পরিচালক অরিন্দম ভট্টাচার্যের কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়ে আপনার প্রথম প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?
এই ধরনের বাংলা ছবি ইতিপূর্বে হয়নি। সে কারণে কোনও অভিনেত্রীর এই ধরনের চরিত্রে অভিনয় করার কোনও পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তাই প্রথম যখন পরিচালকের কাছ থেকে আমার এই চরিত্রের অফার আসে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া বলতে গেলে 'উত্তেজিত জনতা (হেসে) '। আমার তখন মনে হয়েছিল এই ছবিটা আমাকে করতেই হবে। কোনভাবেই হাতছাড়া করা যাবে না। কারণ একজন গ্যাংস্টার মহিলা মুখ্য চরিত্রে অর্থাৎ আমিই হিরো। এই ধরনের ছবিই বাংলায় হয়নি।
ছবির ট্রেলার সামনে আসতেই মানুষের প্রশংসার বন্যা বইছে, আপনাকে তো দুর্দান্ত দেখতে লাগছে-
(মিষ্টি হেসে) ধন্যবাদ। সকলের মতো আমিও খুবই আশাবাদী যে এই ছবি মানুষের ভাল লাগবে। ডাবিং করতে গিয়ে আমি ছবিটা দেখেছি। পরিচালক অরিন্দ দা খুবই ভাল একটা ছবি তৈরি করেছেন। দর্শক হিসাবে বলব যে, এই ধরনের বিষয় নিয়ে আগে কোনদিনই ছবি বাংলায় তৈরি হয়নি।
সপ্তমদিনে ভাঁড়ারে ঢুকল মোটে ৫ কোটি, ক্রমশ ডুবছে ‘আদিপুরুষ’!
আজকাল যেসব ছবি আমরা বেশি দেখি তা বেশিরভাগই গোয়েন্দা নির্ভর অথবা পারিবারিক ছবি। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে অন্য ঘরানার ছবি নিশ্চয়ই দর্শকদের ভাল লাগবে। পুরো ছবিতেই আমার একমাত্র অস্ত্র অভিনয়। কারণ ছবিতে আর কোনও আরম্বর নেই। শাড়ি জামা কাপড়ের কোনও বাহার নেই। কোনও মেকআপ নেই ,নেই কোনও চুলের সাজ। পুরো ছবিটাই প্রায় আমি সাদা শাড়ি পরে করেছি। এ জন্য অভিনয়ের জায়গাটা বিশাল। আমি সব সময়েই অভিনয়ে ফোকাস করতে চাই, যাতে মানুষ আমার অভিনয় মনে রাখেন। এইটুকু বলতে পারি দর্শক আগে আমাকে এইভাবে কখনও দেখেন নি। তাই মনে রাখার মতো কিছু হবে বলে আমার বিশ্বাস।
ছবিতে মন্দিরা বিশ্বাস কোমরে বন্দুক নিয়ে চলে, এমন চরিত্র করতে কোনও প্রস্তুতি নিয়েছিলেন?
বন্দুক চালানোর প্রস্তুতি একটু শিখতে হয়েছিল । বাকি এই চরিত্রের একটা জার্নি আছে। ছবির শুরু থেকে মন্দিরা বিশ্বাস এমনটা ছিলেন না। সে নিম্ন মধ্যবিত্ত বাড়ির একজন গৃহকর্ত্রী। শ্বশুর, শাশুড়ি, দেওর ,স্বামী, সন্তান নিয়ে তার সাদামাটা সংসার। সারাদিনে বেশিরভাগই তাঁর হেঁশেলে কাটে। সেখান থেকেই একদিন ঘটে যায় মর্মান্তিক ঘটনা।
স্বামীকে তাঁর চোখের সামনে গুলি করে মেরে ফেলা হয় । সেখান থেকে তাঁর সাহায্য চাওয়া, সাহায্য না পাওয়া,সঠিক বিচার না পাওয়া। সেই রাগ ,দুঃখ, ক্ষোভ, যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে গিয়ে তাঁর গ্যাংস্টার মন্দিরা বিশ্বাস হয়ে ওঠা। যাঁকে আমরা কোমরে বন্দুক নিয়ে ঘুরতে দেখতে পাই। এটা একটা আবেগপূর্ণ জার্নি। রানিরা যখন যোদ্ধা হয়ে ওঠেন ঠিক তার মতো। একজন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মহিলা যে বাইরের জগৎ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। বাইরে জগৎ বলতে ছিল বাজার করতে যাওয়া। তারপরে এরকম একটা পুরুষ শাসিত সমাজে পুরুষের সঙ্গে লড়াই করে জেতা, সেটার জন্য মনের জোর লাগে।
আর অভিনয় করতে গিয়েও কিন্তু মনের জোরের প্রয়োজন পড়ে। ফলে আমি খুবই উপভোগ করেছি। প্রতিশোধ নিতে আমাদের সকলের ভাল লাগে। আমাদের যারা ক্ষতি করে বা খারাপ করার চেষ্টা করে আমরা মনে মনে চাই সেই খারাপটা যেন তার সঙ্গেও ঘটে। আমরা যে সমাজে বাস করি হয়তো সেগুলো নিয়ে সবসময় কথা বলতে পারি না বা সেই একই রকম ক্ষতি আমরা করে উঠতে পারি না । কিন্তু মনে মনে তো আমরা চাই ওই মানুষটা আমার এত ক্ষতি করল তার যেন কোনও সময় ক্ষতি হয়। নিজের জীবনে হয়তো সেই ক্ষতিগুলো আমি সব সময় দেখে উঠতে পারি না। সেজন্য সেটা আমি মন্দিরা বিশ্বাসের হাত ধরে দেখে নিয়েছি।
পরিচালক একটা পোস্ট করে লিখেছিলেন আপনার একটা শট ১৪ বার টেক করতে হয়েছিল?
হ্যাঁ আমিও পোস্টটা দেখেছি। ছবি তৈরি করা একটা টিম ওয়ার্ক। সেখানে একা পরিচালক বা অভিনেতা বা একা কারোর অবদান থাকে না।
ছবির একটা দৃশ্য ঠিকমতো প্রকাশ করতে গেলে সেখানে প্রচুর টেকনিশিয়ানরা জড়িত থাকেন ,একটা সম্মিলিত প্রচেষ্টা। একটা দৃশ্যে যেটা প্রয়োজন সেটা যতক্ষণ না পাওয়া যাবে ততবারই মনে হয় আরেকবার টেক করি। অন্যান্য কলাকুশলীদের 'ডেট'এর অসুবিধের জন্য এটা খুবই দুর্ভাগ্য যে প্রথম দিনই ছবির শেষের দিকের দৃশ্য আমাকে প্রথম দিন শ্যুটিং করতে হয়েছিল।
ছবির অন্যান্য দৃশ্য যদি একটু আগে বা প্রথম হয় সেই গ্রাফটা মাথায় থাকে। আমি প্রথম দিনই যখন শ্যুটিং করেছি মন্দিরে বিশ্বাস একদম সর্বশ্রেষ্ঠ আসনে বসে আছে অর্থাৎ ত্রিভুজের মাথায়। ফলে মানসিক দিক দিকে আমাকে অনেক বেশি প্রস্তুতি নিতে হয়েছিল। সেটা যথার্থ না হয়ে ওঠার জন্য ১৪ বারের জায়গায় ২৪ বার হতে পারত(হেসে)। আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করেছিলাম যাতে দৃশ্যটা সঠিক হয়। প্রথম দিনই একটা গোলাগুলির দৃশ্য ছিল। ফলে প্রথম দিন চরিত্রে ঢুকতে একটু সময় লাগে। আশা করি সেটা ঠিকঠাক করতে পেরেছি।
অনেক অ্যাকশন এবং ভায়োলেন্স দৃশ্যে অভিনয় করতে কেমন লাগল?
এটা আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। যখন আমি হার্ডকোর কমার্শিয়াল ছবি করেছি সেখানে তো সব মারপিট তো হিরোরা করেন। আর কমার্শিয়াল ছবিতে নায়িকারা ভয় সিঁটিয়ে একদিকে দাঁড়িয়ে থাকেন। এই জায়গার থেকে বেরিয়ে এসে আজকে আমি এই ছবির হিরো, যিনি বন্দুক চালাচ্ছেন।
সবচেয়ে বড় ব্যাপার যে প্রতিটি মারপিটের দৃশ্যে আমি শাড়ি পরে আছি। সাধারণত মহিলারা যখন অ্যাকশন দৃশ্যে অভিনয় করেন, সুবিধার জন্য তখন তাঁরা প্যান্ট পরেন। আমার চরিত্রের যে ব্যাপ্তি সেখানে শাড়ি পরে সবকিছু আমাকে করতে হয়েছে। সেটা বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। সেই সময় এত গরম ছিল তার মধ্যে অন্ধকার সিঁড়িতে প্রচুর অ্যাকশন দৃশ্যে শ্যুটিং করতে হয়েছে। যাতে সবটুকু মসৃণ ভাবে হয় এটা আমার জন্য ছিল খুবই চ্যালেঞ্জিং। ট্রেলার দেখে আমারও মনে হয়েছে যাক উতরে গেছি (হেসে) । শাড়ি পরে মারপিট কম অভিনেত্রীরা করেছেন। সেক্ষেত্রে হয়তো আমি উদাহরণ হয়ে থাকব।
এই ধরনের চরিত্রগুলো থেকে যখন আপনি বেরিয়ে আসেন তখন কেমন লাগে?
চরিত্রগুলো থেকে বেরোতে একটু তো সময় লাগে। কারণ এতটাই আবেগের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলি হয়তো সে কারণে ২৩ বছর ধরে ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে থাকতে পেরেছি। আমার সব সময় লক্ষ্য থাকে কেউ যেন আমাকে না বলেন যে তোমার আগের ছবিটা দেখেছি সেটা বেশি ভাল ছিল। সবসময় যেন শুনতে পাই এটাই তোমার বেস্ট।
ভগবানের কৃপায় আজ পর্যন্ত সেটাই হয়ে এসেছে। আমি আমার নিজের প্রতিযোগী। সব সময় আমার মাথায় রাখতে হয় যে কাজটা করছি তার থেকেও যেন আমার পরের কাজটা আরও বেশি ভাল হয়। ১৫ - ২০ দিন ধরে সকাল থেকে রাত অব্দি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮ ঘণ্টা যে চরিত্রের মধ্যেই আছি , ওই চরিত্র হিসেবেই নিশ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছি, ওটাতেই যাপন করছি সেখান থেকে বেরোতে তো সময় লাগে। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম অসুবিধা হত।
শিবপুর ছবি নিয়ে অনেক জটিলতা, এত নেগেটিভ পাবলিসিটি ছবিতে প্রভাব ফেলবে কি?
ট্রেলার দেখে মানুষ সিদ্ধান্ত নেন ছবি দেখবেন কি দেখবেন না। আমি নিজেও দর্শক হিসাবে সেটা করি। মানুষের ছবি দেখা না দেখা সম্পূর্ণ নির্ভর করে ছবির মেরিটের ওপর। এই ছবির মেরিট নিয়ে আমার মধ্যে কোনও দ্বিধা নেই। আমার সঙ্গে যখন ঘটনাগুলো ঘটেছে, একমাস ধরে প্রচুর ইমেইল প্রতিদিন এসেছে, যাতে ছবির সঙ্গে কোনও নেগেটিভিটি যুক্ত না হয় সেজন্য আমি একমাস ধরে কোনও কথা বলিনি।
আমার মনে হয়েছিল নিশ্চয়ই তাঁদের বোধ বুদ্ধি দিয়ে এই কাজটা বন্ধ করবেন। কিন্তু যখন দেখলাম জল মাথার উপর দিয়ে চলে গেছে তখন তো আর চুপ করে বসে থাকা যায় না। কিন্তু আমি কখনোই সেটাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইব না। সেজন্য আমি আজ সাক্ষাৎকার দিচ্ছি। যাতে মানুষ ছবি সম্পর্কে অনেক কিছু আরও জানতে পারেন।
পরিচালক অরিন্দমদাকে ট্রেলার লঞ্চে নিমন্ত্রণ জানানো হয়নি সেটা খুবই অন্যায়। আমি যে চিত্রনাট্য পড়েছি এবং যে ছবিতে কাজ করেছি সেখানে গান ছিল না। একটা গ্যাংস্টার ছবিতে গান না থাকাটা স্বাভাবিক। অরিন্দমদা জানেনও না ছবিতে এতগুলো গান আছে । এই যে ব্যাপারগুলো হয়েছে সেটা কোনভাবেই ঠিক নয়। গানগুলো ভালো কী মন্দ হয়েছে সেটা আলাদা বিষয়। ছবিতে পরিচালক গানের কোনও পরিস্থিতি তৈরি করেননি। ছবি ৩০ জুন মুক্তি পাবে।
পরিচালক অরিন্দম ভট্টাচার্যের ছবি দেখব নাকি প্রযোজকদের তৈরি করা ছবি দেখব সেটা আমি জানি না। আমার কাছে বড় কৌতুহলের জায়গা হল ছবিটা হলে না গিয়ে দেখলে বুঝতে পারব না এটা অরিন্দম ভট্টাচার্যের তৈরি করা' শিবপুর' নাকি প্রযোজকদের তৈরি করা 'শিবপুর।' আমরা প্রযোজক বলে আমাদের কাছে সমস্ত পাওয়ার সেই প্রমাণ করার তাগিদে যদি তাঁরা ছবির মূল বিষয় নষ্ট করে ফেলেন সেটা কারোরই কিছু করার নেই। তবে ছবিতে যে গান রয়েছে সেটা নিশ্চয়ই আমি শেয়ার করেছি। শুনতে খুবই ভাল লাগবে। কিন্তু এই ছবিটায় গান থাকারই কথা না যেই ছবিতে আমি কাজ করেছি। যেখানে গানের জায়গা ছিল না।
এই ছবিতে প্রাক্তনের সঙ্গে অভিনয় করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
আমার আর পরমের দৃশ্য খুব কম। আর এক যুগ আগে প্রাক্তন আর প্রাক্তন থাকে না।
আপনি তো প্রায়ই কলকাতা, মুম্বই ছবির কাজের জন্য যাতায়াত করেন, ব্যালেন্স করা কতটা কঠিন?
খুবই কঠিন। দু'জায়গায় দু রকমের কাজ। দুটো সংসার। সংসারে যাবতীয় সুবিধা অসুবিধা থেকে শুরু করে বাড়িতে গ্যাস আছে কিনা, ইলেকট্রিক বিল জমা পড়ল কিনা এমন কী অ্যাকোয়াগার্ড খারাপ হয়েছে কিনা ইত্যাদি সবই এক হাতে সামলাতে হয় । অন্যদিকে কেরিয়ারও সামলাতে হচ্ছে। আরও দশটা হাত দুটো তিনটে মাথা হলে সুবিধা হয় আর কী (হেসে)!