শেষ আপডেট: 1st February 2024 18:05
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'সুবর্ণগোলক'-এর কথা মনে আছে নিশ্চয়ই? কৈলাসে শিব দুগ্গা তর্ক করতে করতে অধরা সুবর্ণ গোলকটা গড়িয়ে দিলেন ধরিত্রীর দিকে। তারপর সুবর্ণ গোলক ধরাধামে এসে তার নানা কেরামতি দেখাতে লাগল। এই সুবর্ণ গোলক ধরলেই অন্য একজনের ব্যক্তিত্ব ঘাড়ে চাপে, আর তখনই শুরু হয় গন্ডগোল।
সেইবার তো কোনও মতে দেবতারা সুবর্ণ গোলক ফিরিয়ে নিয়েছিলেন স্বর্গে। কিন্তু একালে যদি সুবর্ণ গোলক পৃথিবীতে আবার এসে পড়ে, তখন কী ধরনের গোলোযোগ শুরু হবে? এই বিষয় নিয়েই 'শৌভনিক' নাট্যগোষ্ঠীর নাটক 'সুবর্ণ গোলক টু'। নির্দেশনায় শৌভনিকের কর্ণধার চন্দন দাশ। 'সুবর্ণ গোলক টু' শৌভনিকের ৮২তম প্রযোজনা। এটি গত ২৬শে জানুয়ারি মঞ্চস্থ হল দক্ষিণ কলকাতার মুক্ত অঙ্গনে।
কেমন হল শৌভনিকের 'সুবর্ণ গোলক টু'?
'সুবর্ণ গোলক' শুনলেই যেমন মনে পড়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা 'সুবর্ণ গোলক'-এর কথা, তেমন মনে আসে বাংলা ছবি 'সুবর্ণ গোলক'-এর কথাও। ১৯৮১ সালে মানু সেন পরিচালিত দীপঙ্কর দে, মহুয়া রায়চৌধুরী, রবি ঘোষ, দেবশ্রী রায় অভিনীত 'সুবর্ণ গোলক' হিট ছবি। যাঁরা দেখেছেন আজও তাঁদের মনে ছবিটি গাঁথা হয়ে আছে। সেই একই গল্প নিয়ে কি এই নাটক?
না একেবারেই তা নয়। বঙ্কিমচন্দ্রের কাহিনীর মূল নির্যাসটুকু নিয়ে এখনকার সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দেবকুমার ঘোষ রচনা করেছেন 'সুবর্ণ গোলক টু'। নির্দেশনায় চন্দন দাশ। চন্দন তরুণ মজুমদারের 'দাদার কীর্তি' থেকে দূরদর্শনের প্রথম মেগা সিরিয়াল 'জননী' এবং রঙ্গব্যঙ্গ বিষয়ক একাধিক সিরিয়ালের জনপ্রিয় মুখ ছিলেন। তবে এখন চন্দন দাশ বাজার চলতি সিরিয়াল না করে গ্রুপ থিয়েটারে মনোযোগ দিয়েছেন। তাঁর নিজের নাট্যদল 'শৌভনিক'। পুরনো অভিনেতাদের কবেই বা টালিগঞ্জ পাড়া মনে রাখে!
'সুবর্ণ গোলক টু'তে দুর্জয় দারোগার চরিত্রে দুরন্ত অভিনয় করলেন চন্দন। নিখুঁত পুলিশের পোশাক চরিত্রের সঙ্গে মানিয়েছিল বেশ। দুর্জয় দারোগার অ্যাসিস্ট্যান্ট চতুর চৌবের ভূমিকায় মঞ্চ মাতালেন শংকর মিত্র। ততটাই দারুণ অভিনয় করেছেন দারোগার বউ লক্ষ্মীর চরিত্রে নমিতা চক্রবর্তী। এ নাটকের সেরা দমফাটা হাসির দৃশ্য হয়ে থাকল যখন সুবর্ণ গোলক হাতে ধরে 'চতুর ব্যক্তিত্ব' হয়ে যায় দারোগা স্ত্রী লক্ষ্মী, আর লক্ষ্মী হয়ে যায় চতুর। চতুর লক্ষ্মীর টানাটানিতে দুর্জয় দারোগার নাজেহাল অবস্থা হলেও ঐ দৃশ্যে হাসির রোল ওঠে দর্শকাসনে। আসলে সুবর্ণ গোলক হাতে নিয়ে শুধু চিত্ত বিনিময় নয় ঘটে চিত্ত পরিবর্তনও। দুর্জয় দারোগা যেমন ঘুষ নেওয়া ছেড়ে দেয় তেমন রাজনৈতিক নেতানেত্রীরাও তাঁদের স্বার্থরক্ষার তাগিদে দলবদল করার জন্যে অনুতপ্ত হন।
কৌশিক মুখোপাধ্যায়, বলাই কাঞ্জিলাল, শেখ সাফায়েত হোসেন, সৈকত তালুকদার, অনুপ খানদের অভিনয় নজর কেড়েছে। পরস্রীর ভূমিকায় পর্ণা চ্যাটার্জি অনবদ্য। ঠিক ততটাই ভাল লাগল বামাচরণের চরিত্রে রাজ চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়। ফিটফাট ধুতি পাঞ্জাবি পরে লাঠি হাতে ভোগীবাবুও মনে রাখার মতো কাজ করেছেন। কংস চরিত্রে স্বপন রায় যথাযথ। নাটকের শুরু হচ্ছে সূত্রধর বঙ্কিমচন্দ্রের সংলাপে। বঙ্কিমি বাংলায় মন মাতালেন বঙ্কিম রূপে শুভজিৎ চৌধুরী। মহাদেবের চরিত্রে স্বপন চক্রবর্তীর অভিনয় এক যুগ পর দেখার সৌভাগ্য হল। আধুনিক মহাদেব রূপে তিনি অনবদ্য। এযুগের ট্যাব ফোন হাতে বিশ্বকর্মা দেবব্রত মজুমদার বেশ সুন্দর, অভিনয় থেকে লুকে। নন্দী শুভম ও ভৃঙ্গি অনুপ পারফেক্ট। আর ছবির নায়কের চরিত্রে সিদ্ধার্থ বোস জমিয়ে অভিনয় করেছেন।
দমফাটা হাসির নাটকের মাঝেও রয়েছে নিখাদ প্রেমের সুর। নায়িকা পরীর চরিত্রে স্নিগ্ধ রঞ্জিনী চট্টোপাধ্যায়ের সিরিয়াস অভিনয় মনে দাগ কাটে। চোর বঙ্কা সুবর্ণ গোলক ছুঁতেই তার শরীরে বঙ্কিমচন্দ্রের আত্মা ঢুকে যায়। বঙ্কা বঙ্কিমি ভাষায় কথা বলতে শুরু করে। বঙ্কার ভূমিকায় কোরক চৌধুরির অভিনয় অনবদ্য।সকলের অভিনয়ের গুণে কমেডি নাটকটি সিরিও কমেডি হয়ে উঠেছে।
নাটকের শেষ দৃশ্যটি মন ছুঁয়ে যায়। সুবর্ণ গোলক টু শুধু হাসির নাটক নয় , হাসির সংলাপ দিয়েই প্রতিবাদের ঝড় তুলেছেন নাট্যকার।বর্তমান সামাজিক রাজনৈতিক অবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। সুবর্ণ গোলক আদতেই যেন আমাদের মনের মোহ। সেই মোহকে জয় করতে পারলেই প্রকৃত ঈশ্বরের কাছে পৌঁছনো যায়। সমাজে ভাল মানুষ খারাপ মানুষ থাকবেই। খারাপ না থাকলে ভালকে আমরা চিনব কীভাবে?
'সুবর্ণ গোলক টু' নাটকের গানের সুর দিয়েছেন অরিন্দম রায়। গানও গেয়েছেন তিনি। সুর মন ছুঁয়ে যায়। আবহভাবনায় চমৎকার চন্দন দাশ। শম্ভু বারিকের রূপসজ্জা ছাড়া এমন হাসির নাটক জমত না। কোরক ভট্টাচার্যের মঞ্চসজ্জা নাটকের প্রাণ। আলো ও শব্দ বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য যাতে বাবলু সরকার,,অনির্বাণ দত্ত ও সৌমেন দত্তর প্রশংসা প্রাপ্য। নাটকের প্রতিটি দিকই এত যত্ন নিয়ে করা, বহু বাধাবিপদ অতিক্রম করে যে লড়াই শৌভনিক দলের ,তাতে 'সুবর্ণ গোলক টু' তাঁদের প্রাণঢালা ফসল।
নাটকের খারাপ কী কিছু নেই? না নেই। খারাপ হল দর্শক যাঁরা এত ভাল একটি নাটক দেখতে যাচ্ছেন না। এর আগে গিরিশ মঞ্চ, উত্তম মঞ্চ, মধুসূদন মঞ্চে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছে। মুক্ত অঙ্গনে আগামী ১১ই ফ্রেব্রুয়ারি ২০২৪ ঠিক সন্ধে সাড়ে ছ'টায় আবার 'সুবর্ণ গোলক টু' আবার ধরাধামে নামবে। তারপর কী কী ঘটনা ঘটে তা দেখার সুযোগ একদম হাতছাড়া করবেন না।