শেষ আপডেট: 21 December 2023 07:29
শীতের সকালে ঘুম ঘুম চোখে ঢুলতে ঢুলতে এক বছর সাতেকের বাচ্চা মা-বাবার হাত ধরে হাজির হয়েছিল মাল্টিপ্লেক্সে। পাশের সিটে আবার বসে ষাটোর্ধ্ব এক দম্পতি। ডিসেম্বরের ভোরের কনকনে ঠান্ডাকে পাত্তা না দিয়েই তাঁরা সিনেমা দেখতে এসেছেন। বছর সাতেকের বাচ্চাটা সিনেমা শুরুর আগে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে শুধু। একজন এসে তাঁকে প্রশ্ন করলেন, ‘এত সকালে কী করছ? কী সিনেমা দেখবে?’ ঘুম জড়ানো গলায় বাচ্চাটির উত্তর, “ডানকি দেখতে এসেছি...”
ভারত-পাকিস্তান-আফগানিস্তান-ইরান হয়ে গন্তব্য ইংল্যান্ড! জল-জঙ্গল-মরুভূমি পেরিয়ে সে লম্বা এক রাস্তা, তবে বেআইনি। আইনের পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘ডানকি রুট’। সেই রুট ধরেই তিন বন্ধু কীভাবে ভারত থেকে লন্ডন পৌঁছবে, তাই নিয়ে রাজকুমার হিরানির নতুন ছবি। হাসি, মজা, আবেগ মিশিয়ে কীভাবে এক কঠিন বাস্তবতাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা কাহিনি নিয়ে ২ ঘণ্টা ৪১ মিনিটের টানটান চিত্রনাট্য নির্মাণ করা যায়, সেটাই দেখালেন পরিচালক হিরানি। আর সেই ছবি দেখতেই বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সিনেমাহলমুখী শাহরুখ-ভক্তরা।
জানুয়ারি মাসে ‘পাঠান’ ছবি দিয়ে শাহরুখ যে উন্মাদনা নতুন করে শুরু করেছিলেন, তা আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল সেপ্টেম্বরে মুক্তি পাওয়া ‘জওয়ান’। সবশেষে ডিসেম্বরে এল ‘ডানকি’। শাহরুখ খান কি পারবেন সুপারহিটের হ্যাটট্রিক করতে, নাকি ধাক্কা খাবেন? আবার কি তাঁকে শুনতে হবে, বড় বড় পরিচালকদের ছবি তিনি বরবাদ করে দেন? পৌনে ৩ ঘণ্টার ছবিটি দেখার পর অনায়াসেই বলা যায়, যতই এরপর ‘সালার’-এর মতো ছবি আসুক না কেন, ‘হ্যাটট্রিক’ করেই ফেললেন ‘বাদশা’।
এর পাশাপাশি এই কথাটাও বলা উচিত, ছবিটি যতটা না শাহরুখ খানের, তার থেকেও অনেক অনেক বেশি রাজকুমার হিরানির। সমাজের কিছু রূঢ় বাস্তব ঘটনাকে কেন্দ্র নিয়ে গল্প সাজিয়েছেন তিনি। নিজের প্রথম ছবি ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’ থেকেই সামাজিক বার্তাবাহী ছবি করে দর্শকদের তাক লাগিয়েছেন। এবারও সেই মন্ত্রেই বাজিমাত করতে চেয়েছিলেন বলিউড, তথা দেশের অন্যতম সেরা পরিচালক। বলাই বাহুল্য, তিনি নিজের কাজে সফল। এবার দর্শকদের সেই কাজ চাক্ষুষ করার পালা।
গল্পের শুরু লন্ডনে। বর্তমান সময়ে হাসপাতালে বেডে শুয়ে আছেন ছবির হিরোইন মানু (তাপসী পান্নু)। হাসপাতাল থেকে পালিয়ে এসে মানু দেখা করেন তাঁর দুই বন্ধু বুগ্গু (বিক্রম কোচার), বল্লি (অনিল গ্রোভার)-র সঙ্গে। প্ল্যান করেন ভারতে ফেরার। কিন্তু ইংল্যান্ডে ভারতের হাইকমিশন তাঁদের ভিসা দিতে নারাজ। কেন ভারতের ভিসা পাবেন না তাঁরা, সে উত্তর রয়েছে ছবিতেই। কিন্তু তিন বন্ধুকে যে দেশে ফিরতেই হবে। তাই দেশে ফেরার জন্য ফোন যায় হার্ডি (শাহরুখ খান)-র কাছে, তাও ২৫ বছর পর!
এরপর থেকেই পরিচালক গল্পের প্লট নিয়ে গিয়ে ফেলেন ১৯৯৫ সালে। ভারতীয় 'জওয়ান' হার্ডি পাঠানকোট থেকে লাল্টুতে আসেন। আলাপ হয় বুগ্গু, বল্লি, মানুর সঙ্গে। হ্যাঁ আরও এক বন্ধু ছিলেন, সুখী (ভিকি কৌশল)। সকলের মনে একটাই ইচ্ছে, লন্ডন যাবেন, টাকা রোজগার করবেন, ভাগ্য ফেরাবেন। বাঁধ সাধে ইংরেজি ভাষা। চরম পরিণতি হয় এক বন্ধুর। এরপর কীভাবে তাঁরা ডানকি রুট ধরে লন্ডন পৌঁছন, সেই নিয়েই ছবির প্লট সাজিয়েছেন চিত্রনাট্যকাররা ও পরিচালক রাজু হিরানি।
২৫ বছর আগের ও পরের গল্পকে সুন্দরভাবে পর্দায় মেলে ধরেছেন রাজকুমার হিরানি। প্রতিবছর বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ এভাবেই নিজের দেশ থেকে অন্য দেশে পাড়ি দিচ্ছেন ডানকি পথে। যাওয়ার পথে আদৌ বাঁচবেন কিনা, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। কেউ গন্তব্যে পৌঁছতে পারেন, কেউ বা ‘হারিয়ে’ যান চিরকালের মতো। এই বাস্তব সত্যটাকে পর্দায় ফুটিয়ে তোলা সহজ নয়। তবে রাজুর পরিচালনায় তাঁর ছবির অভিনেতারা সেই কাজেই লেটার মার্কস নিয়ে পাশ করে গেলেন।
আসা যাক শাহরুখের কথায়। এই ছবিতে তিনি একেবারেই ‘ডিরেক্টর’স অ্যাক্টর’। ‘পাঠান’ কিংবা ‘জওয়ান’-এর মতো মাস হিরোর ইমেজ সরিয়ে এখানে তিনি পাশের বাড়ির ছেলের ভূমিকায় অসাধারণ। অনেকেই এই ছবিতে শাহরুখকে দেখে পুরনো ছবিগুলির সঙ্গে মিল পেয়েছেন। ছবির প্রধান অভিনেতা তিনি, কিন্তু তাঁকে কেন্দ্র করে গল্প তৈরি হয়নি। বরং বলা চলে, গল্পকে কেন্দ্র করে যে ক’টি চরিত্র পর্দায় ঘুরেছে, হার্ডি (শাহরুখ) তাঁদের একজন। প্রত্যেকটি চরিত্রই কমবেশি সমানভাবে গুরুত্ব পেয়েছে।
৫৯ বছর বয়সে শাহরুখের এনার্জি অবাক করবে সকলকেই। তবে তাপসী পান্নু, বোমান ইরানি-সহ বাকি প্রত্যেকেই নিজের কাজ যথাযথভাবে করেছেন। স্বল্পচরিত্রে ভিকি কৌশল ছবির প্রথমার্ধকে একাই ধরে রেখেছেন। রাজকুমার হিরানির ছবিতে অতিথি শিল্পীরা শুধু মুখ দেখানোর জন্য কোনওদিনই থাকেননি। এবারও ভিকিকে দেখলে সেটা বোঝা যাবে। তিনি যে কত বড় মাপের অভিনেতা, তা বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন ওইটুকু সময়েই। বিশেষ করে, পাঁচ বন্ধু মিলে ছাদে মদ্যপানের একটি দৃশ্যে ভিকি ছাপিয়ে গিয়েছেন বাকিদের।
ছবিতে অ্যাকশন আছে, রোম্যান্স আছে, আর বেশি করে আছে কমেডি। হাসির মোড়কে কীভাবে কঠিন বাস্তব গল্প বলতে হয় সেটা জানেন রাজকুমার হিরানি। সঙ্গে রয়েছে হাতেগোনা কিছু সুন্দর গান। বিগত কয়েক বছরে প্রীতমের অন্যতম সেরা অ্যালবাম বলা যেতেই পারে। তবে এই ছবির আবহ সঙ্গীত তেমন গল্পের আবেগকে ধরতে পারেনি। সঙ্গে সম্পাদনাতেও খানিক কার্পণ্য করেছেন পরিচালক। ছবির দৈর্ঘ্য আরও কিছুক্ষণ কমলে গল্প টানটান হত। সবমিলিয়ে একথা বলাই যায়, ‘ডানকি’ লম্বা রেসের ঘোড়া।