শেষ আপডেট: 23rd April 2024 13:08
১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল প্রয়াত হলেন প্রবাদপ্রতিম চিত্রপরিচলক সত্যজিৎ রায় (Satyajit Ray)। আশির দশক থেকেই তাঁর স্বাস্থ্যর অবনতি শুরু হয়। ১৯৮৩ সালে ‘ঘরে বাইরে’ ছবির কাজ করার সময়ে সত্যজিতের হার্ট অ্যাটাকও হয়। ছেলে সন্দীপ রায়ের সাহায্যে ১৯৮৪ সালে ‘ঘরে বাইরে’ নির্মাণ সমাপ্ত করেন তিনি। তার পরে বাকি কয়েক বছর তাঁর কাজের সংখ্যা ছিল খুবই কম। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘গণশত্রু’, ‘শাখা প্রশাখা’, ‘আগন্তুক’। তিনটি ছবিরই বেশিরভাগ অংশ ইনডোর শুট করেছিলেন সত্যজিৎ। বেশি ঘোরাঘুরি করার সামর্থ ছিল না অসুস্থতার কারণে। শেষমেষ ১৯৯২ সালে হৃদযন্ত্রের জটিলতা নিয়ে অসুস্থ সত্যজিৎ বেলভিউ হাসপাতালে ভর্তি হন এবং সে অবস্থা থেকে তিনি আর ফেরেননি। শ্রদ্ধায়, শোকে শেষ বিদায় নিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের পরশ মানিক।
মৃত্যুর কিছু সপ্তাহ আগেও অত্যন্ত অসুস্থ ও শয্যাশায়ী অবস্থায় তিনি তাঁর জীবনের শেষ পুরস্কার একটি সম্মানসূচক অস্কার গ্রহণ করেন। ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল তাঁর শেষযাত্রার পথে শুধু অশ্রু আর নীরব নমস্কার। সেদিন মানুষের ঢলে হারিয়ে গেলেন ভিআইপি-রা। শোকযাত্রার আবহসঙ্গীতকে ছাপিয়ে গেল বিজয়া রায়ের আকুল কান্না।
কিন্তু সে সময়ে যে নায়িকার সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের (Satyajit Ray) সম্পর্ক ঘিরে চর্চা হয়েছিল দশকের পর দশক, সেই চারুলতার ভূমিকা সেদিন কী ছিল? উত্তম কুমারের প্রয়াণে যেমন সেদিনকার বড় খবর ছিল, সুচিত্রা সেন কী বললেন! ঠিক সেরকমই সত্যজিৎ রায়ের দেহাবসানের দিনও মিডিয়ার পাখির চোখ ছিলেন ‘চারুলতা’ মাধবী মুখোপাধ্যায়।
মাধবী মুখোপাধ্যায় (Madhabi Mukhopadhyay) বলেছিলেন, ওঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ নিঃসন্দেহে ‘চারুলতা’। কিন্তু এই মাধবীই একটা সময়ের পর আর কখনও সত্যজিতের সঙ্গে কাজ করতে চাননি। ‘মহানগর’, ‘চারুলতা’, ‘কাপুরুষ’-- সত্যজিতের এই তিনটি ছবির নায়িকা তিনি। কিন্তু তিনিই পরে সত্যজিতের ছবির অফার পরপর তিন বার ফিরিয়ে দেন। মাধবীর পরিবর্ত হিসেবে সেসব সত্যজিৎ ছবিতে আসেন অন্য অভিনেত্রীরা।
মাধবী-সত্যজিতের এই সংঘাতের কারণ তাঁদের মাঝে বিজয়া রায়ের উপস্থিতি। ষাটের দশকে ‘চারুলতা’ হওয়ার সময় থেকেই সত্যজিৎ-মাধবীর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক সিনেপত্রিকাগুলোর শিরোনাম হয়ে ওঠে। তাতে ঘৃতাহুতি দেয় বিজয়া রায়ের কিছু কার্যকলাপ। মাধবী বলছেন, “তখন আমার বয়স অল্প। শুনলাম, আমি সত্যজিৎ বাবুর ছবিতে নায়িকা হয়েছি বলে বিজয়া রায় মানসিক অস্থিরতার শিকার। ডাক্তার বলেছেন বিজয়া রায়ের পোস্ট-মেনোপজ অস্থিরতা চলছে। তিনি উন্মাদিনী হয়ে যেতে পারেন। তাই আমি আরও সরে এলাম রায়বাড়ি থেকে। কিন্তু পরে আমারও বয়স ষাট পেরিয়েছে আমি তো পাগল পাগল হলাম না।”
১৯৯২-তে সত্যজিৎ মারা যাওয়ার পরে হাওয়ার বেগে ছড়িয়ে গেছিল খবর। সেদিন রাস্তায় জনতার সঙ্গেই হাজার হাজার শিল্পীর ঢল নেমেছিল। সেদিন ঘটল এক বিপত্তি। সেদিনও সমালোচনার হাত থেকে রেহাই পেলেন না মাধবী মুখোপাধ্যায়।
তখন অবশ্য অভিনেতা নির্মল কুমারকে বিয়ে করে তিনি মাধবী চক্রবর্তী। মাধবী সত্যজিৎ রায়কে শেষ দেখা দেখতে হাজির হলেন। তবে সবাই দেখল, বড্ড চড়া মেকআপ তাঁর। শোকের পরিবেশে বেমানান, চোখে পড়ার মতোই। তাতে যদিও কোনও ভ্রূক্ষেপ করেননি, পরোয়া করেননি মাধবী। তবে বিরক্ত হলেন অনেকেই। বাদ গেলেন না বিজয়া রায়ও। তিনি শোকের মাঝেও বিরক্তি প্রকাশ করলেন মাধবীর এই অদ্ভুত সাজের জন্য। প্রেস, মিডিয়া থেকে নিউজ চ্যানেল সবাই ছবি তুলল অতি মেকআপ করা মাধবীর।
মাধবী মুখোপাধ্যায় সেদিন সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, "সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যু অপূরণীয় ক্ষতি। বিনোদন ও সংস্কৃতির অঙ্গনে যা এক নক্ষত্রপতন। তবে সত্যজিৎ রায়ের কাজের সঠিক মূল্যায়ন করেনি দর্শক। বেশিরভাগ দর্শক সত্যজিৎ রায়ের সব ছবি দেখেইনি, যা খুবই পীড়াদায়ক। এমনকি সিনেমাহলেও তাঁর সব ছবি দেখতে দর্শক সেভাবে যায়নি।"
পরের দিন খবরের কাগজের প্রথম পাতায় সত্যজিৎ রায়ের মরদেহের সঙ্গেই বড় খবর হল, মাধবীর চড়া মেকআপের। সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে সত্যজিৎ-ভক্তরা মাধবীকে অসম্মানজনক কথাও বললেন। সত্যজিৎ-মাধবী সম্পর্কের কাটা-ছেঁড়া চলত ষাটের দশকে, কিন্তু নব্বই দশকেও চর্চায় ফিরে এল সেই ঘটনা এবং মাধবীর চড়া মেকআপ।
তখন মাধবী মুখার্জী স্টার থিয়েটারে নাটক করতেন। সত্যজিতের মৃত্যুসংবাদ যখন মাধবীর কাছে এসে পৌঁছয়, তখন মাধবীর নাটকের শো চলছিল। সন্ধে পৌনে ছ'টা নাগাদ সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে বিহ্বল মাধবী মেকআপ না তুলেই বেলভিউ হসপিটালে ছুটে যান। সেখান থেকেই মাধবী চলে যান সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে, বিজয়া রায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। একঘর লোকের মাঝে শোকের বাড়িতে মাধবী উপস্থিত হন চড়া মেকআপে।
বছর কুড়ি পরে ফের এমনই এক দৃশ্যের মুখোমুখি হন বাঙালি দর্শকরা। তবে বাস্তবে নয়, সিনেমার পর্দায়। ২০১০ সালে মুক্তি পায় ঋতুপর্ণ ঘোষের সিনেমা ‘আবহমান’। এ ছবি ঋতুপর্ণ নির্মাণ করেন সত্যজিৎ-মাধবী চর্চিত ঘটনার ছায়ায়। সিনেমাতেও পরিচালক অনিকেতের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে তাঁর বাড়িতে হাজির হয়েছিলেন শিখা ওরফে নামী অভিনেত্রী শ্রীমতী। অনন্যা চট্টোপাধ্যায় অভিনয় করেছিলেন এই চরিত্রে। নাটকের চড়া মেকআপ নিয়ে ছুটে গেছিলেন শোকের বাড়িতে।