শেষ আপডেট: 19th December 2022 11:05
স্টারকিডদের সঙ্গে তুলনা, প্রথম ছবি ফ্লপ, জেদ আর পরিশ্রমেই আজ বড় পর্দার বড় নাম শাশ্বত
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯৭০ সালের ১৯ ডিসেম্বর বাংলা ছবির নায়ক অভিনেতা ও ডাক্তার শুভেন্দু চ্যাটার্জী ও শিক্ষিকা অঞ্জলী চ্যাটার্জীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন অপু (Saswata Chatterjee)। কলকাতাতেই পড়াশোনা, পাশাপাশি কিছু থিয়েটারে অভিনয়। শুভেন্দুর আরও একটি ছেলে আছেন, তিনি বিদেশে থাকেন বর্তমানে।
আজকের শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় কীভাবে হলেন?
যুবক শাশ্বত তখন সদ্য যৌবনে। সেসময় পরিচালক রাজা মিত্র করছিলেন তাঁর ‘নয়নতারা’ ছবি। ১৯৯৭। নামভূমিকায় মমতা শংকর। সঙ্গে সৌমিত্র চ্যাটার্জী, সাবিত্রী চ্যাটার্জী, রবি ঘোষের মতো খ্যাতনামা শিল্পীরা। 'নয়নতারা' এক থিয়েটার মহিলা নাট্যশিল্পীর গল্প, তাঁর লড়াইয়ের গল্পের মননশীল ছবি।
এই ছবিতেই মমতাশংকরের পুত্রের ভূমিকায় ছবির জগতে প্রথম অভিষেক হল শুভেন্দু পুত্র শাশ্বত ওরফে অপুর। নয়নতারা সেসময় অনেক পুরস্কার পায়। নয়নতারার জন্য 'আনন্দলোক' সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কারও পান মমতাশংকর। সেই ছবি অনেকেই দেখেননি, চর্চাই নেই আজ। এই ছবিতে শাশ্বত আছেন এখনকার বব বিশ্বাস, শবরের ফ্যানরা হয়তো জানেনই না।
সন্দীপ রায়ের তোপসে রূপেও ‘বাক্স রহস্য’তে জনপ্রিয় হন শাশ্বত। কলকাতা দূরদর্শনে দেখানো হয় সেই ফেলুদা সিরিজ। সব্যসাচী চক্রবর্তী ফেলুদা, রবি ঘোষ জটায়ু, শাশ্বত তোপসে। বাক্স রহস্য যেহেতু টিভি রিলিজ ছবি, তাই শাশ্বতর বড় পর্দায় রিলিজ ছবি প্রথম হিসেবে 'নয়নতারা'কেই ধরতে হবে।
'শেয়াল দেবতা রহস্য', 'যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে' ফেলুদা সিরিজে দূরদর্শনে একই সঙ্গে অভিনয় করেন শাশ্বত। সমরেশ মজুমদারের 'কালপুরুষ' অবলম্বনে শৈবাল মিত্রর হিন্দি ধারাবাহিকেও অভিনয় করেন। এরপর শাশ্বত করেছেন কিছু সহ-অভিনেতার রোল। এর মধ্যে যেমন বলতেই হয় পরিচালক প্রভাত রায়ের কথা। তাঁর পরিচালিত ‘খেলাঘর’ থেকে ‘তুমি এলে তাই’ ছবিতে ছোট অনেক রোল করেছেন শুভেন্দু-পুত্র। এভাবে অনেক ছবিতে ছোট ছোট রোল। কিন্তু বড় পর্দায় প্রসেনজিৎ আলোকে নিষ্প্রভ হয়ে যাচ্ছিলেন শাশ্বত।
[caption id="attachment_288116" align="aligncenter" width="600"]
এমনই সময় নয়ের দশকের দুপুর মাতাতে এল 'রূপকথা' সিরিয়াল। আজও নীপবীথি ঘোষকে শ্রোতারা মনে রেখেছে 'রূপকথা'র টাইটেল ট্র্যাক দিয়ে। ত্রিকোণ প্রেমের গল্প। শাশ্বত প্রথম নায়ক রূপে বিশাল জনপ্রিয়তা পেলেন বাঙালির অন্দরমহলে, সেই ধারাবাহিক দিয়েই। সঙ্গে ইন্দ্রাণী বসু আর জুন মালিয়া। বাঙালির এক আলসে দুপুরে ঝড় তুলেছিল শাশ্বত চ্যাটার্জী আর জুন মালিয়ার প্রাকবিবাহ ভালবাসার শয্যাদৃশ্য। এক লহমায় ছোটপর্দাকে সাবালক করে দিয়েছিল 'রূপকথা' ধারাবাহিক।
https://youtu.be/hY1O6T4wMYM
শাশ্বতকে আবার বড় ব্রেক দিলেন মেগা সিরিয়ালের আর এক জনক রবি ওঝা। ‘এক আকাশের নীচে ‘। আলফা বাংলায়, এখন যার নাম জি বাংলা, সেই চ্যানেলের বিখ্যাত মেগা সিরিয়াল। বাড়ির সদ্য ডাক্তার হওয়া ছোট ছেলে আকাশের ভূমিকায় শাশ্বত। একান্নবর্তী পরিবারের ছোট ছোট সুখ-দুঃখের গল্প।
[caption id="attachment_288100" align="aligncenter" width="480"]
রবি ওঝা আজ প্রয়াত। শাশ্বতর মা আম্মার চরিত্রে সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়ের শেষ সেরা কাজ ছিল এই মেগা। শাশ্বতর ডক্টর প্রেমিকার ভূমিকায় সুনীতা সেনগুপ্ত। শাশ্বতর স্ত্রী নন্দিনীর ভূমিকায় তিনবার চরিত্র বদল হয়, রুমনি চ্যাটার্জী, অদিতি চ্যাটার্জী ও দেবলীনা দত্ত। এক আকাশের নীচে ও আকাশকে আজও সেসময়ের দর্শকরা মনে রেখেছেন। এক আকাশের নীচে-তে শাশ্বত ও তার বড় ভাইঝি পাখি চরিত্রে নবাগতা অভিনেত্রী কনিনীকা বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ হিট হওয়ায় রবি ওঝা ভেবে ফেলেন, এই দুই মুখকে নায়ক-নায়িকা করে তাঁর প্রথম ফিচার ফিল্ম করার গল্প। শাশ্বত চ্যাটার্জীর প্রথম নায়ক রূপে ছায়াছবি, বড় পর্দায় রবি ওঝার ‘আবার আসব ফিরে‘। নায়িকা কনীনিকা। আরেকটি বিশেষ ভূমিকায় ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়। এইসময় রবি যেহেতু ফিল্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, তাই শাশ্বত বেশ কিছুদিন 'এক আকাশের নীচে' সিরিয়াল পরিচালনাও করেছেন।
২০০৪-এ মুক্তি পায় এ ছবি। স্বাধীনতা ও একটি জাতিস্মর মেয়ের গল্পের পটভূমিকায় ছবি। শাশ্বতকে দেখানো হয় বিপ্লবী ও রোম্যান্টিক নায়ক রূপে দুই জীবনে। কিন্তু ‘আবার আসবো ফিরে’ সুপার ফ্লপ করে। ছবির টাইটেল গান শুভমিতা ও শুভঙ্কর ভাস্বরের কণ্ঠে বেশ জনপ্রিয়তা পায়।
মনে পড়ে সেই গান--
'স্বপ্নের ফুলশয্যায় শুয়ে
আমি জনম-জনম জেগে থাকবো
অপেক্ষার জানলা খুলে দিয়ে ...চিরদিন পথ চেয়ে থাকব।
আমি আসব ... ফিরে আসব... আবার আসব ফিরে।'
ছবিটার অন্যরকম গল্প শাশ্বতকেও তখন বড় পর্দার নায়ক রূপে প্রসেনজিৎ ও জিতের পাশাপাশি নেয়নি দর্শক। অথচ বড় ভাল কাজ করেছিলেন শাশ্বত-কনীনিকা। সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা ছবি ছিল।
[caption id="attachment_288108" align="aligncenter" width="600"]
'আবার আসব ফিরে'র মাঝে মৃণাল সেনের শেষ ছবি ‘আমার ভুবন’-এ নন্দিতা দাশের সঙ্গে নূরের ভূমিকায় অভিনয় করেন শাশ্বত। এরপর 'আবার অরণ্যে', 'দোসর', 'বং কানেকশন'। এরপর অঞ্জন দত্ত ‘চলো লেটস গো’তে নিলেন শাশ্বত'কে। এই শেখর চরিত্রটিতেও বেশ নাম করলেন শাশ্বত। এর পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বলিউডের 'কাহানি'তে ভিলেন বব বিশ্বাস বিদ্যা বালানের সঙ্গে অথবা অরিন্দম শীলের শবর নায়ক রূপে একের পর এক সেরা বক্স অফিস হিট শাশ্বতর। এই বব বিশ্বাসের রোলেই শাশ্বতর পরিবর্ত জুনিয়র বচ্চনকে পরে মেনে নেয়নি দর্শক। এছাড়াও আছে 'নামতে নামতে' ছবিতে পাড়ান মস্তান কিংবা ‘C/O স্যার’-এর অন্ধ অধ্যাপক জয়ব্রত রায়ের ভূমিকায় শাশ্বতর মনে রাখার মতো কাজ।
[caption id="attachment_288110" align="alignnone" width="600"]
রোম্যান্টিক নায়ক রূপে শাশ্বত সফল ছোটো পর্দায়। বড় পর্দায় অন্যধারার শক্ত চরিত্রগুলিতেই মাত করেছেন নায়ক রূপে। পঞ্চাশোর্ধ্ব শাশ্বতকে ফিরে দেখলে বোঝা যায়, স্টারকিড হওয়ার দায়িত্ব আবার মধ্যগগনে থাকা নায়কদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা-- এই দুইয়ের মাঝে নায়ক হয়ে ওঠার লড়াই তাঁর জন্য কত কঠিন ছিল।
এগিয়ে চলুন শবর, জয়ব্রত রে, ধীমান, অজিত ব্যানার্জি, বঙ্কু বাবু। কিংবা 'ভূতের ভবিষ্যৎ' ছবির হাত কাটা কার্তিক। ছোট্ট চরিত্র কিন্তু ঐতিহাসিক।

ভোলা যায় না, ঋত্বিক ঘটকের জীবনী ছবি কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের ‘মেঘে ঢাকা তারা’-তে ঋত্বিক ঘটকের ভূমিকায় শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়কে। একদিন বড়পর্দায় ‘আবার আসব ফিরে’র যে নব্যতরুণকে দর্শকরা নেয়নি, তারাই বলল, ঋত্বিক ঘটক রূপে শাশ্বত সেরা। সারাজীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনয়। যদিও শিল্পীর এখনও অনেক পথ চলা বাকি।
সুশান্ত থেকে রণবীরের সহ-অভিনেতা রূপে বলিউডেও ছাপ ফেলেছেন শাশ্বত, আবার ব্যোমকেশের বন্ধু ক্ষুরধার বুদ্ধির অজিত থেকে হয়ে উঠেছেন গয়নার বাক্সর গোবেচারা শাড়ি ব্যবসায়ী।
'বসু পরিবার' ছবিতেও শাশ্বত সেই প্রতিবাদ কণ্ঠ, যার বিপ্লবে কেঁপে ওঠে রাজপ্রাসাদের ঠুনকো আভিজাত্য।
শাশ্বত শাশ্বত হয়েই থাকুন চলচ্চিত্রে।