শেষ আপডেট: 15th September 2023 14:08
প্রমথেশ বড়ুয়া যখন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (Sarat Chandra Chattopadhyay) কাহিনি নিয়ে পরপর 'দেবদাস' আর 'গৃহদাহ' বানালেন তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমথেশকে ডেকে বলেছিলেন "সবাই তো শরৎ বাবুর লেখা নিয়ে ছবি (Bollywood) বানান, আমার কাহিনিতে তো হাত দিলেন না।" তখন প্রমথেশ বড়ুয়া বলেন "গুরুদেব মার্জনা করবেন যদি অভয় দেন তো বলি, শরৎ বাবুর কাহিনির আলাদা করে চিত্রনাট্য লিখতে হয় না। ওঁনার লেখাটাই ফিল্মের চিত্রনাট্যের মতো তাই ওঁনার কাহিনি নিয়ে এত বেশি ছবি করা হয়।" রবীন্দ্রনাথ মেনে নিয়েছিলেন প্রিন্স বড়ুয়ার সে কথা।
দেবদাস (১৯৩৬)
শরৎচন্দ্রের (Sarat Chandra Chattopadhyay) সবথেকে চর্চিত কাহিনি হল দেবদাস। যা বারবার টলিউড বলিউডে চলচ্চিত্র হয়েছে। প্রথম দেবদাস নির্বাক ছবি হয় ১৯২৮ সালে। পরিচালক নরেশ মিত্র।
এরপর ১৯৩৫ সালে প্রমথেশ বড়ুয়া দেবদাস (Devdas) করলেন। দেবদাস প্রমথেশ বড়ুয়া, পার্বতী যমুনা বড়ুয়া, চন্দ্রমুখী চন্দ্রাবতী দেবী। হিন্দিতেও এই দেবদাসের ডবল ভার্সন ছবি করেন প্রমথেশ। কিন্তু সেখানে পার্বতী বাদে কাস্ট বদলে যায়। দেবদাস কে এল সায়গল, পার্বতী যমুনা বড়ুয়া, চন্দ্রমুখী হন রাজকুমারী বলে একজন। এই প্রসঙ্গে বাংলার চন্দ্রমুখী চন্দ্রাবতী দেবী অনুতাপ করে বলেছিলেন, "আমার চন্দ্রমুখী বাংলায় এত জনপ্রিয় হল এবং আমি ভাল হিন্দি বলতে পারা সত্ত্বেও পি সি বড়ুয়া আমাকে তাঁর হিন্দি দেবদাসের চন্দ্রমুখী করলেন না।" প্রমথেশ বড়ুয়া এখানে তাঁর বাস্তবজীবনের স্ত্রী যমুনা বড়ুয়ার ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করেন। মানে পার্বতীর স্বামীর প্রথম পক্ষের ছেলে। যে পার্বতীর বয়সি। এখানে নায়কের রোল নয় বলে বড়ুয়া সাহেব নিজের নাম ছবির টাইটেল কার্ডে রাজু ব্যবহার করেন।
দেবদাস (১৯৫৫)
২০ বছর পর বিমল রায় হিন্দিতে দেবদাস করলেন। দেবদাস (Devdas) দিলীপ কুমার, পার্বতী সুচিত্রা সেন এবং চন্দ্রমুখী বৈজয়ন্তীমালা। এই দেবদাসে প্রথম পার্বতী আর চন্দ্রমুখী মুখোমুখি হয়েছিল এক লহমায় যা শরৎচন্দ্র লেখেননি। কলকাতাতেও বিপুল আলোড়ন তুলে মুক্তি পেল বিমল রায়ের হিন্দি দেবদাস (Devdas)। এই দেবদাসকে ফ্লপ করাতে নিউ থিয়েটার্স মতলব আঁটল। তাঁরা কলকাতায় রি-রিলিজ করল সেই প্রমথেশ বড়ুয়ার পুরনো দেবদাস। প্রচারে লেখা হল নতুন দেবদাস ফেলে লোকে পুরনো পি সি বড়ুয়ার দেবদাস দেখতে ছুটবে। কিন্তু তাতেও রোখা গেল না দিলীপ কুমার সুচিত্রা সেনের দেবদাস। বিশাল হিট। সুচিত্রা সেনের প্রথম বলিউডে পা রাখা এই ছবি দিয়েই। টালিগঞ্জ পাড়ার সমসাময়িক নায়িকাদের থেকে বহু যোজন এগিয়ে যান সুচিত্রা সেন দেবদাসে পারোর চরিত্র করে এবং পান সর্বভারতীয় পরিচিতি।
দেবদাস (২০০২)
সঞ্জয় লীলা বনশালীর পরিচালনায় শাহরুখ খান-মাধুরী দীক্ষিত-ঐশ্বর্য রাইকে নিয়ে ব্লকব্লাস্টার হিট ছবি। শরৎচন্দ্রের কাহিনিকে অনেকখানি উল্টেপাল্টে দিয়েছিলেন বনশালী পরিচালকের ভাবনার স্বাধীনতা থেকে। পার্বতী আর চন্দ্রমুখীর শুধু দেখাই নয় তাঁদের একসাথে নাচিয়ে ছাড়লেন বনশালী।
এই ছবির (Devdas) সেট থেকে ডিজাইনার পোশাকের খরচ ছিল বিপুল অঙ্কের। শাহরুখ খানের কাছে চ্যালেঞ্জের ছিল শরৎচন্দ্রের বাঙালি নায়ক হয়ে ওঠা।
মাঝলি দিদি (১৯৬৭)
১৯৫০ সালে কানন দেবীর শ্রীমতী পিকচার্সের নিবেদনে এল ‘মেজ দিদি'। নামভূমিকায় কাননবালা। এমন একটি চরিত্র সবার মনে বসেছিল। কাননের বিকল্প হয়না মেজ দিদির চরিত্রে। কিন্তু হিন্দিতে মেজ দিদি হল। কাননের জুতোতে পা গলালেন মীনাকুমারী। মীনা ছাড়া কেই বা পারতেন অমন মাতৃত্ববোধ পর্দায় ফোটাতে!
১৯৬৭ তে বাঙালি পরিচালক হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় এল 'মাঝলি দিদি' (Majli Didi)। চরিত্র চিত্রনে মীনাকুমারী, ধর্মেন্দ্র, ললিতা পাওয়ার, সারিকা, শচীন। তবে এই ছবি সেভাবে সফলতা পায়নি মীনার অন্য ছবির মতো। কাননের বিকল্প রূপেও মীনাকে মেনে নেয়নি বাঙালিরা। বক্সঅফিসে সাড়া জাগায়নি মীনার এই ছবি। তবে মীনার অভিনয় প্রশংসিত হয়।
খুশবু (১৯৭৫)
শরৎচন্দ্রের 'পণ্ডিতমশাই' কাহিনি নিয়ে গুলজার তৈরি করেন 'খুশবু' (Khusbu)। নিপাট বাঙালিয়ানা আর বাংলার গ্রামের দৃশ্যে ছবিটিকে অনবদ্য মুনশিয়ানায় তৈরি করেছিলেন গুলজার। কুসুম (হেমা মালিনী) আর বৃন্দাবন (জিতেন্দ্র) দুজন একই গ্রামে থাকত। তাঁদের নাবালক বয়সে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বৃন্দাবনের পরিবার কুসুমকে মেনে নেয় না। বড় হয়ে বৃন্দাবন ডাক্তারি পাশ করে এক বিধবা লক্ষ্মী (শর্মিলা ঠাকুর)-কে বিয়ে করে। এরপর লক্ষ্মী এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়ে মারা যায়। যার নাম চরণ (মাস্টার রাজু)। চরণকে নিয়ে বৃন্দাবন ডাক্তারি করতে কুসুমদের গ্রামে আসে। কুসুমের সঙ্গে পরিচয় হয় চরণের। দুজনের ভাব জমে। কুসুম চরণের বাবা বৃন্দাবনকে দেখেই চিনতে পারে সেই তাঁর বাল্যবিবাহর স্বামী। কিন্তু বৃন্দাবনকে কুসুম প্রত্যাখান করে কারণ স্বামীর ঘর না জোটায় কিশোরী কুসুম একঘরে হয়ে গেছিল। কুসুমকে কি ফিরে পায় বৃন্দাবন?
কিশোর কুমার আর আশা ভোঁসলের কণ্ঠে 'খুশবু' ছবির অনবদ্য গান আজও সমান জনপ্রিয়।
স্বামী (১৯৭৭)
শরৎচন্দ্রের 'স্বামী' (Swami) কাহিনি নিয়ে বাসু চট্টোপাধ্যায়ের ছবি 'স্বামী'। শাবানা আজমি আর গিরিশ কারনাড অভিনীত বিখ্যাত ছবি। শাবানা গল্পের নায়িকা সৌদামিনী। যার হঠাৎ বিয়ে হয়ে যায় ঘনশ্যাম (গিরিশ কারনাড) এর সঙ্গে। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি যেন একটা জেলখানা। সৎ শাশুড়ি আর ননদের জ্বালায় সৌদামিনী অতিষ্ঠ হয়ে যায়। তাঁর স্বামী এসবের প্রতিবাদ করে না। সৌদামিনী স্বামীর ঘর ছেড়ে চলে আসে বাপের বাড়ি। পরে সে বোঝে তাঁর স্বামীর মন আদতে কত বড়। তাই অমন খারাপ লোকেদের সে পরিবারের অঙ্গ ভাবে। সৌদামিনী ফিরে আসে স্বামীর ঘরে।
আপনে পরায়ে (১৯৮০)
শরৎচন্দ্রের 'নিষ্কৃতি' অবলম্বনে বাসু চট্টোপাধ্যায়ের এই ছবি। শাবানা আজমি ও অমল পালেকার মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেন। উৎপল দত্ত ও গিরিশ কারনাডও ছিলেন। একান্নবর্তী পরিবারে হওয়া পারিবারিক রাজনীতি নিয়েই শরৎচন্দ্রের এই গল্প।
বিরাজ বহু (১৯৫৪)
বাংলাতে উত্তম কুমার আর মাধবী মুখোপাধ্যায় করেছিলেন 'বিরাজ বউ'। তার অনেক আগেই হিন্দিতে বিমল রায় করলেন 'বিরাজ বহু'। দুই ভাইয়ের পারিবারিক বিবাদ থেকে সততার মূল্যর গল্প। বিরাজ বউ হন কামিনী কৌশল ও তাঁর স্বামী নীলাম্বর চক্রবর্তীর ভূমিকায় অভি ভট্টাচার্য। ছবিটি বিপুল প্রশংসিত হয় এবং সেরা অভিনেত্রীর ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পান কামিনী কৌশল।
পরিণীতা (১৯৫৩)
বিমল রায় শরৎচন্দ্রের কালজয়ী প্রেম কাহিনি ‘পরিণীতা’কে তুলে ধরেন পর্দায়। শেখর চরিত্রে অশোক কুমার এবং লোলিতার ভূমিকায় মীনাকুমারী। অশোক কুমার বাদেও আরেক বাঙালি অভিনেতা অসিত বরণ এই ছবিতে গিরিনের চরিত্রে অভিনয় করেন।
পরিণীতা (২০০৫)
প্রদীপ সরকারের প্রথম হিন্দি ফিচার ফিল্ম এটি। যা আশাতীত সাফল্য লাভ করে। ছবির গানও সুপারহিট যা সুরকার শান্তনু মৈত্রকে প্রথম খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে দেয়। শেখরের চরিত্রে সেফ আলি খান, লোলিতা বিদ্যা বালান ও গিরিন সঞ্জয় দত্ত। বিমল রায়ের ছবির থেকে নতুন পরিণীতা অনেক বেশি গ্ল্যামারাস ছিল বিধুবিনোদ চোপড়ার প্রোডাকশনে। রেখাকে দিয়ে ক্যাবারে অ্যাপিয়ারেন্সও করান প্রদীপ সরকার ও বিধুবিনোদ। লোলিতা চরিত্রে হিন্দি ছবিতে প্রথম পা রাখেন বিদ্যা বালান। ষাটের দশকের নায়িকাদের আদলে বিদ্যার বাঙালি লুক অসম্ভব হিট করে। এরপর আর বিদ্যা বালানকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। শেখরের বাঙালি চরিত্র করে পতৌদি তনয় তাঁর ফ্লপহিরো তকমা ঘুচিয়ে হিটের মুখ দেখেন।
আরও পড়ুন: আবার ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’, পদ্ম ঝি অনন্যা, হাজারি ঠাকুর বাংলাদেশের মোশাররফ করিম