শেষ আপডেট: 29th August 2023 12:45
'অঞ্জলি লহ মোর সংগীতে
প্রদীপ-শিখা সম কাঁপিছে প্রাণ মম
তোমায়, হে সুন্দর, বন্দিতে
সঙ্গীতে সঙ্গীতে... '
এই নজরুলসঙ্গীতটি সর্বাধিক জনপ্রিয় গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের (Sandhya Mukherjee) কণ্ঠে। সন্ধ্যার ছোটবেলা থেকেই পছন্দ ছিল নজরুলগীতি। গুনগুন করে খেলার ছলে কাজের ছলে সন্ধ্যা গেয়েই যেতেন নজরুলগীতি। বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল ইসলাম ছিলেন সন্ধ্যার কাছে আদর্শ। একদিন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় কাজী নজরুলকে (Najrul Islam) চাক্ষুষ দেখেছিলেন, যে অভিজ্ঞতার কথা আজীবন মনে রেখেছিলেন সন্ধ্যা। কতকটা সুখের কতকটা দুঃখের সে অভিজ্ঞতা।
কাজি নজরুল ইসলামের স্ত্রী প্রমীলা দেবী সন্ধ্যার গান খুব পছন্দ করতেন। তখন কবি থাকেন পাইকপাড়ায়। কিন্তু নজরুলের তখন বোধশক্তি নেই। একেবারেই শিশুর মতো দিস্তে দিস্তে কাগজ ছিঁড়তেন তিনি। কাজি নজরুলের বড় ছেলে কাজী সব্যসাচী তখন আকাশবাণীর ঘোষক। প্রায়ই ফোন করে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে বলতেন "সন্ধ্যাদি আমার মা আপনার গানের খুব ভক্ত। একদিন যদি আমাদের বাড়িতে আসেন মা খুব খুশি হবেন। আমার মা প্রমীলা দেবী আপনাকে দেখতে চান। একবার আমাদের পাইকপাড়ার বাড়িতে আসুন।"
https://youtu.be/Y-xxgMT4uSw
কবি পত্নীর আবদার রেখেছিলেন সন্ধ্যা। এ ঘটনা সন্ধ্যার বিয়ের কয়েক বছর আগের। সন্ধ্যা তাঁর বৌদি ও দিদির ছোট ছেলেকে নিয়ে গেছিলেন কাজি নজরুলের পাইকপাড়ার বাড়িতে। বর্ষণমুখর দিনে জুঁই ফুলের মালা নিয়ে গেছিলেন সন্ধ্যা, কবির জন্যে। সঙ্গে চাপা ও বেল ফুল। আর মিষ্টি। কিন্তু কবির বাড়ি গিয়ে সন্ধ্যার মন যেমন পবিত্রতায় মুগ্ধ হয়, তেমন বিষাদেও ভরে ওঠে।
যে নজরুল লিখেছিলেন...
'আমি সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক
আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক!
আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস,
আমি আপনা ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ!'
...সেই কবি জড়ভরত হয়ে বসে শুধু কাগজ ছিঁড়ে যাচ্ছেন! তাঁর চোখ দুটি যেন কী খুঁজছে, কিন্তু পাচ্ছে না। উদভ্রান্ত স্মৃতিভ্রংশ কবিকে দেখে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মনটা বিষাদগ্রস্থ হয়ে ওঠে। আজ কবি সুস্থ থাকলে কত গল্প করতেন,সন্ধ্যার গান শুনে কত কী বলতেন। আবার সন্ধ্যাও কবির সান্নিধ্যে সঙ্গীতশিক্ষা করতে পারেন। এ কেমন দর্শন!
'তোমার মুখে চাহি আমার বাণী যত
লুটাইয়া পড়ে ঝরা ফুলের মতো,
তোমার পদতলে রঞ্জিতে
সঙ্গীতে সঙ্গীতে...'
https://youtu.be/vic-O4GYibY
তবু এমন এক মহামানবকে দর্শনের অভিজ্ঞতা সন্ধ্যা ভোলেননি।
কবিকে প্রণাম করে তাঁর পায়ের কাছে সন্ধ্যা ফুল রাখতেই কবি 'আঃ' করে চেঁচিয়ে উঠলেন। সন্ধ্যা ভয় পেয়ে সরে গেলেন, ভাবলেন কবি বিরক্ত হয়েছেন। কবিপত্নী প্রমীলা দেবী সন্ধ্যাকে বললেন "ভয় পেও না। উনি তোমাদের দেখে খুশি হয়েছেন। তাই ওভাবে চেঁচিয়ে উঠলেন।"সেদিন ছিল কাজি অনিরুদ্ধর ছেলের জন্মদিন। সন্ধ্যা কবির বাড়ির লোকদের থেকে জেনেছিলেন রোজ, এখন কবির জন্য দিস্তে দিস্তে কাগজ আসে, তিনি সেগুলো শিশুর মতো ছিঁড়ে যান। লিখতে না পারার জ্বালার বহিঃপ্রকাশ যেন।
তবে শুধু কাজি নজরুলকে দেখেই সন্ধ্যার মন ভারাক্রান্ত হয়নি। মন ভারাক্রান্ত হবার আরেক কারণ কবিপত্নীর প্রমীলা দেবীর অবস্থা দেখেও। আবার সন্ধ্যা মুগ্ধ হন কবির প্রতি প্রমীলা দেবীর ভালবাসা দেখেও।
কবির খাটের নীচে আরেকটা চৌকিতে শুয়ে থাকতেন প্রমীলা দেবী। তখন তাঁর কোমর থেকে পায়ের নীচ অবধি পক্ষাঘাতে অবশ। কিন্তু প্রমীলা দেবীর চৌকির নীচে সব রান্নার উপকরণ ও সরঞ্জাম দেখে অবাক হয়েছিলেন সন্ধ্যা। প্রমীলা দেবীকে সন্ধ্যা কারণ জিজ্ঞেস করতে তিনি বলেছিলেন "কবি নজরুল আমার হাতের রান্না ছাড়া কিছুতেই খেতে চান না। তাই মানুষটার জন্য এভাবেই রোজ রান্না করি।"এমন ভালবাসা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন সন্ধ্যা। প্রমীলা দেবীকে 'মা' বলে ডাকেন সন্ধ্যা। কিন্তু কবি ও কবিপত্নী দুটি মানুষের এই রোগযন্ত্রণা সহ্য করতে পারেননি সন্ধ্যা। তাই আর পরে কাজি নজরুলের পাইকপাড়ার বাড়িতে যাননি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। বিষাদের রেশ থেকে গেছিল সন্ধ্যার হৃদয়ে চিরকাল।
প্রমীলা, উমা, কল্যাণী-- কাজি নজরুলের পরিবারের স্তম্ভ তিন হিন্দু কন্যা, ধর্মের প্রাচীর ভেঙেছিল জীবনেও