
যেই শিব সেই অসুর, এমন অভিনেতা আমিই প্রথম: সম্রাট
সম্রাট মুখোপাধ্যায় (Samrat Mukherjee),ছোট পর্দায় মহালয়ার (Mahalaya) অনুষ্ঠানে ছ’বার অবতীর্ণ হয়েছেন মহিষাসুরের ভূমিকায়। এবার তিনি শিবের ভূমিকায় কালার্স বাংলার ‘দেবী দশমহাবিদ্যা’ মহালয়ার প্রভাতী অনুষ্ঠানে। একজন অভিনেতাই একাধারে শিব আর অসুরের রোল করছেন যা ইতিহাসে প্রথম।
‘দ্য ওয়াল’ পুজো আড্ডায় জনপ্রিয় অভিনেতা সম্রাট মুখোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে গল্প করলেন শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।
শুভদীপ: সম্রাট, আপনি একচেটিয়া মহিষাসুর এতদিন হয়েছেন। এবার শিব রূপে আপনি। কতটা চ্যালেঞ্জিং লেগেছে?
সম্রাট: টেলিভিশনে ছয় ছয় বার আমি মহিষাসুরের ভূমিকায় অভিনয় করেছি। আমি রেকর্ড হোল্ডার। এতবার অসুর কেউ হয়নি বোধহয় বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে। কালার্স বাংলা থেকে এবার আমায় বলল, ‘সম্রাটদা তোমায় এবার একদম অন্যরকম চরিত্রে ভাবছি। সেটা হল শিবের চরিত্র।’ আমি তখন মজা করে বললাম, ‘আমার প্রমোশন হল না ডিমোশন হল?’ মহিষাসুরমর্দিনীতে নায়ক তো শিব নয়। খলনায়ক-নায়ক দুই-ই বলা যায় মহিষাসুরকে। তাই শিবের রোলে আমার কি ডিমোশন হল! তখন ওঁরা বলল, ‘নাহ না সম্রাটদা তোমার প্রমোশন হয়েছে। এবার কালার্সে ‘দশমহাবিদ্যা’ করা হচ্ছে। যেখানে শিব ঠাকুরই হচ্ছেন নায়ক। আমরা এমন ভাবে চিত্রনাট্যটা তৈরি করেছি যেখানে শিবই সূত্রধর। শিব গল্পটা বলছে।’

আমি এটা দ্বিতীয় বার শিব হলাম। এর আগে স্টার জলসার মহালয়ার অনুষ্ঠানে শিব হয়েছিলাম। কিন্তু এবারের শিব করাটা একদম অন্যরকম। আমি বহু বছর ধরে মহালয়ার অনুষ্ঠানে পারফর্ম করছি। মহালয়ার এইধরনের অনুষ্ঠানে তো ছেলেদের জায়গা খুবই কম। সেখানে শিবের এত সংলাপ, এত নাচ, এত বড় রোল কোনওবার আগে পাইনি। দারুণ একটা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেলাম। আর আমায় শিবের চরিত্রে ভাবার মূলে যিনি, তিনি অজপা মুখোপাধ্যায়। ‘বউ কথা কউ’-তে আমার আইকনিক চরিত্র ‘সাগর সেন’ এর লুক অজপা’র তৈরি করা ছিল। সেই তখন থেকে আমরা পরস্পরের কাজ পছন্দ করি।
শুভদীপ: মহালয়ার অনুষ্ঠানে শিবের এত বড় চরিত্র। যা আগে হয়নি। সম্রাট তাহলে আপনি মিথ ভাঙলেন তো?
সম্রাট: আমাদের বাংলা টেলিভিশনে ছেলেদের কিন্তু খুব একটা এক্সপ্লোর করার জায়গা নেই। সিরিয়ালেও নারী চরিত্রদের গুরুত্ব বেশি। কিন্তু আমার ক্যারিয়ারটা অন্যখাতে বয়েছে। আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি কারণ টেলিভিশনে বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্টাল রোলে আমি কাজ করেছি। এত এক্সপেরিমেন্টাল রোল টলিউডে ছেলেরা পায় না। নায়ক, ভিলেন, গুন্ডা, পুলিশ অফিসার, আন্ডার ওয়ার্ল্ড ডন, রাজা যত রকমের চরিত্র হয় সবই করেছি আমি।
শুভদীপ: অসুর আর শিব এক ব্যক্তিই হচ্ছেন, এটাও তো বিরল ঘটনা ঘটালেন আপনি সম্রাট?
সম্রাট: হ্যাঁ যারা অসুর করে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তাঁরা অসুরই করেন। যারা শিব করেছেন তাঁরা শিবই সাজেন। যার চেহারায় যেটা মানায়। কিন্তু একই অভিনেতা গতবার অসুর হচ্ছেন এবার শিব হলেন এই অফার সবার কাছে আসেনা। শিবই অসুর হচ্ছেন, আবার অসুরই শিব হচ্ছেন এই ভার্সেটাইলিটি সবার চেহারায় থাকে না। একাধারে শিব আর অসুর আমিই হলাম।

শুভদীপ: ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত তো এই অনুষ্ঠানে দুর্গা। আর আপনি শিব। ঋতুপর্ণার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা?
সম্রাট: ঋতুপর্ণার সঙ্গে দীর্ঘ বারো বছর পর আমি আবার জুটি বাঁধলাম শিব-পার্বতী রূপে। বারো বছর আগে সনৎ দত্তর ছবি ‘হ্যান্ডকাফ’-এ ঋতুপর্ণার সঙ্গে কাজ করেছিলাম। ঋতু ভীষণ প্রফেশনাল। ওঁর সঙ্গে কাজ করার মজাটা হল আমি আর ঋতু কালার্স বাংলার ‘দেবী দশমহাবিদ্যা’-তে স্ক্রিন শেয়ার করলেও আমরা একসঙ্গে শ্যুট করিনি। আমরা আলাদা আলাদা রিহার্সাল ও শ্যুটিং করেছি। কিন্তু এডিটিং-এ আমার আর ঋতুর পারফর্ম্যান্স একসঙ্গে জোড়া লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটাই মজার দর্শকরা দেখলে বুঝবেন না আমি আর ঋতু আলাদা শ্যুটিং করেছি। মনে হবে ডুয়েট পারফর্ম্যান্স। ঋতু আর আমি দু’জনেই যেহেতু অভিজ্ঞ আর্টিস্ট সেহেতু আমাদের এটা করতে অসুবিধে হয়নি।

শুভদীপ: ‘দেবী দশমহাবিদ্যা’-তে শিব রূপে সম্রাটকে তাণ্ডব নৃত্য করতে দেখা যাবে। টালিগঞ্জ পাড়ায় প্রফেশনাল নাচ জানা অভিনেতা কিন্তু খুব কম। ছেলে হয়ে নাচে! সেই নিয়ে সমাজের অনেক ট্যাবু থাকে। কিন্তু আপনি অভিনয়ের সঙ্গে নাচকে চিরকাল গুরুত্ব দিয়েছেন। কী বলবেন?
সম্রাট: আমি নিজে একজন তো শিক্ষক। আমার এসএমপিএআই ইনস্টিটিউটের বহু ছাত্রছাত্রীরা টলিউডে আজ বিখ্যাত। মিমি চক্রবর্তী, শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়, যশ দাশগুপ্ত থেকে শুরু করে অন্বেষা হাজরা, দেবচন্দ্রিমা সিংহ রায় সবাই, সিনেমা থেকে টেলিভিশন আমার প্রচুর ছাত্রছাত্রীরা রয়েছে। আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের সবসময় বলি নাচটা যদি তোমাদের আয়ত্তে থাকে তোমরা অনেক রকম সাবজেক্টে কাজ করতে পারবে, বডি ল্যাঙ্গোয়েজ স্ট্রং হয়ে যাবে। নাচটা গুলে খেয়েছি বলেই হয়তো আজও টিকে আছি।

শুভদীপ: শিবের চরিত্র করে স্মরণীয় মুহূর্ত?
সম্রাট: আমি বহু বছর ধরে মহালয়ার অনুষ্ঠানে কাজ করছি। কিন্তু এবার শিবের চরিত্র করতে গিয়ে আমি ভীষণ নার্ভাস ছিলাম। নাচ আর ডায়লগ দুটোই বেশি। নাচ তো অনেক করেছি। কিন্তু শিবের চরিত্রের জন্য ভরতনাট্যম শিখতে হল। ছেলেরা ভরতনাট্যম শিখছে বেশ বিরল। আমি নিজের গরজে গিয়ে ভরতনাট্যম শিখেছি। ছেলেরা নাচ করলে এমনিতেই সমালোচনার সম্মুখীন হয় বেশি। আর শিব সবার কাছেই একটা আবেগপ্রবণ জায়গা। তাই কোনও ভুল হলেই সমালোচনা হবেই। এই বয়সে এসে এই জায়গায় দাঁড়িয়ে সমালোচনার সম্মুখীন হতে চাইনা। এইবারে আমি পাঁচদিন রিহার্সাল করেছি কোরিওগ্রাফার কাশ্মিরার কাছে। যা দীর্ঘ এত বছরে করিনি। শুধু তাই নয় এবার মক ডাবিংও করেছি। বহু কঠিন সংস্কৃত শব্দ সঠিক ভাবে বলতে হয়েছে। মহালয়ার দিন দর্শকরা কী বলবেন তার জন্য খুব আশা নিয়ে আছি। জনতা জনার্দনই সব।
শুভদীপ: অভিজ্ঞ অভিনেতারা দুর্গা, শিব চরিত্র করলেই তাঁদের বয়স তুলে ব্যঙ্গ করা হয়। নেট নাগরিকরা শিল্পীদের বয়স্ক বলে ট্রোল করে। এদের জবাব কী দেবেন?
সম্রাট: নিজেকে যে বজায় রাখবে, সেই টিকে থাকবে। একমাত্র আমাদের অভিনেতাদের কোনও বয়সের বায়োডাটা নিয়ে ঘুরতে হয়না। আমাকে দেখতে যদি পঞ্চাশ-ষাটের প্রৌঢ়র মতো লাগে তাহলে ট্রোল করা মানতাম। কিন্তু নাচ, অভিনয় থেকে চেহারার ফিটনেস ধরে রাখা আমি করে চলেছি। এটা আমার সাধনা। এ বছর ২০২২-এ আমার ইন্ডাস্ট্রিতে ২০ বছর পূর্ণ হল। ২০০২ সালে হিরো রূপে আমার প্রথম ছবি অঞ্জন চৌধুরীর ‘চন্দ্রমল্লিকা’ মুক্তি পেয়েছিল। এখনও আমি হিরো বেসড চরিত্রই করি। আমার বয়সী অভিনেতারা এখন তো বাবা-কাকার চরিত্রে অভিনয় করছেন। শুধুমাত্র আমি আর জিৎ ২০ বছর পেরিয়েও মেনস্ট্রিমে নায়ক আছি। জিৎ ফিল্মে, আমি টেলিভিশনে। কিন্তু আমাদের সঙ্গে যে অভিনেতারা শুরু করেছিলেন তাঁরা আজ বাবা-কাকার রোলই পান।
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত নিজেকে বজায় রেখেছেন তো তিনি একশবার দুর্গা করতে পারেন। বলিউডে শাহরুখ খান, সলমন খানদের তো কেউ বয়স তুলে ট্রোল করেনা। বাঙালিরা বয়স নিয়ে বেশি কালচার করেন। দুর্গা বা শিবের চরিত্রে ম্যাচিউরিটি জরুরি। আমি এমনও দেখেছি ক্লাস নাইন টেনের মেয়েকে দুর্গার রোল দিচ্ছে। তাকে আদৌ মানাবে! ব্যক্তিত্বটা জরুরী।
শুভদীপ: সম্রাট মানেই স্থির যৌবন, যৌবন ধরে রাখার রহস্যটা কী?
সম্রাট: আমার নিজের বাড়িতে জিম আছে। এখানেও আমি ট্রেন্ড সেটার। আমাকে দেখেই জিৎ, অঙ্কুশ হাজরারা বাড়িতে জিম করা শুরু করেছে। টলিউডে আগে কোনও আর্টিস্টদের বাড়িতে জিম ছিলনা। আমিই প্রথম বাড়িতে জিম হাউস তৈরি করি।

শুভদীপ: পুজোয় সব ছেলেরা স্থিরযৌবন সম্রাট হতে চাইলে কী করবে? পুজোর টিপস?
সম্রাট: আমি সিগারেট খাই না। নেশামুক্ত জীবন, পরিমিত ডায়েট আর দেড়-দু’ঘণ্টা জিম এই আমার মন্ত্র। সবাই সেটাই করুন তাহলেই সুন্দর আকর্ষণীয় চেহারা থাকবে। আর এটা সারা বছরের সাধনা করতে হবে।
‘দ্য ওয়াল’ এর সমস্ত পাঠককে শারদীয়ার শুভেচ্ছা।