
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
‘থিয়েটারে লোকশিক্ষে হয়’, বলেছিলেন স্বয়ং রামকৃষ্ণদেব। কিন্তু আজকাল অভিযোগ ওঠে, ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক কাহিনি-নির্ভর জনপ্রিয় সিরিয়ালগুলির চিত্রনাট্য বেশিরভাগই চিত্রনাট্যকারদের স্বরচিত। সঠিক ও বিস্তারিত গবেষণা না করেই তাঁরা ঐতিহাসিক চরিত্রগুলিকে ভুল তথ্যে দর্শকের সামনে আনছেন। তার উপর আজকাল মানুষের বই পড়ার অভ্যেস একেবারেই তলানিতে। সবার চোখ স্মার্টফোন বা টেলিভিশনে। সেখানেই যদি ভুল ইতিহাস দেখানো হয় রোজ মেগা সিরিয়ালে, তাহলে সেটা দুঃখজনক নয়, বিপজ্জনকও। অনেকেই এই জনপ্রিয় মেগা সিরিয়ালের ভুল তথ্যগুলি দেখে, এগুলোই সত্যি ঘটনা ভেবে বিভ্রান্ত হচ্ছেন।
ঠিক এমন অভিযোগই উঠেছে জি বাংলায় সম্প্রচারিত ‘করুণাময়ী রাণী রাসমণি’ সিরিয়ালে। এই সিরিয়ালে বিভিন্ন সময় বিকৃত ইতিহাস ও ভুল তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন অনেকেই। অন্যতম ভুল ইতিহাস হিসেবে দেখানো, হয়েছে কালীঘাট মন্দির ও সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের কথা।
সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার পরিষদের তরফেই এই নিয়ে উঠেছে অভিযোগ। তাঁরা জানিয়েছেন, রাণী রাসমণি সিরিয়ালে কালীঘাট মন্দির প্রসঙ্গ এবং মন্দির প্রতিষ্ঠাতা সন্তোষ রায়চৌধুরীর যে চরিত্র রাসমণিতে দেখানো হয়েছে, তা মিথ্যে এবং ভুল। পাশাপাশি, বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের যে দু’টি চরিত্র রাণী রাসমণি সিরিয়ালে দেখানো হয় ১৪৫ নম্বর পর্ব থেকে পরপর দশ-বারোটি পর্বে, তাতেও ভুল আছে। পর্বগুলি আগের হলেও সোশ্যাল মিডিয়া এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মে দর্শকরা এখনও তা দেখছেন এবং কালীঘাট ও সাবর্ণ চৌধুরী পরিবার নিয়ে ভুল ইতিহাস জানছেন। গতবছর লকডাউনেও জি বাংলায় এই এপিসোডগুলির পুনঃসম্প্রচার হয়েছিল।
সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার পরিষদের সম্পাদক ও সাবর্ণ সংগ্রহশালার কিউরেটর দেবর্ষি রায়চৌধুরী টেলিফোনে বলছিলেন, “করুণাময়ী রাণী রাসমণি ধারাবাহিকে এমন অনেক ঘটনাই দেখানো হয়েছে যা শুধু কাল্পনিক নয়, বিকৃত ইতিহাসও বটে। আমি অন্য ঘটনাগুলির প্রসঙ্গে মন্তব্য করছি না, কিন্তু যে ঘটনাগুলি আমাদের সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবার সম্পর্কিত হিসেবে দেখানো হয়েছিল, তা চূড়ান্ত রকম ভুল।”
দেবর্ষি বলেন, “দেখানো হয়েছিল যে সাবর্ণ জমিদার সন্তোষ রায় চৌধুরী নাকি রাণী রাসমণির শ্বশুরবাড়ি গিয়ে রাসমণিকে কালীঘাট মন্দিরে আসার আমন্ত্রণ করছিলেন। এটা হতেই পারে না, কারণ রাসমণি জন্মগ্রহন করেন ১৭৯৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। তাঁর বিয়ে হয় এগারো বছর বয়েসে অর্থাৎ ১৮০৪ সাল নাগাদ। তাহলে রাসমণি কলকাতায় শ্বশুরবাড়িতে ছিলেন ১৮০৪ থেকে তাঁর মৃত্যু অর্থাৎ ১৮৬১ সাল পর্যন্ত। শেষজীবনে যদিও রাসমণি কালীঘাট সংলগ্ন বাড়িতে কিছুকাল ছিলেন, সেটা বহু পরে।
অথচ রাসমণির বিয়ের পাঁচ বছর আগেই ১৭৯৯ সালে সন্তোষ রায়চৌধুরী পরলোকগমন করেন। কালীঘাটের মন্দিরও তখন সম্পূর্ণ হয়নি। সন্তোষ রায় চৌধুরীর নাতি রাজীবলোচন রায় চৌধুরী ১৮০৯ সালে কালীঘাট মন্দিরের নির্মাণ সম্পূর্ণ করেন। অর্থাৎ রাসমণির সঙ্গে সন্তোষ রায় চৌধুরীর কোনওদিনই দেখা হয়নি। ধারাবাহিকের লেখক ভুল তথ্য পেশ করেছেন। যদি উনি সত্য ইতিহাস লিখতে চাইতেন তাহলে একবার আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতেন।
যদিও ধারাবাহিকের শুরুর সময় পর্দায় বলেই দেওয়া হয় যে এটি কাল্পনিক গল্প। অর্থাৎ এখানে রাসমণি শুধুই ধারাবাহিকের কাল্পনিক নায়িকা, আমাদের শ্রদ্ধেয় ঐতিহাসিক চরিত্র রাণী রাসমণি নন!”
‘করুণাময়ী রাণী রাসমণী’ সিরিয়ালে সন্তোষ রায়চৌধুরীর চরিত্রে অভিনয় করেন কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়। যে চরিত্রটি তখন ইতিহাসে মৃত, তাঁকেই জীবিত দেখানো হয়েছে সিরিয়ালে। রাজীবলোচন রায়চৌধুরীর চরিত্রে অভিনয় করেন সুদীপ সেনগুপ্ত। এই চরিত্রটিকেও ভুল ভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে সিরিয়ালে।
সন্তোষ রায়চৌধুরী ও রাজীবলোচন রায় চৌধুরীর বংশধর দেবর্ষি রায়চৌধুরী এ নিয়ে বললেন, “রাজীবলোচন রায়চৌধুরী হলেন সন্তোষ রায়চৌধুরীর ভ্রাতুষ্পৌত্র, অর্থাৎ নাতি। কিন্তু রাণী রাসমণি সিরিয়ালে রাজীবলোচনকে সন্তোষ রায়চৌধুরীর ভ্রাতুষ্পুত্র অর্থাৎ ভাইপো দেখানো হল। এছাড়াও দেখানো হচ্ছে রাজীবলোচন নাকি রাজচন্দ্র দাসের ইয়ারদোস্ত। এরকম কোনও তথ্য আমাদের কাছে নেই।”
সতীপীঠ কালীঘাট মন্দিরের ইতিহাস সবার কাছেই অতি আগ্রহের বিষয়। এরকম একটা আইকনিক ইতিহাস সম্পর্কে দর্শকদের আগ্রহ থাকবেই, কিন্তু সেই কালীঘাট মন্দিরের ইতিহাস সিরিয়ালে পুরো ভুল দেখানোর এই অভিযোগ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া ইতিমধ্যেই সরগরম।
দেবর্ষি রায়চৌধুরী আরও বলেন, “সিরিয়ালের প্রতিটি পর্ব ধরে যদি বলি কালীঘাট মন্দিরের ইতিহাস, তাহলে আরও স্পষ্ট হবে কতটা ভুল দেখানো হয় সিরিয়ালে। দেখানো হচ্ছে, একটি শিলাখণ্ড আদি গঙ্গার ধারে পড়ে আছে সেখানে কাপালিকরা এসে পুজো করে মা কালীর প্রাণসঞ্চার করছেন এবং সেখানে রাসমণি ও রাজচন্দ্র নৌকাপথে আসছেন। প্রথম কথা, তখন কালীঘাট জনপদ হয়ে গেছে। নদীপথে এসে নামার কোনও কারণ নেই। এত বনজঙ্গল কলকাতা শহর ছিল না। মোটেই তখন কলকাতায় বাঘ ঘুরে বেড়াত না।
তাছাড়াও কালীঘাটের ব্রহ্মশিলা মাঠেঘাটে পড়ে আছে তখন, এই ইতিহাস ভুল। রাসমণি জন্মগ্রহন করেন ১৭৯৩ সালে। ১৮০৪ সাল নাগাদ রাসমণি বিয়ের পরে কলকাতা আসেন আর কালীঘাটের মা কালীর এই মূর্তি শিলাখণ্ড থেকে তৈরি হয়ে গেছে ১৫৭০ সালে। সিরিয়ালে সবটাই মিথ্যে।
সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবার পশ্চিমবঙ্গের এক প্রাচীন কৃষ্টিসম্পন্ন জমিদারবংশ। জিয়া গঙ্গোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী পদ্মাবতী দেবীর সন্তান না হওয়ায় আত্মীয়-স্বজন বলেছিলেন, কালীঘাটে গিয়ে তাঁদের পারিবারিক দেবতা দেবী কালিকার কাছে পুত্রকামনা করে তিনদিন তিনরাত্রি ধরে সাধনার জন্য। সেই যুগে এই মন্দিরটা ছিল আশুতোষ কলেজের পেছনে। তৃতীয় দিন সাধনা চলাকালীন রাত্রে কালীঘাটের কালীকুণ্ডর জলের ওপর এক আলোর ছটা দেখতে পান পদ্মাবতীদেবী। পরের দিন ওই পুকুরে স্নান করতে গিয়ে তিনি জলের তলায় সতীর দেহাংশ দেখতে পান ও দৈববাণী শ্রবণ করেন। সেই দৈববাণী শুনে দেবীর প্রধান পুরোহিত আত্মারাম ঠাকুর পুকুরের তলা থেকে দেবীর সতীঅংশ উদ্ধার করেন। ১৫৭০ সালের আষাঢ় মাস স্নান পূর্নিমা তিথিতে একটি লাল পট্টবস্ত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত হলেন দেবী কালিকা। শুরু হল সতীর নিত্য পূজাপাঠ। প্রসঙ্গত, ১৫৬৯ সালে হালিশহর থেকে সাবর্ণ গোত্রীয় দম্পতি যখন কালীঘাটে এলেন তখন কালীঘাটের প্রধান পুরোহিত ধ্যানমগ্ন মহাযোগী শ্রীমৎ আত্মারাম ঠাকুরের থেকে তন্ত্রমতে দীক্ষা নিলেন জিয়া গঙ্গোপাধ্যায় এবং পদ্মাবতী দেবী।
শিষ্য জিয়ার ঝুলিতে তাঁর বংশের আরাধ্যা কুলদেবী মাতা ভুবনেশ্বরীর বিগ্রহ দর্শন করলেন। আত্মারাম ঠাকুর স্বপ্নাদিষ্ট ব্রহ্মশীলা প্রাপ্তির সাধনায় মগ্ন ছিলেন এবং সেই শিলা ভুবনেশ্বরী রূপে দেখলেন। তিনি শিষ্য ও মহাযোগী মহাত্মা ব্রহ্মানন্দ গিরির সাহায্যে ব্রহ্মশিলায় খোদাই করে ফুটিয়ে তুললেন ত্রিনয়নী মাতৃকা রূপ। শুরু হল মায়ের বিগ্রহ পূজা। কালীঘাটের মাতৃমূর্তি সাবর্ণদের ভুবনেশ্বরী মূর্তির আদলে। এবং পদ্মাবতী দেবীর গর্ভে এল মা কালীর বরপুত্র লক্ষীকান্ত রায়চৌধুরী। যিনি হলেন আমাদের সাবর্ণ রায়চৌধুরী বংশের আদি পুরুষ।
সন্তোষ রায়চৌধুরী ও রাজীবলোচন এখনকার কালীঘাট মন্দির স্থাপনের আগেই, কালীকুণ্ডর পাশে এই কালীঘাট মন্দিরের কাছেই পর্ণকুটিরে মায়ের এই ভুবনেশ্বরী মূর্তি ছিল। মন্দির তৈরি হওয়ার বহু আগেই কালী মূর্তি প্রতিষ্ঠিত। এই ঘটনাগুলো রাসমণির জন্মের তিনশো বছর আগেই ঘটে গেছে। কাপালিকরা এসে তন্ত্রসাধনা করতেন আরও দুশো বছর আগে। তাহলে রাসমণি রাজচন্দ্র নদীর পাড়ে শিলা পড়ে আছে, সেটা দেখছে কী করে সিরিয়ালে? শিলা থেকে মা কালী জেগে উঠে রাসমণিকে দেখা দিলেন, এটা পুরোটাই গালগল্প। পুরো ইতিহাসটাই মিথ্যে দেখিয়েছে সিরিয়ালে।
রাণী রাসমণি আদি গঙ্গা দিয়ে এখনকার টালিগঞ্জের করুণাময়ী মন্দিরে এসেছিলেন যখন তিনি বেনারস যাচ্ছেন। তখন তিনি করুণাময়ী মন্দিরের মাতৃমূর্তির আদলে ভবতারিণী মূর্তির চিন্তা করেন। এক হাজার ইউরোপীয় বসবাস করছে সেসময় কলকাতায়। সেখানে কালীঘাট মন্দির ধূ ধূ মাঠ আর বাঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে, এগুলো পুরোপুরি মিথ্যেকথা। ১৮০৯ থেকে ১৮৩০ সাল অবধি বড়িশা থেকে লক্ষীকান্তর পরবর্তী বংশধর কালীকান্ত রায়চৌধুরী ঘোড়ার গাড়ি চড়ে কালীঘাটে গিয়ে কালী মন্দির খুলে সেখানে রাত্রে পুজো হয়ে যাওয়ার পরে চাবি লাগিয়ে চলে আসতেন। ইতিহাসটাকে যুক্তিপূর্ণ ভাবে যদি আমরা না দেখি তখনই এসব গালগল্প বা অলৌকিক ঘটনায় বিশ্বাস করতে হবে। সিরিয়ালে ব্যক্তি রাসমণির চেয়ে তাঁকে অলৌকিক ক্ষমতাধরী হিসেবে দেখানো হচ্ছে, এটা ঠিক নয়।”
আমাদের সাবর্ণ পরিবারের ঘটনাগুলো দেখানোর আগে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সঠিক ইতিহাস জেনে চিত্রনাট্য লেখা হোক। রাসমণি পরিবার শুধু সমর্থন করলে তো হবে না, আমার পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে কে একটা ভুল বই লিখেছে সেটা তো কোনও প্রমাণ হতে পারে না।
দেবর্ষি আরও বলেন, “আমি নিজে অসুস্থ ছিলাম তাই সব এপিসোড তখন দেখে উঠতে পারিনি। পরে দেখলাম এবং তাজ্জব হয়ে গেলাম, কীভাবে আমাদের পরিবারের ইতিহাস বিকৃত করেছে। পরেও সুন্দরবন পর্বে দেখলাম মথুর এবং রাণীমা বাঘ-কুমীরের সঙ্গে লড়াই করছেন। এগুলো তো সিরিয়াল বাড়াতে গালগল্প। সুন্দরবন রাসমণি যেতেই পারেন। কিন্তু সেখানে দক্ষিণরায় ও রাসমণির দ্বৈরথ– এগুলো পুরোটাই গালগল্প।
মৃত লোকদের জীবিত দেখিয়ে দিচ্ছে, নাতিকে ভাইপো দেখাচ্ছে এবং সর্বোপরি কালীঘাট মন্দির নিয়ে যা ইচ্ছে তাই দেখাচ্ছে রাণী রাসমণি সিরিয়ালে। এই সিরিয়ালগুলোর বিরুদ্ধে জনস্বার্থ মামলা প্রয়োজন। সব চরিত্র কাল্পনিক বলার সুযোগ নিয়ে রাসমণি, কালীঘাট বা সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের নাম ব্যবহার করে টিআরপি তুলে এরা ইতিহাসকে বিকৃত করতে পারে না।”
এই সমস্যায় সবচেয়ে বেশি ঠকছেন হয়তো দর্শকরাই। তাঁরা তো চিত্রনাট্যকারকে বা ক্যামেরার পেছনের কারিগরদের চেনেন না। দর্শকরা অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরই দেখেন ঐতিহাসিক চরিত্রগুলির রূপে। আবার অভিনেতারা চিত্রনাট্যকার বা চ্যানেলের হাতের পুতুল, তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয় সত্যি ইতিহাস জেনে অভিনয় করা। তবু শিল্পীরাই দর্শকদের কাছে ছোট হয়ে যাচ্ছেন এই ভুলে-ভরা সিরিয়ালের জন্য।
এর উল্টো দিকে শিল্পীদের থেকেও কোনও প্রতিবাদ আসে না, যার ফল ভুগছে দর্শকরা এবং ভুল তথ্য পরিবেশন করে বাংলার ইতিহাসকেও একই সঙ্গে বিকৃত করা হচ্ছে। টিআরপি তো শেষ কথা নয়, ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্বও রয়েছে পরিচালকদের।