শেষ আপডেট: 29th January 2025 16:23
দ্য ওয়াল ব্যুরো: রূপম ইসলাম কথা বললেই তার স্বাদ তিতকুটে। তবে ‘জননেতার’ সেই ‘ভাষণগুলো’ই যেন ভক্তদের কাছে ঘুরে দাঁড়ানোর পেপটক। বিরুদ্ধতার ব্যূহে সঙ্গীত জীবনের প্রথম থেকে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে এসেছেন। এখনও সে ধারা অব্যাহত। কিন্তু তাঁর কথার কদর্থ করার লোকের অভাব নেই। এহেন রূপমই সম্প্রতি বর্ধমানের এক কনসার্টে অভিযোগ করেছেন, টলিউডের পরিচালকরা তাঁর নাম এবং খ্যাতিকে ব্যবহার করেছেন সিনেমা হিট করানোর জন্য। একথা ঘিরেই শুধু হয় বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনা। কোথাও রূপমের রিলস শেয়ার করে লেখা হচ্ছে ‘ক্ষোভ প্রকাশ’, কোথাও ‘তীব্র আক্রমণ’।
এই সব কিছুর বিরুদ্ধেই এবার মুখ খুললেন গায়ক। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর বক্তব্য শেয়ার করে লিখেছেন, 'ক্ষোভ এবং চিত্রপরিচালক প্রসঙ্গে এবং আরও কিছু কথা। কোথাও শিরোনামে লিখছে ‘ক্ষোভ প্রকাশ’, কোথাও ‘তীব্র আক্রমণ’, কোথাও আবার নতুন উদ্ভট বাংলায় ‘তীব্র প্রকাশ’, যা বস্তুতপক্ষে অর্থহীন। তবে শিরোনামগুলির মধ্যে মিল হল— এ সবই নাকি চিত্রপরিচালকদের ‘বিরুদ্ধে’ বলা।'
এবিষয়ে তিনি আরও লেখেন, 'অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী। ঠিক তেমনই আজকের যুগের অল্প ভিডিও বা বিশেষ উদ্দেশ্য প্রণোদিত ‘রিলস’— কারণ তাতে অর্ধ সত্য প্রকাশিত হয়, বাকি অর্ধেক মানুষের সামনে এসে পৌঁছয় না। বা পৌঁছতে দেওয়া হয় না। অ্যাটেনশন স্প্যান কমছে, নাকি আমরা কমাতে বাধ্য করছি— এটা ভেবে দেখা যেতেই পারে। আমাদের মতো রক পারফর্মারদের পারফর্মেন্সে যুগ-যুগ থেকেই উদ্ভট রস, তাণ্ডব রস, খেয়াল রস ছুঁয়ে যাওয়া আছে, যার একটা কনটেক্সট বা প্রসঙ্গ থাকে। সম্পূর্ণ কনসার্ট দেখলে ব্যাপারটা বেশ বোঝা যায়।'
রূপমকে নিয়ে একাধিক রিলসে ভরে গিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। সেসব রিলস-এর আগের অংশ কিংবা পরের অংশ নেই। হঠাৎই মাঝখান থেকে কয়েক সেকেন্ডের ক্লিপ নিয়ে তা পোস্ট করে দেওয়া হচ্ছে অদ্ভুত কিছু ক্যাপশনের সঙ্গে। সে নিয়ে গায়ক বলেন, 'এসব কথা কনসার্টকর্মীরা জানেন, বা তাঁদের জানবারই কথা। একটি ছোট্ট অংশকে আলাদা করে দেখলে বোঝা যাওয়ার তো কথা নয় উদ্ভট রস সেখানে কীসের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশিত হল। তবুও এই অংশটি আলাদা করে তুলে ধরে অন্য আরেক তরুণ কনসার্টকর্মী যখন বালখিল্য মন্তব্য করেন, তখন তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই মনে হয়। মনে হয়, এতদিন কেটে যাওয়ার পরেও রক সংগীতের অন্যতম মূল শিক্ষা— free yourself on the stage from all inhibitions— এঁরা (সম্মানবাচক এবং স্বস্তিদায়ক বহুবচন ব্যবহার করলাম) নিজে জেনে বুঝেও (জানেন না, এতোটা মূর্খতা আশা করি না) অস্বীকার করতে চাইছেন, কথ্য বাংলায় ‘পাবলিক নাচানো’ যাকে বলে, সেটা করাই এঁদের আসল উদ্দেশ্য । অবশ্য ‘পাবলিক নাচাতে রাজি নই’, এ কথা বলে ফসিলস বিদেশের কনসার্ট ছেড়ে দিয়েছিল— যে কথা আমার একটি বইতে আমি উল্লেখ করেছি, তেমন আদর্শ সবারই থাকতে হবে, তাও তো না। পাবলিক নাচাতে কেউ কেউ ভালবাসবেন নির্ঘাত, সে তার মঞ্চ পেছনে ফ্লেকস লাগানো মাচা-ই হোক অথবা ফেসবুক!'
চিত্রপরিচালকদের ‘বিরুদ্ধে’ আছড়ে পড়া প্রসঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ার সেই পোস্টে রূপম লেখেন, 'আসলে এ রকম কিছু ঘটলে যে তীব্র ক্ষোভ, বিরক্তি এবং বিতৃষ্ণা তৈরি হবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে এই ক্ষোভ হঠাৎ পথভ্রষ্ট হয়ে চিত্রপরিচালকদের ‘বিরুদ্ধে’ আছড়ে পড়তে যাবে কেন? যাওয়ার তো কথা নয়। যায়ওনি। ক্ষোভের কথা তো আমি স্মিত হেসে বলি না। প্রতিবাদও হাসিমুখে করি না। ডিপ্লোম্যাটিক দ্বিচারিতা আমার ধর্ম নয়। শুধু জনতার বাঁ দিক না ডান অংশ— কোন দিকের গর্জন বেশি— এই অংশের ডিপ্লোমেসি ফসিলস ‘সার্কাস’এর অংশ। এটা স্ক্রিপ্টেড। কিন্তু সোজা কথা যে সোজা ভাষায় বলে দেয়— তার মধ্যে যে ডিপ্লোমেসি নেই— এ কথা বোধহয় সুবিদিত। এতদিনে।'
ভাইরাল হওয়া একাধিক ভিডিও প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমি যে মঞ্চে গান গাই— তা কারুর কৃপাপ্রার্থী হয়ে আমায় অর্জন করতে হয়নি— এ তো অল্টারনেটিভ গান বাজনারই জয়। যেখানে আমি জিতলাম, জিতলেন আমার দর্শক-শ্রোতা, আমার জনপ্রিয়তা অন্য কেউ সার্থকভাবে ব্যবহার করলেন, তা তাঁদের কাজে লাগল— এতে ক্ষোভের কী আছে রে বাবা! এতো আনন্দের বিষয়। সেটাই তো বলেছি! আর এসব কথা আমি জানলাম কী করে? চিত্রপরিচালক, সংগীত পরিচালকরাই তো আমায় এটা বারবার বলেছেন! বানিয়ে তো বলছি না! এটা তো আমার ননফিল্ম ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসে নিজের তৈরি করা গান নিয়ে, দামি নায়কের ভিডিও না পেয়েও, বিরাট প্রযোজনা সংস্থার সাহায্য এবং অংশগ্রহণ না পেয়েও, গানগুলিকে, অ্যালবামগুলিকে জনপ্রিয় করা, একটা নতুন ধারাকে সংগীত বাজারে প্রতিষ্ঠিত করবার সাফল্য। এর মধ্যে ক্ষোভ কোথায়, আক্রমণ কোথায়— আমি তো বুঝছি না! কৃপাপ্রার্থী হলে খুশি হতাম, কৃপাপ্রার্থী না হতে হয়ে ক্ষুব্ধ— এ কথা আমি কখন বললাম! বরং গর্বই তো করলাম স্বাধীন বাংলা মৌলিক গানের মঞ্চ নিয়ে!
ছোট্ট ভিডিওগুলি বড্ড মিষ্টি, বড্ড সুন্দর। পাশে বসিয়ে কপালে বিলি কেটে চকোলেট, লেবেঞ্চুস ইত্যাদি খাওয়াতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এই শিশু ভিডিওগুলি দেখে যদি বক্তব্যের মূল সুর বা বিষয় বোঝা না যায়, বা বিকৃতমনাদের ভুল প্রোপাগান্ডায় তা নিয়মিত ব্যবহৃত হতে থাকে— তাহলে তা সমস্ত সংস্কৃতিকর্মীদের পক্ষে আতঙ্কের বিষয়। এর জন্যই আমার আয়োজিত ‘একক’ অনুষ্ঠানে ভিডিও তুলতে নিষেধাজ্ঞা জারি থাকে। এবার বুঝলেন তো, কেন?'
কনসার্টের বেশ কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর খানিকটা ক্ষোভ প্রকাশ করেই রূপম লিখেছেন, 'ফসিলস-এর কনসার্টগুলি মহোৎসব গোছের। কে কোথায় কখন ছবি তুলছেন সব লক্ষ করা, বন্ধ করা সম্ভব নয়। আমাকেই রক পারফর্মেন্সের খ্যাপামিগুলো, যার একটা দার্শনিক ভিত্তি আছে— (ভিত্তির ব্যাখ্যাগুলি আমি আমার প্রকাশিত বইগুলিতে আগেই লিখেছি— কিন্তু বই পড়া তো ফেসবুক-শিক্ষিতর কর্ম নয়, তাই তো?) সেগুলি বন্ধ করে দিতে হবে। আরও কিছু জিনিস আমি বন্ধ করে দেব, কারণ সম্মুখের রক জনতা ছাড়াও অনভিজ্ঞ এবং রক-অশিক্ষিত শ্রোতার কাছে খণ্ডচিত্র হয়ে পৌঁছে যাচ্ছি যখন, যুগের নিয়মেই সতর্ক থাকতে হবে। কিন্তু একটা প্রশ্ন! সতর্ক থেকে আদৌ কি রক পারফর্মেন্স সম্ভব? কিন্তু এছাড়া তো আর কোনও উপায় নেই। কারণ অতিরিক্ত খেটে, অতিরিক্ত অপমানিত হওয়া নির্বোধের কাজ। সাধ করে নির্বোধ হবই বা কেন?'