শেষ আপডেট: 31st January 2025 14:44
আমার জীবনে একটা সময় আসে, যখন আমি সচেনতনভাবে থিয়েটারচর্চা নিয়ে ভাবনা শুরু করি, তখন যে নাট্যদলের দোরে আমি কড়া নাড়ি, তা ছিল ‘নান্দীকার’। আর যিনি ‘নান্দীকার’-এ প্রবেশপথটি অবারিত করলেন, তিনি রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। আমার শুরু এভাবেই...তারপর যত সময় এগিয়েছে, ঘনিষ্ঠ হয়েছি, আবার পৃথকও থেকেছি। সম্পর্কে টানাপড়ে অবশ্যম্ভাবী।
কিন্তু আজও আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, রুদ্রপ্রসাদবাবু আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষক।
আমি জানি না, রুদ্রপ্রসাদবাবুর (Rudraprasad sengupta) থেকে কত কিছু শিখতে পেরেছি। আমি জানি না ওঁর শিক্ষায় শিক্ষিত হতে আদৌ পারলাম কি না। তা জানার অবকাশও হয়নি আমার। উনি কখনওই কিছু বলেননি। অনেক সময়ই আমার মনে হয়েছে, অভিনয়ের অসম্পূর্ণতা আমার মধ্যে ছিল, রয়েওছে। অনেক সময়ই হয়তো উনি আশাহত হয়েছেন। ঠিক জানি না...
তবে ওঁর (Rudraprasad sengupta)থেকে যা কিছু শেখা, তা নিয়ে আমি আমার অভিনয়ের ভিন্ন পথে বেছে নিয়েছি। হেঁটেছি সে পথে। রুদ্রবাবুর পছন্দ-অপছন্দ হয়তো ছিল তবে, তাতে শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কে ভাঁটা পড়েনি। আমি নিজের পথ নিজেই সন্ধান করতে শুরু করি, হয়তো রুদ্রবাবু এটাই চেয়েছিলেন (জানি না উনি কী বলবেন)। শিক্ষার নিয়ম তো এটাই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে যা কিছু শিখলেন, তা আপনার চলনে, চর্চায়, যাপনে কিংবা প্রতিদিনের কর্মকাণ্ডে, নিজের মতো করে প্রয়োগ করবেন। নিজেকে শুধুমাত্র সেই প্রাতিষ্ঠানিক বেড়াজালে জড়িয়ে ফেলবেন না। অবশ্যই প্রতিষ্ঠানের রূপ, গন্ধ, বর্ণ, থাকবে কিন্তু তা কোনওভাবেই আপনার নিজস্বতাকে ছাপিয়ে যেতে পারে না। ফলত, আমি নিজের মতো রাস্তা খুঁজেছি। রুদ্রবাবু, শিক্ষার মধ্যে যে সকল ছন্দ, বোঝাতে চেয়েছিলেন, তার সত্যতাকে বুঝে, পুণর্নির্মাণ করেছি, আমার মতো। ছন্দপতন কি ঘটেনি? ঘটেছে, আমি ফের উঠে দাঁড়িয়েছি।
একটা সময় পর্যন্ত, আমি ছাত্র, আর উনি শিক্ষক হিসেবে অভিনয় করেছি। তারপর একটা সময় এল, যখন মঞ্চে আমি এবং রুদ্রবাবু দু’জনেই ছাত্র। সামনে তামাম দর্শক আর উনি আমাকে সহঅভিনেতা হিসেবে জরিপ করে চলেছেন। শুধু তাই নয়, দর্শকের প্রতিক্রিয়ায়, গ্রহণ এবং বর্জনের মাঝে, আমায় চোখে-চোখে রাখছেন, দেখছেন, বুঝে ফেলছেন। এটাও ছিল আমার কাছে এক অন্য প্রকারের শিক্ষা। মঞ্চাভিনয়ের মধ্যে এই যে উঁকি মারা, ঘাপটি মেরে থাকা পাঠ্যগুলো, আমি শিখেছি। সেই সময়গুলোতে মঞ্চে এক অদ্ভুতখেলা চলে। মঞ্চ, ক্লাসরুমের পরীক্ষা নয়। শিক্ষক-ছাত্র দু’জনেই পরীক্ষা দিতে হয়।
এই ক’দিন আগেই এমন এক ঘটনা আবরও ঘটল। ‘মাধবী’ নাটকে আমরা একসঙ্গে অভিনয় করলাম। নব্বইয়ের এক প্রশস্ত যুবক, অভিনয় করলেন আমার সঙ্গে। রুদ্রবাবু আমার শিক্ষক, তবে প্রশ্নপত্র দিলেন না। আমি ছাত্র, কিন্তু উত্তর আমারও অজানা। দু’জনেই দাঁড়িয়ে দর্শক নামক প্রশ্নপত্রের মুখোমুখি। এ ঘটনা বিরল নয়, এমনটা অনেকবার ঘটেছে। প্রতিবারই এই ঘটনা পরমপ্রাপ্তির!
বহু যুগ আগে আমি ‘ফুটবল’ নাটকে রুদ্রবাবুর সঙ্গে অভিনয় করি। সেই শুরুর সময়ে, আমার বয়স ছিল সাড়ে একুশ। প্রায় এক বছর অর্থাৎ সাড়ে বাইশে প্রথম মৌলিক নাটকে আমি অভিনয় করি। ‘শেষ সাক্ষাৎকার’। নাটকে পাঁচটি মাত্র চরিত্র। অভিনয়ে, আমি, গৌতম হালদার, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত এবং পার্থপ্রতিম দেব। ‘শেষ সাক্ষাৎকার’ ছিল অসামান্য নাটক। রুদ্রবাবুর বিরাট বিরাট সংলাপ ছিল। চলেছে তো চলছেই। আমার চরিত্রটির নাম ছিল ডক্টর চৌধুরি। আমার তখন বাইশ হলেও চুলে জিঙ্ক অক্সাইড ব্যবহার করে, পাক ধরিয়ে, বছর পঞ্চাশ-পঞ্চান্নর হয়ে উঠতাম। আর উনি চরিত্রের বয়স অনুযায়ী, চুল খানিক কালো রং করতেন। নাটকের একাংশে, রুদ্রবাবু আমাকে বলতেন, ‘ডক্টর চৌধুরি, আমরা তো কাছাকাছির বয়সের হব’। এই সংলাপট শোনামাত্রই ভিতর ভিতরে এক অদ্ভুত মজা হত।
আজ রুদ্রবাবু একানব্বইয়ে পা দিলেন। আর আমি এখন ষাট। দু’জনেই আজ দেশের প্রবীণ নাগরিক। মাঝে আমাদের তিরিশ বছরের ফারাক। তাও পিছনে ফিরে তাকাতে মনে হয়, আমার ছাত্রাবস্থা ঘুচল না, রুদ্রবাবু আমার শিক্ষক হয়ে রইলেন। ওঁর মধ্যেও রয়েছে ছাত্র অনুসন্ধিৎসু মন, নাহলে নব্বইয়ের প্রাক্কালে, মঞ্চে দাঁড়াবার জন্য কেউ এতটা উদগ্র হয়ে ওঠেন!
আজ আমার শিক্ষকের জন্মদিন (Rudraprasad sengupta Birthday)। সকাল থেকেই মনে পড়ছে জীবননান্দ দাসের কবিতার কিছু পংতি
‘আমিও তোমার মতো বুড়ো হবো— বুড়ি চাঁদটারে আমি
করে দেবো কালীদহে বেনোজলে পার;
আমরা দু’জনে মিলে শূন্য ক’রে চ’লে যাবো জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার’