শেষ আপডেট: 31st May 2024 17:11
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
'তোমার ঠোঁট আমার ঠোঁট ছুঁলো
যদিও এ প্রথমবার নয়,
চুম্বন তো আগেও বহুবার
এবার ঠোঁটে মিলেছে আশ্রয়।
যেমন সব ভয়ের গল্পে-
দৈত্য দানো-রাক্ষস আর ক্ষয়,
তিলে তিলে শুকোয় রাজকুমারী
অন্ত্যঃমিলে রাজপুত্রের জয়।'
সুজাতা গঙ্গোপাধ্যায়ের এই কবিতা ঋতুপর্ণ ঘোষের 'দোসর' ছবিতে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে আজও। কবিতাটির শব্দচয়নে রয়েছে সাহস যৌন আবেদন, আছে আশ্রয়ও।
'দোসর' ঋতুপর্ণর সাদা-কালো ছবি। স্বর্ণযুগের সাদা কালো ছবির নস্ট্যালজিয়া আনতেই ঋতুপর্ণ এভাবে ছবি তৈরি করেন। অনীক দত্তর 'অপরাজিত' ছবির অনেক আগেই ২০০৬ সালে ঋতুপর্ণ ঘোষের 'দোসর' সাদা কালোতে রিলিজ করে। বক্সঅফিসেও ছবিটি ভাল চলেছিল।
ছবির নায়ক কৌশিক চট্টোপাধ্যায়ের চরিত্রে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় আর কৌশিকের স্ত্রী কাবেরীর চরিত্রে কঙ্কনা সেনশর্মা। কিন্তু কাবেরী চরিত্রে ঋতুপর্ণর প্রথম পছন্দ কঙ্কনা সেনশর্মা ছিলেন না। প্রসেনজিতের বিপরীতে কাবেরী চরিত্রে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তকে ভেবেছিলেন ঋতুপর্ণ। কিন্তু ততদিনে ভেঙে গেছে দুজনের জুটি। প্রায় মুখ দেখাদেখি বন্ধ দুজনের । বুম্বা-ঋতু জুটির ম্যাজিক সাদা-কালোতে পর্দায় এনে স্বর্ণযুগের উত্তম-সুচিত্রার মাদকতা আনতে চেয়েছিলেন ঋতুপর্ণ।
দোসরের গল্প ছিল পরকীয়া কেন্দ্রিক। অফিসের সহকর্মী মিতার (চান্দ্রেয়ী ঘোষ) সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে কৌশিক। মিতা আর কৌশিকের অভিসার বেআব্রু হয়ে যায় গাড়ি দুর্ঘটনায়। এটা দিয়েই আখ্যানের শুরু। চিত্রনাট্য লেখার সময় প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণাকে ভেবেই ছবির প্লট ভেবেছিলেন ঋতুপর্ণ। অথচ তখন আর একসঙ্গে ছবি করছেন না প্রসেনজিৎ ঋতুপর্ণা। ঋতুপর্ণ ভেবেছিলেন অন্য পরিচালকের প্রস্তাব এই জুটি নাকচ করে দিলেও তাঁকে ফেরাতে পারবেন না তাঁরা। কিন্তু ঋতুপর্ণার তরফ থেকে 'না' উত্তরই এসেছিল। প্রসেনজিৎ কিছুটা গললেও ঋতুপর্ণা গলেননি। যে ঋতুদার হাত ধরে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন ঋতুপর্ণা তাঁর প্রস্তাবও ফিরিয়ে দেন। আসলে নিজের আত্মমর্যাদাবোধকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন নায়িকা। এর আগে ঋতুপর্ণর 'উৎসব' ছবিতে স্বামী-স্ত্রীর জুটিতে দেখা গেছিল এই জুটিকে।
শুধু তাই নয় একবার ঋতুপর্ণা জানিয়েছিলেন "আমার বিয়ের কার্ড ঋতুদার হাতে তৈরি। বিয়ের দিন সবাই যে চন্দন আমার কপালে দেখেছিলেন সেটাও ঋতুদা নিজে পরিয়ে দিয়েছিলেন, আমার বেনারসির পাড়ের সঙ্গে মিলিয়ে। অদ্ভুত প্রাণবন্ত একটা মানুষ। দ্রুত সবাইকে ভালবেসে ফেলতেন। আপন করে নিতেন। এখনও ঋতুদার ছবি ‘উৎসব’ নিয়ে আমার আমেরিকা ভ্রমণ কিছুতেই ভুলতে পারি না।"
কেন 'দোসর' এর নায়িকা হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ঋতুপর্ণা? তাঁর কথায় "বাণিজ্যিক ধারার ছবি থেকে আর্ট ফিল্ম ধারার ছবিতে ঋতুদার হাত ধরেই আমার আসা। ঋতুদার পরিচালনায় ‘দহন’ আমার প্রথম ছবি। প্রথম ছবিতেই জাতীয় পুরস্কার! ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয় আজও। নিজে হাতে গড়েপিটে নিয়েছেন তো আমায়। দোসর’-এ অভিনয়ের জন্য ডেকেছিলেন। আমি পারিনি। আজও হাত কামড়াই তার জন্য। একটা ছবি করবেন ঠিক করেছিলেন দেব, প্রিয়াংশু চট্টোপাধ্যায় আর আমাকে নিয়ে। সেটাও শেষ পর্যন্ত আর হল না। তার পরেই শেষের সে দিন! বাকিদের সঙ্গে আমিও ছিলাম। নিজের হাতে সাজিয়ে দিয়েছিলাম ওঁকে। সেই চন্দন পরিয়েই।"
আসলে দোসর ঋতুপর্ণা তখন করেননি তার মূল কারণ কোনভাবেই কাছাকাছি আসতে চাননি দুই তারকা। বরফ গলেনি এতটুকু। একসাথে কাজ করতে হবে দীর্ঘ সময় যে কারণেই দোসর ফিরিয়ে দেন অভিনেত্রী। বহু অভিনেত্রী দেখার পর একবার 'চোখের বালি' র বিনোদিনী চরিত্রেও ঋতুপর্ণাকে ভেবেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। ওই রকম ক্লাসিক ছবিও প্রসেনজিতের কারণে ঋতুপর্ণা নাকচ করে দিয়েছিলেন। ঋতুপর্ণর প্রলোভনে পা দেননি অভিনেত্রী।
শেষ অবধি ২০১৬ সালে ঋতুপর্ণর এক সময়ের সহকারী শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরেই প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা জুটি 'প্রাক্তন' ছবি দিয়ে পর্দায় ফেরেন। মাঝের মান অভিমান কাটিয়ে ফের একসঙ্গে ছবি করছেন দুজনে। আগামী ৭ই জুন দুজনের জুটির ৫০তম ছবি আসছে। শহরে সিঙ্গল স্ক্রিনের সঙ্গে মাল্টিপ্লেক্সে রিলিজ করে এখন বাংলা ছবি, এখন বাংলা ছবিকে ঘিরে অনেক প্রমোশন হয়, রাস্তার দেওয়ালে গঁদে আটার ছবির পোস্টার বা খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনের থেকে ফেসবুক টুইটারেই এখন ছবির প্রমোশন হয় বেশি। টালিগঞ্জ পাড়া এখন টলিউড হয়েছে। শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, নন্দিতা রায় বা কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত ধরে প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা পর্দায় ফিরছেন। মিটে গেছে সব মান-অভিমান। শুধু ঋতুপর্ণ নেই। শূন্যতা শুধু এখানেই। ৩০শে মে বার বার আসে, ঋতু যায় ঋতু আসে, শুধু ঋতুপর্ণ ফেরেন না।