
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ক্লাসিক উপন্যাস ‘দেবী চৌধুরাণী’। প্রফুল্ল, সমাজ-সংসারে লাঞ্ছিত গরিবের মেয়ে, যার শুধু রূপের জোরে বিয়ে হয়েছিল ইংরেজদের পদলেহনকারী জমিদারের ছেলের সঙ্গে। কিন্তু প্রফুল্লর নিচু জাত। এটাই তাঁর অপরাধ। শ্বশুরের চাহিদা মাফিক উঁচু জাত নয় বলেই, হতদরিদ্র ঘরের মেয়ে বলেই প্রফুল্লর ঠাঁই হয়নি স্বামী ব্রজেশ্বরের ঘরে। স্বামীর ঘরে এসেছে আরও দুই পক্ষ। সতীনদের বাপের বাড়িও বড়লোক। তাই তাঁদের মেয়েদের কদর শ্বশুরবাড়িতে অনেক বেশি। শেষ অবধি প্রফুল্লর শ্বশুর তাকে এক বস্ত্রে তাড়িয়ে দিয়ে বলে “চুরি করে হোক, ডাকাতি করে হোক, যা করে পারো খাও”। শ্বশুরের অপমান যেন দৈববাণীর মতো ফলে যায় প্রফুল্লর জীবনে। ডাকাত-সর্দার ভবানী পাঠকের হাতে পড়ে প্রফুল্ল। প্রফুল্লকে পাঁচ বছর নানা অস্ত্রবিদ্যার অনুশীলন দিয়ে ডাকাতরানি করে তোলেন তিনি। প্রফুল্লর নতুন নামকরণ হয় দেবী চৌধুরাণী। যিনি দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন করা দেবী, অথচ সমাজ যার ভয়ে কাঁপে। ইংরেজ সাহেবরা তো বটেই, একদিন সেই দেবীর পায়েই এসে পড়তে হয় তাঁর শ্বশুর স্বামীকেও।
দেবী চৌধুরাণী বলতেই বাঙালিদের চোখের সামনে একটাই মুখ সামনে ভেসে ওঠে। তিনি সুচিত্রা সেন। এ মুখের বিকল্প হয়না। সত্যজিৎ রায় সুচিত্রা সেনের বিকল্প খুঁজে পাননি বলে আর চলচ্চিত্র-রূপ দেননি ‘দেবী চৌধুরাণী’। কিন্তু ২০০৭ সালে ঋতুপর্ণ ঘোষ নিয়েছিলেন এক বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত। ‘দেবী চৌধুরাণী’ ছবি করতে চেয়েছিলেন ঋতুপর্ণ এবং দেবীর নামভূমিকায় ক্যাটরিনা কাইফ ছিলেন তাঁর পছন্দ। ছবির প্রথম কিস্তির পাকা কথাও হয়ে যায়।বঙ্কিম-কাহিনি নিয়ে প্রথম বাংলা ছবি ‘দেবী চৌধুরাণী’ হয় ১৯৩১ সালে। পরিচালক প্রিয়নাথ গঙ্গোপাধ্যায়। দেবীর নামভূমিকায় অনুপমা দেবী। পরবর্তীকালে ১৯৪৯ সালে দ্বিতীয়বার মুক্তি পেয়েছিল বাংলা ছবি ‘দেবী চৌধুরাণী’। এবার প্রফুল্ল ওরফে দেবী চৌধুরাণীর নামভূমিকায় সুমিত্রা দেবী এবং নায়ক ব্রজেশ্বরের ভূমিকায় প্রদীপ কুমার।
এইসব ছবির প্রিন্ট নষ্ট হয়ে যাবার দরুণ চলে গেছে বিস্মৃতির অতলে।
ষাটের দশকে ‘দেবী চৌধুরাণী’ ছবি করবেন ভাবেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়। তাঁর চোখের সামনে ভেসে ওঠে দেবী চৌধুরাণী রূপে একটাই মুখ, তিনি সুচিত্রা সেন। কিন্তু দুজনের মতবিরোধে সে ছবি আর বাস্তবায়িত হয়না। সুচিত্রা সেনকে ছাড়া ‘দেবী চৌধুরাণী’র চলচ্চিত্ররূপ দেবেননা বলে ঠিক করে ফেলেন সত্যজিৎ রায়।সত্তর দশকে সুচিত্রা সেন নিজের গরজেই ‘দেবী চৌধুরাণী’ হন দীনেন গুপ্তর ছবিতে। সে ছবি সুপার ডুপার হিট করে সুচিত্রা মাদকতায়। সত্যজিৎ-স্পর্শে সুচিত্রা সেন দেবীরূপে হয়তো আরও বেশি ক্লাসিক হতেন, তবু দীনেন গুপ্তর ছবিটিও ভালো সাফল্য পেয়েছিল। ঐ ছবিতে দেবী চৌধুরাণী রূপে সুচিত্রা সেনকে দেখে মুগ্ধ বাঙালির মনে আজীবন দেবী হয়ে রয়ে গেলেন মিসেস সেন।
সত্যজিৎ রায় সুচিত্রা সেনকে ছাড়া যে ছবি আর ভাবতেই পারেননি, বিট্রিশ সুন্দরী ক্যাটরিনা কাইফকে নিয়ে সেই ‘দেবী চৌধুরাণী’ করবার সিদ্ধান্ত নেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। সেটা ২০০৭ সাল। ঋতুপর্ণ ক্যাটরিনাকে ‘দেবী চৌধুরাণী’ ভেবেছিলেন একদম অন্য লুকে। যার সঙ্গে হয়তো কোনও মিলই থাকত না বাঙালির দেখা সুচিত্রা সেনের সাজপোশাকের। সমাজে লাঞ্ছিতা কোমল সরল মেয়ে প্রফুল্লর ডাকাতরানিতে উত্তরণ একদম অন্য আঙ্গিকে দেখাতেন ঋতুপর্ণ। যে মেয়ে কিনা যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে মাথা মুড়িয়ে ভিড়ে যায় ডাকাতদের দলে। লাঠিখেলা থেকে ছোরাখেলা, বা ঘোড়সওয়ার- সবেতেই যে মেয়ে পারদর্শী। যেন সে ‘লৌহমানবী’। ইংরেজদের বন্দুকের নল পদানত হয় দেবী চৌধুরাণীর জয়ধ্বনির কাছে।
লন্ডন ফ্যাশন উইকের মডেল ক্যাটরিনা কাইফ তখন সদ্য কয়েক বছর বলিউডে এসেছেন। ক্যাটরিনাকে বলিউডে নিয়ে এসেছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা কাঈজাদ গুস্তাদ ২০০৩ সালে তাঁর ‘বুম’ ছবিতে। ‘বুম’ ছবিতে অমিতাভ বচ্চন, জিনাত আমনের মতো নামের কাছেও ম্লান হননি ক্যাটরিনা। বরং প্রথম ছবিতেই নিজের আবেদনে মাত করেন কাইফ সুন্দরী। যদিও ‘বুম’ সুপার ফ্লপ করে, তবু ছবির উপস্থাপনা ছিল সাহসী। এরপরই অমিতাভ-পুত্র অভিষেক বচ্চনের গার্লফ্রেণ্ড রূপে ‘সরকার’ ছবিতে শিরোনামে উঠে আসেন ক্যাটরিনা। আর তাঁকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।ঐশ্বর্যর সঙ্গে প্রেম ভেঙে যাওয়ার পর সলমন খান তখন জীবনের মানে খুঁজে পেয়েছিলেন ব্রিটিশসুন্দরী ক্যাটরিনার কাছেই। সলমন-ক্যাটরিনা প্রেমের জল্পনা-কল্পনায় ভেসে গেছিল আপামর ভারতবাসী। সেসময় সলমন খানের বাহুলগ্না হয়ে এই মেয়েই বলেছিল তামাম ভারতকে ‘জাস্ট চিল’।
রুপোলি পর্দায় একদিকে অক্ষয় কুমার, অন্যদিকে গোবিন্দা সবার সাথেই ডান্স ফ্লোর মাতিয়েছেন ক্যাটরিনা। ক্যাটরিনার জন্যই যেন সলমন খান আজও রয়ে যেতে পারেন চিরকুমার। আবার বয়সে ছোট ভিকি কৌশলকে সাত পাকের আঁচলে বাঁধতে পারেন ক্যাটরিনাই।ঋতুপর্ণ ঘোষ তখন সদ্য শেষ করেছেন তাঁর ইংরাজি ছবি ‘দ্য লাস্ট লিয়ার’। অভিনয়ে অমিতাভ বচ্চন, প্রীতি জিন্টা, অর্জুন রামপালের মতো বলিউড স্টাররা। যদিও ছবি সে অর্থে চলেনি। ঋতুপর্ণ পরে বলেছিলেন “ওটা একটা মাল্টিস্টারার টেলিফিল্ম বানিয়ে ফেলেছিলাম।” যাই হোক, ছবির ভাবনা ছিল অনন্য। ২০০৭ সালে ‘দ্য লাস্ট লিয়ার’ মুক্তি পায়। এটি একটি প্রাক্তন শেক্সপিয়রিয়ান থিয়েটার অভিনেতার জীবনের গল্প। শম্ভু মিত্র ও উৎপল দত্তকে নির্ভর করে ঋতুপর্ণ বানান এই ইংরাজি ছবি।
এই ছবি থেকেই অর্জুন রামপালের সঙ্গে ঋতুপর্ণর বন্ধুত্ব শুরু। এই ছবির পরপরই ঋতুপর্ণ ঘোষণা করেন তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দেবী চৌধুরাণী’ করবেন ভেবেছেন। ছবিতে দেবী চৌধুরাণীর ভূমিকায় ক্যাটরিনা কাইফ এবং নায়ক ব্রজেশ্বরের চরিত্রে অর্জুন রামপাল। ভবানী পাঠকের চরিত্রে কমল হাসান। ঋতুপর্ণর নির্দেশনায় ছবির প্রযোজক অর্জুন রামপাল স্বয়ং। তখনও ক্যাটরিনা ‘জারা জারা টচ্ মি’ বা ‘চিকনি চামেলি’, ‘কমলি’ নাচে ঝড় তোলেননি। ছিলনা তাঁর কোনও স্টারডম, কিন্তু গসিপ সেগমেন্টে ক্যাটরিনা ছিলেন শিরোনামে। ঋতুপর্ণর হাত ধরেই তাঁর অভিনয়সত্তা বিশ্বের দরবারে ছড়িয়ে পড়ত বলাই বাহুল্য। বম্বে-ঘেঁষা কাস্টিং করে নিজের ছবিকে আঞ্চলিক পরিমণ্ডল থেকে বের করতে চাইতেন ঋতুপর্ণ। ততদিনে বচ্চন পরিবারের চারজন স্টার ঋতুপর্ণর ছবিতে অভিনয় করে ফেলেছেন।
ক্যাটরিনা দেবী চৌধুরাণী, এই খবর রটার পর ঋতুপর্ণর স্তুতি খুব একটা হয়নি। বরং বিরূপ মন্তব্যই শুনতে হয়েছিল ঋতুপর্ণকে। হাসির রোলও উঠেছিল। যে ঐতিহাসিক চরিত্রে সুচিত্রা সেনকে দেখেই বাঙালি অভ্যস্ত তাঁর জায়গায় ক্যাটরিনা কাইফকে বড় নগণ্য লেগেছিল দর্শকদের। কেউ কেউ বলেছিল সুচিত্রা সেনের বিকল্প একমাত্র মাধুরী দীক্ষিত। কিন্তু সবটাই অলীক ভাবনার ফসল ছিল। কারণ ছবির শ্যুট তো হয়নি।
ঋতুপর্ণ জানিয়েছিলেন “এ ছবি সর্বভারতীয় দর্শকদের কথা ভেবেই বানাব। বঙ্কিমচন্দ্রের কাহিনির নির্যাস নিয়ে হবে আমার নিজের চিত্রনাট্য, হিন্দি বা ইংরেজিতে। বঙ্কিমসাহিত্যে ব্রজেশ্বর একদমই নগণ্য চরিত্র। কিন্তু আমার ছবিতে ব্রজেশ্বরকেও লিড রোলে রাখব। দেবী চৌধুরাণীর ক্যাটরিনার লুক মিলবেনা সুচিত্রা সেনের সঙ্গে। বরং অনেক লৌহমানবী করা হবে ক্যাটরিনাকে। অনেক বেশি পুরুষালী। দরকারে মাথা মুণ্ডন করেই দেখাব ক্যাটরিনাকে। যে ডাকাতসর্দার ভবানী পাঠকের মতোই। যে পুরুষ ডাকাতদের সঙ্গে অন্তরঙ্গে বহিরঙ্গে কোনও অংশে কম নয়।”
কিন্তু ঋতুপর্ণ ঘোষ এ ছবি আর এগোতে পারেননি। নানা কারণে ছবির কাজ পিছিয়ে যায়। ক্যাটরিনাও ডেট দিতে পারেননি পরে। অন্য ছবি বানানোর কাজে ব্যস্ত পড়েন ঋতুপর্ণ। পরবর্তীকালে ঋতুপর্ণ নিজেই অভিনয় জগতে চলে আসেন এবং পরপর নিজেই অনেকগুলো ছবিতে অভিনয় করেন। এবং শেষ অবধি ২০১৩ তে প্রয়াত হন ঋতুপর্ণ ঘোষ। ক্যাটরিনা ‘দেবী চৌধুরাণী’ হলে কেমন হত সে ছবি সেই উত্তর আর কোনওদিন পাবেননা সিনেপ্রেমীরা ঋতুভক্তরা।
এই ছবি তৈরি হলে কী হত, কতটা বিতর্ক হত সেসব তো পরের কথা। কিন্তু ঋতুপর্ণর ‘দেবী চৌধুরাণী’ হলে ক্যাটরিনা কাইফের ফিল্মোগ্রাফ আরও ক্রমবর্ধমান হত তা বলাই বাহুল্য।