
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

আজ নবজাগরণের পথিকৃৎ রাজা রামমোহন রায়ের (Raja Rammohan Roy) ২৫০তম জন্মদিন। রাজা রামমোহনকে স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল খুব কম মানুষেরই। তৎকালীন সময়ে মনীষীদের কর্মকাণ্ড তো রেকর্ড বা ভিডিও করে রাখার উপায় ছিল না, তাই হাতে আঁকা ছবিতেই রামমোহন রায় আমাদের আদর্শ হয়ে উঠেছেন।


কিন্তু একজন ব্যক্তি পরবর্তীকালে হয়ে উঠলেন রক্ত মাংসের রাজা রামমোহন রায়ের প্রতিকৃতি। তিনি যেন ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে এসছেন রামমোহন রূপে। এমন অবিকল রামমোহন রায় আর কেউ হতে পারেননি, হতে পারবেনও না। তিনি বসন্ত চৌধুরী। বসন্ত চৌধুরী যেন রামমোহন রায়ের আরেক নাম। ঐ ব্রাহ্ম দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্ব, সুপুরুষ শ্রদ্ধামিশ্রিত চেহারা, সাথে আভিজাত্যর মিশেল– এমনটা বসন্ত চৌধুরীই আনতে পেরেছিলেন। আসলে বসন্ত চৌধুরী যতখানি বাঙালি, ততখানি সাহেবও। তাই সবটাই তাঁর হাতের মুঠোয় থাকত।

০১-১০-১৯৬৫। অক্টোবর মাস, পুজোর মরসুম। পুজোর সময় একই দিনে রিলিজ করল পাঁচটা বাংলা ছবি। ‘সুবর্ণরেখা’ , পরিচালনা ঋত্বিক ঘটক। অভিনয়ে মাধবী মুখোপাধ্যায়, অভি ভট্টাচার্য্য। ‘দোলনা’, পরিচালনা পার্থপ্রতিম চৌধুরী। অভিনয়ে তনুজা, নির্মল কুমার, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, মঞ্জু দে। ‘গুলমোহর’, পরিচালনা কার্তিক চট্টোপাধ্যায়। অভিনয়ে বিশ্বজিৎ, বসন্ত চৌধুরী, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। ‘সূর্যতপা’, পরিচালনা অগ্রদূত। ভূমিকায় উত্তম কুমার ও সন্ধ্যা রায়। এবং
‘রাজা রামমোহন’, নামভূমিকায় বসন্ত চৌধুরী। পরিচালনা বিজয় বসু।

সেই সময় সবচেয়ে বেশি চলেছিল ‘রাজা রামমোহন’। ১৩ সপ্তাহরও বেশি সময় ধরে মানুষ দেখেছিল এই ছবি। সে যুগে জীবনী ছবি অনেক হলেও, ‘রাজা রামমোহন’-এর বক্সঅফিস কালেকশন সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিল। এমনকি উত্তম কুমারের ছবিকেও বক্সঅফিসে হার মানায় এই ছবি।

জাতীয় পুরস্কার মঞ্চেও ‘রাজা রামমোহন’ সেরা বাংলা ছবির শিরোপা পায় এবং বিএফজেএ-তে সে বছর সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান বসন্ত চৌধুরী। ছবিতে ‘রাজা রামমোহন’ রূপে বসন্ত চৌধুরী যেসব শাল গায়ে দিতেন, সেসব দুষ্প্রাপ্য শাল ছিল ওঁর নিজের কালেকশন।
‘রাজা রামমোহন’ ছবির পরিচালক বিজয় বসু স্বর্ণপদক পান জাতীয় পুরস্কার মঞ্চে। সোনার মেডেল পাওয়া বিজয় বসুর মতো পরিচালককে না মনে রেখেছে বাংলা ছবির জগৎ, না মনে রেখেছেন দর্শকরা। নেই তাঁর কোনও একটা ছবিও। এই হল প্রাপ্তি তাঁর।

শুধু তাই নয়, বিজয় বসুর আরও একটি জীবনী ছবি ‘ভগিনী নিবেদিতা’ও বেশ আলোড়ন তোলে। নামভূমিকায় অরুন্ধতী দেবী। বসন্ত চৌধুরীকে যেমন রামমোহনের থেকে আলাদা করা যায় না, তেমনই অরুন্ধতীকেও সিস্টার নিবেদিতা থেকে আলাদা চোখে দেখেনি দর্শক। অরুন্ধতী নায়িকা হিসেবে তবু সফল। কিন্তু বসন্ত চৌধুরী নিজেকে পরে আর ভাঙেননি। ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ ছবি দিয়ে বসন্ত আসেন ছবির জগতে। তার পর দেবকী কুমার বসুর ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’ রূপে বসন্ত মেগাহিট ছবি পান কেরিয়ারে। বিষ্ণুপ্রিয়ার ভূমিকায় সুচিত্রা সেন। এরপর বসন্ত-সুচিত্রাকে জুটি করে ‘ভালবাসা’ ছবি দিয়ে একটা সফল জুটি করার চেষ্টা চলে। কিন্তু উত্তম-সুচিত্রা জুটির ‘অগ্নি পরীক্ষা’র কাছে পরাজিত হয় বসন্তর নায়ক ইমেজ। বসন্ত ‘যদুভট্ট’ ছবিতেও প্রশংসিত হন। এরপর ‘রাজা রামমোহন’ দিয়েই বসন্ত চৌধুরী আবার তাঁর স্টারডম ফিরে পান। সঙ্গে আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও একের পর এক পুরস্কার। সে বছর সর্বাধিক আয় করে ‘রাজা রামমোহন’ ছবি। সবার মুখে একটাই নাম বসন্ত চৌধুরী।

১৯৬৫ সালে একদিন উত্তমকুমার স্তাবক পরিবৃত্ত হয়ে বসে আছেন ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতে। স্তাবকরা গুরু-গুরু বলে উত্তমকুমারের জয়ধ্বনি করছে। কেউ দাদা বলে উত্তমের স্তব করছে প্রতি কথায়। এরা সবাই এসেছেন নিজেদের কোনও না কোনও ধান্দায়। তাঁদেরই মধ্যে একজন বলে উঠলেন, ‘কী যে আজকাল রাজা রামমোহন বলে বসন্ত চৌধুরীকে নিয়ে লোকে নাচানাচি করছে। ঐ রামমোহনের রোলটা দাদা তুমি করলে আরও ভাল করতে। উত্তমকুমার রামমোহন করলে আরও সুপারহিট হত ছবি।’

উত্তমকুমার অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, ‘তোমরা কী ভেবেছো বলো তো! আমাকে যা বোঝাবে আমি তাই বুঝব? বসন্তর অভিনয় আমি দেখেছি ‘রাজা রামমোহন’ ছবিতে। ওঁর মতো আমি পারতামই না। আমার রোম্যান্টিক ইমেজ বাধা হয়ে দাঁড়াত রামমোহন হতে। আহা বসন্তর মতো কণ্ঠস্বর আর আভিজাত্য যদি আমি এক কণাও পেতাম!’ এই বলে ঘর ছেড়ে উঠে গেছিলেন সেদিন উত্তমকুমার। এই স্তাবকদের তিনি না পারতেন ফেলতে, না পারতেন গিলতে। কিন্তু প্রিয় বন্ধু বসন্তর হয়েই সেদিন উত্তমকুমার রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।

উত্তমকুমার সম্পর্কে বসন্ত চৌধুরী বলেছিলেন, ‘উত্তমকে আমি আমার বন্ধুই মনে করি। প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। ও নিজেকে ঘষেমেজে যেভাবে খ্যাতির মধ্যগগনে পৌঁছেছে, তা তুলনাতীত।’

দর্শকের কাছে রোম্যান্টিক নায়কের বাইরে মণীষী হয়ে বসন্ত চৌধুরী পেয়ে যান অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা আর সম্মান। মনীষীদের চরিত্রে যৌনতা যেমন জায়গা পায় না, তেমনি বসন্ত চৌধুরীর সঙ্গেও প্রেম-যৌনতা এসব কখনও খাপ খায়নি, এই ইমেজ বসন্ত চৌধুরী আজীবন বহনও করেছেন। উত্তম কুমারের সঙ্গে করা ছবিগুলিতে বসন্ত ধরে রেখেছেন তাঁর নিজের আভিজাত্য। তাই বোধহয় যত অভিনেত্রী সব উত্তমকুমারেরই প্রেমে পড়েছেন, বসন্ত চৌধুরীকে প্রেমিক ভেবে পেতে চাননি কেউই। কারণ বসন্ত চৌধুরী মানেই যে রামমোহন, চৈতন্যদেব, ভবানী পাঠক, নিধু বাবু (রাজেশ্বরী সিরিয়ালে), যার কাছে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়, প্রেম করা যায় না।

‘অপরাজিত’য় জিতু কোথায়, এ তো সত্যই সত্যজিৎ! সাদা-কালোয় শ্রেষ্ঠ রূপকথা আঁকলেন অনীক