'আনন্দ' সিনেমার গল্প লেখা হয় রাজ কাপুর ও উত্তম কুমারকে ভেবেই
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
আনাড়ি (১৯৫৯) ও আশিক (১৯৬১)-- এই দু'টি ছবিতে একসঙ্গে কাজ করার পরে অভিনেতা রাজ কাপুর ও পরিচালক হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের মধ্যে একটা সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ সখ্য গড়ে ওঠে। হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় ছিলেন সেযুগে বম্বের প্রথম সারির বাঙাল
আনাড়ি (১৯৫৯) ও আশিক (১৯৬১)-- এই দু'টি ছবিতে একসঙ্গে কাজ করার পরে অভিনেতা রাজ কাপুর ও পরিচালক হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের মধ্যে একটা সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ সখ্য গড়ে ওঠে। হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় ছিলেন সেযুগে বম্বের প্রথম সারির বাঙালি পরিচালক, যিনি নয়ের দশক অবধি বলিউডে ছবি করে গেছেন এবং একটা বাঙালি সেন্টিমেন্টকে জড়িয়েই যাঁর ছবির ঘরানা হত। তাই বাঙালি সংস্কৃতি কতটা সমৃদ্ধ তা হৃষীদা বোম্বের লোকেদের দেখিয়ে দেন তাঁর প্রতিটি ছবিতে। শিল্পী নির্বাচনেও হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের একটা বাঙালি সেন্টিমেন্ট সবসময় কাজ করত।
রাজ-হৃষী বন্ধুত্ব প্রগাঢ় হওয়ার মধ্যেই রাজ কাপুর ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন হঠাৎই। তাঁর জীবন-মরণ টানাপড়েন চলতে থাকে এবং রাজের এই অসুস্থতাকে নিয়ে দুই বন্ধুর একটি গল্প লিখে ফেলেন হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়। বন্ধু-সহকর্মীদের প্রার্থনায় সে যাত্রায় রাজ কাপুর আরোগ্যলাভ করেন।
[caption id="attachment_286488" align="aligncenter" width="640"] রাজ কাপুরের স্কুটারে হৃষীকেশ।[/caption]
এর পরপরই, ১৯৬২ সালে হৃষীকেশ মুখার্জী সেই দুই বন্ধুর গল্প নিয়ে একটি বাংলা ছবি করার পরিকল্পনা করেন। ছবির প্রযোজক ছিলেন নেপাল দত্ত ও অসীম দত্ত (প্রিয়া সিনেমার মালিক)। পরে অসীম দত্ত ও নেপাল দত্ত সত্যজিৎ রায়ের বেশ কিছু ক্লাসিক ছবির প্রযোজনা করেন পূর্ণিমা পিকচার্স ও প্রিয়া ফিল্মসের ব্যানারে যেমন 'গুপি গাইন বাঘা বাইন', প্রতিদ্বন্দ্বী', 'অরণ্যের দিনরাত্রি' প্রভৃতি।
হৃষীকেশ মুখার্জী তাঁর এই বাংলা ছবির নাম রাখেন 'আনন্দ সংবাদ'। রাজ কাপুর হৃষীকেশ মুখার্জীকে 'বাবুমশাই' বলে ডাকতেন, তাই রাজের মুখে ছবিতে সেই ডাকটাই রাখবেন ভাবেন হৃষীকেশ মুখার্জী। তবে শুধু রাজই নয়। ছবিতে আর এক নায়কেরও দরকার ছিল। আর সেই অভিনেতার জন্য হৃষীকেশ ও রাজ উভয়ই ভাবেন বাংলার উত্তম কুমারের নাম।
[caption id="attachment_286490" align="aligncenter" width="1024"] হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়[/caption]
ছবির কাস্টিং হয় উত্তমকুমার, রাজ কাপুর ও ওয়াহিদা রহমান। ছবির একটি পোস্টারও প্রকাশিত হয় 'আনন্দ সংবাদ' নামে, রাজ কাপুর এবং উত্তম কুমারের ছবি দিয়ে। বাংলা ছবি হিসেবেই মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয় এই ছবির। ছবির পোস্টার বাংলাতেই ছিল। তবে বাংলা ও হিন্দি-- দু'রকম ভার্সন হওয়ার কথাও চলেছিল।
একজন বম্বের রাজা, আর এক জন বাংলার সম্রাট। দুই সুপারস্টার হিরো এক ছবিতে, স্বভাবতই সাড়া পড়ে যায় ছবির পোস্টার মুক্তির সঙ্গেসঙ্গে। বাড়তে থাকে দর্শকদের আগ্রহের পারদ।
কিন্তু অনিবার্য কারণে ছবিটি বন্ধ হয়ে যায়।
হয়তো রাজ কাপুর ও উত্তমকুমারের সম্পর্কে তখন কোনও বাধা ছিল। তাছাড়া উত্তম চিরকালই ভণ্ড স্তাবক পরিবৃত হয়ে থাকতেন, যাঁরা তাঁকে ভুল বোঝাত ঠিক ছবি সাইন না করতে, যে স্তাবকদের বিশ্বাস করে উত্তম বারবার ঠকেছেন, যে কথা মুক্তকণ্ঠে প্রকাশ্যে বলেছিলেন সুপ্রিয়া দেবী।
রাজও এর পরে অন্য ছবির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
অথবা এমন হতেই পারে, শুধুমাত্র লোক দেখানোর জন্যেই পোস্টার রিলিজ হয়েছিল। এই 'আনন্দ সংবাদ' বাংলা ছবিতে একটি গানও রাখা হয়েছিল, 'আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা'। কারণ ছবির সুরকার ঠিক করা হয়েছিল সলিল চৌধুরীকে। অথচ এমন মাল্টিস্টারার ছবি ভেবেও তা বাস্তবায়িত হল না।
যখন রাজ কাপুর ও উত্তমকুমারকে নিয়ে ছবিটা হল না, তখন ষাটের দশকের শেষে হৃষীকেশ মুখার্জী কিশোর কুমার আর মেহমুদকে নিয়েও করতে চেয়েছিলেন এই ছবি। রাজ কাপুরের রোলে ভাবেন কিশোর কুমারকে।
সে সময়ে বম্বের বাড়িতে কিশোর কুমার একজন বাঙালি ইভেন্ট ম্যানেজারের সঙ্গে বাক-বিতন্ডায় জড়িয়ে পড়েন। গানের জলসার পারিশ্রমিক ও অনুষ্ঠান করা নিয়ে ঝামেলা হয় দুজনের মধ্যে। তাই প্রচন্ড রেগে গিয়ে কিশোর কুমার ঐ বাঙালি ম্যানেজারকে বাড়ি থেকে বের করে দেন এবং দারোয়ানকে নির্দেশ দেন কোনও বাঙালি বাবু এলে যেন তাঁকে আর বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া না হয়।
ইতিমধ্যে সেইসময় 'আনন্দ সংবাদ' ছবি নিয়ে কথা বলতে কিশোর কুমারের বাড়িতে হাজির হন বাঙালি পরিচালক হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়। দারোয়ান কিশোর কুমারের আদেশ পালন করতে গিয়ে কিছু ঠিক-ভুল বিচার না করেই তীব্র ভৎর্সনা করে তাড়িয়ে দেন তাঁকে। যার ফলে ভীষণ অপমানিতবোধ করেন হৃষীকেশ মুখার্জী। স্বাভাবিক ভাবেই তিনি কিশোর কুমারকে নিয়ে ছবির ভাবনা বাদ দেন। বন্ধ হয়ে যায় ছবির কাজও।
[caption id="attachment_286496" align="aligncenter" width="720"] কিশোর কুমার ও হৃষীকেশ মুখার্জী।[/caption]
তবে আর একটি ভিন্নমতও শোনা যায়। জানা যায়, একপ্রস্থ নাকি কথা এগিয়েছিল কিশোরকুমারের সঙ্গে। কিন্তু কিশোরকুমার নায়ককে ছবির শেষে মেরে ফেলতে চাননি, বলেছিলেন ছবির শেষ পাল্টাতে। এমনটা চাননি হৃষী।
তাছাড়াও কিশোর পুরো তাঁর পারিশ্রমিক অগ্রিম চেয়েছিলেন, কিন্তু হৃষীকেশ বাবু পঞ্চাশ শতাংশ দিতে রাজি ছিলেন। কিশোর কুমার কিছুতেই রাজি হননি পুরো টাকা না পাওয়া অবধি। শেষ অবধি হৃষীকেশ বাবু ধরে নেন, কিশোর তাঁর আনন্দ নন।
অনেক বছর পর ১৯৭০ সালে হৃষীকেশ মুখার্জী ওই গল্পেই রাজেশ খান্না, অমিতাভ বচ্চন ও সুমিতা সান্যালকে নিয়ে ছবিটি করেন । শেষ অবধি ১৯৭১ সালের ১২ মার্চ মুক্তি পায় হৃষীকেশ মুখার্জীর 'আনন্দ'। ছবির নাম 'আনন্দ সংবাদ' থেকে 'আনন্দ' হয়ে যায়।
রাজেশ খান্নার রোলটি আদতে রাজ কাপুরকে ভেবেই লেখা, রাজ কাপুরের সেই সময়কার অসুস্থতা নিয়ে চিত্রনাট্য এবং অমিতাভ বচ্চনের রোলটি করতেন উত্তম কুমার। ওই রোলটি একজন বাঙালির ছিল। তাই উত্তম কতখানি মানানসই ছিলেন, তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। আর ওয়াহিদার জায়গায় এলেন সুমিতা সান্যাল। সব পরিবর্তন হলেও ছবির সুরকার পরিবর্তন হননি। সেই সলিল চৌধুরীই রাজেশ-অমিতাভ অভিনীত হৃষিকেশ মুখার্জীর ছবির গানে সুরারোপ করলেন এবং 'আনন্দ' ছবির গান যে অবিস্মরণীয় অমলিন সে তো বলার অপেক্ষা রাখে না।
এরও পরে হৃষীকেশ মুখার্জ্জীর 'আনন্দ'র রিমেক হয় মালয়ালাম ছবিতে। আবার আমাদের বাংলা ছবিতেও 'আনন্দ'র রিমেক হয়, অর্ধেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের ছবি 'জীবন'। তাপস পাল নামভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়, মহুয়া রায়চৌধুরী, দেবশ্রী রায়, মাধবী মুখোপাধ্যায়, রবি ঘোষ প্রমুখ। ১৯৮৬ সালের ১৫ অগস্ট মুক্তি পায় ছবিটি। যদিও 'জীবন' ছবিটির কোনও খোঁজ নেই এখন। এই ছবির সঙ্গীত পরিচালকও ছিলেন সলিল চৌধুরী।