কলকাতায় 'অরণ্য'র প্রাচীন প্রবাদ' ছবির প্রচারে এসেছেন মিথিলা। (ছবিঃ ফেসবুক)
শেষ আপডেট: 19th June 2024 22:29
'আলাদা' তো অনেকেই হ'ন। কিন্তু দুই বাংলার অভিনেত্রীদের মধ্যে রাফিয়াত রশিদ মিথিলা একটা গোড়ার জায়গাতেই আলাদা। তাঁর 'অভিনেত্রী' পরিচয়ের বাইরেও একটা বড় পরিচয় আছে। তিনি শিশুশিক্ষা ও শিশুকল্যাণের নানা গঠনমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত ও বাংলাদেশের অন্যতম নামী বেসরকারি সংস্থা 'ব্রাক ইন্টারন্যাশনাল'-এর অন্যতম প্রধান। ওটাই তাঁর পেশা। অভিনয়টা নয়। বরং ভালবাসার জায়গা।
দু'টো ম্যানেজ করেন কী করে?
শুনে প্রায় ভাবনায় পড়ে গেলেন অভিনেত্রী। সদ্য ঢাকা থেকে ঈদের পর ফিরেছেন কলকাতায়। নিজের আগামী ছবি 'অরণ্য'র প্রাচীন প্রবাদ'-এর প্রচারের ফাঁকে মুখোমুখি বসলেন দ্য ওয়ালের সঙ্গে। বললেন, 'ষোলো বছরের বেশি কাজ করছি চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট সেক্টরে। কী করে করেছি? এটাই একটা প্রশ্ন কিন্তু...', থমকে গিয়ে খানিক ভাবেন মিথিলা। বলেন, 'মানে, এটাকে কখনও আমি আলাদা করে দেখিনি। অভিনয়টাও সবসময় আমার সত্ত্বার অংশ হিসেবেই ছিল। বাংলাদেশের টেলিভিশনে নাটক দিয়ে শুরু করেছিলাম। সেখানে সপ্তাহান্তে শ্যুটিং করতাম। মানে, পাঁচদিন অফিস করতাম, দু'দিন শ্যুটিং করতাম। এটা সবাই জানে বাংলাদেশে, মিথিলা আপা উইকেন্ড ছাড়া দিতে পারবে না। যারা আমার সঙ্গে কাজ করতে চায়, তারা সেইভাবেই টাইমটাকে ম্যানেজ করে। এখনও তাই চলে, ছুটির দিন মিলিয়ে-টিলিয়ে কাজ করতে হয়!'
'অরণ্য'র প্রাচীন প্রবাদ' ছবিতে জীতু কমলের বিপরীতে দেখা যাবে মিথিলাকে। পরিচালনায় রয়েছেন ক্রীড়া সাংবাদিক দুলাল দে। মুখ্যত রহস্য গল্প। দুলাল যেমন বললেন, তিনি সচেতনভাবেই একটা গোয়েন্দা গল্প বানাতে চেয়েছেন। বাঙালি মাত্রেই গোয়েন্দা গল্পের প্রতি একটা আকর্ষণ আছে। প্রশ্ন করা গেল, প্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র কে? প্রশ্ন শেষ হবার আগেই মিথিলার ঝটিতি উত্তর, 'শার্লক হোমস'। একটু থেমে যোগ করতে হয়, 'বাংলায় যদি বলেন, তাহলে ফেলুদা। কিন্তু শার্লক হোমস আমার ছোটবেলা থেকে প্রিয়।'
বিপরীতে যখন জীতু রয়েছেন, তখন তো প্রশ্নটা করতেই হয়। অনীক দত্তের ছবিতে 'অপরাজিত রায়' চরিত্রটিতে বকলমে সত্যজিৎ রায়কেই পর্দায় তুলে ধরেছিলেন জীতু। সে ছবি প্রশংসিত হয়েছিল। এবার একেবারে গোয়েন্দার ভূমিকায়। বিপরীতে আপনি। গোয়েন্দা বা রহস্য-রোমাঞ্চ গল্প নিয়ে তৈরি ছবিতে কাজ করতে কি বাড়তি উত্তেজনা থাকে? উত্তর দিতে গিয়ে জীতুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ মিথিলা। 'আসলে জিতুকে খুব মানায়। মানে কী বলুন তো, গোয়েন্দা চরিত্র বলতে আমাদের যেরকম মাথায় আসে, খুব শার্প দেখতে হবে, লম্বা হবে, বডি ল্যাঙ্গোয়েজ ওরকম হবে, জীতুর মধ্যে ওইসব আছে। ওকে খুব মানিয়ে যায়। ও তো দুর্দান্ত অভিনেতা। খুব ভাল লেগেছে।'
ছবির ক্ষেত্রে অবশ্য গোয়েন্দা বা প্রেম বা অ্যাকশন ছবি, এরকম বাছবিছার করেন না মিথিলা। বরং দেখে নেন, তাঁকে কী ধরণের চরিত্র অফার করা হচ্ছে। তার ওপর ভিত্তি করেই ছবি বাছাই করেন তিনি।
কথায় কথায় উঠে এল বাংলাদেশের ছবির কথা। এই মুহূর্তে অনলাইন স্ট্রিমিং-এর কল্যাণে বাংলাদেশের একাধিক ছবি ও ওয়েব সিরিজ পশ্চিমবঙ্গে রীতিমত সাড়া ফেলে দিয়েছে। জয়া আহসান, চঞ্চল চৌধুরীদের ভক্ত বিপুল রয়েছে এপার বাংলাতেও। জিজ্ঞেস করা গেল, দুই দেশের ছবি কতটা আলাদা?
প্রশ্ন শুনে একটু ভাবেন মিথিলা। বলেন, 'ফারাকটা হচ্ছে গল্প বলার ধরণে। বাংলাদেশের ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক বা সামাজিক পটভূমিটা তো একটু আলাদা হয়ে গিয়েছে। গল্পের গঠন, গল্প বলার ধরণেও তাই একটা প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশ একটা সময় ভারতবর্ষের সঙ্গে ছিল। পরে পাকিস্তানের সঙ্গে ছিল, তারপর স্বাধীনতা পেয়েছে। তারপর একটা র্যাপিড উন্নয়ন হয়েছে আমাদের। তাই গল্পগুলোও খানিক আলাদা হয়ে গিয়েছে।' তার মানে কি ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান বা মুক্তিযুদ্ধ বা তারপরের ঘটনার প্রভাব? 'একেবারেই নয়। গত বাহান্ন বছরে যে ভাবে র্যাপিড সামাজিক-আর্থিক উন্নয়ন হয়েছে, সেখানে অনেক মৌলিক গল্প বা জীবনের গল্পগুলো আলাদা হয়ে গিয়েছে। সেটা যারা বাংলাদেশে থেকেছে ওই সময়টায়, তারাই ভাল বলতে পারবে। যে কারণে বাংলাদেশের গল্পগুলো অনেক বেশি মৌলিক বা নতুন মনে হয়।'
আর কলকাতায়? 'এখানে এখনও পুরনোকে আঁকড়ে ধরার একটা প্রবণতা রয়েছে। এখনও এখানে ফেলুদা, ব্যোমকেশ, মৃণাল সেন, সত্যজিৎ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা ঋত্বিক ঘটককে বর্তমানের প্রেক্ষিতে দেখা হয়। সেটাও কিন্তু এক ধরণের স্বকীয়তা। সেটা এখানে একটু বেশি।'
কিছুদিন আগেই সমাজমাধ্যমে বিপুল আলোড়ন ফেলেছিল বাংলাদেশের ছবি 'হাওয়া'। মেজাবুর রহমান সুমনের এই ছবিতে ছিলেন চঞ্চল চৌধুরী, শরিফুল রাজ, সুমন আনোয়ার-সহ অনেকে। ছিলেন নাজিফা তুষি। সেই ছবি দেখতে নন্দনের বাইরে কার্যত জনতার ঢল নেমেছিল। ছবির 'সাদা সাদা কালা কালা' গান লোকের মুখে-মুখে ফিরেছিল। ওই ছবির সবচেয়ে তাক লাগানো অংশ ছিল তার দৃশ্যায়ন। অনেকে একবাক্যে বলেছিলেন, টালিগঞ্জের ইন্ডাস্ট্রিতে অমন একটি অনবদ্য দৃশ্যায়ন যায় না! এমনটা কেন?
মিথিলা অকপটে বললেন, 'সাদা সাদা কালা কালা তো বাংলাদেশের সমুদ্রে, গ্রামাঞ্চলে নাবিকরা কী করে, সেই সব জীবনের গল্প থেকে এসেছে। বাংলাদেশের পরিচালকদের একবার দেখুন। কেউ বড় হয়েছেন পাবনাতে, কেউ বড় হয়েছে রাজশাহীতে, কেউ চট্টগ্রামে। আশফাক নিপুণ চট্টগ্রামের, রেদোয়ান রনি পাবনার... ওরা তো আসলে পুরো বাংলাদেশের গল্পগুলো জানে। ওরা এখন ঢাকায় থাকে। অথচ এদিকে দেখুন, পশ্চিমবঙ্গের পরিচালকদের সকলেই কলকাতায় জন্মেছেন, কলকাতায় বড় হয়েছেন। এটা কিন্তু আমার একটা পর্যবেক্ষণ। আমি জেনারেলাইজ করতে চাইছি না। কিন্তু আমার এটা মনে হয়েছে...।'
মিথিলার কথায় কিন্তু ভাবনার খোরাক আছে। বাংলা কমার্শিয়াল ছবির দুনিয়ায় কার্যত একা হাতে জোয়ার এনেছিলেন রাজ চক্রবর্তী। তাঁর তৈরি 'চিরদিনই...তুমি যে আমার' ও 'প্রেম আমার', দুটো ছবিরই গল্প ছোট শহরের। বা, ছোট শহর থেকে কলকাতায় আসার গল্প। রাজ নিজে হালিশহরের ছেলে। পরে বলিউডে এই ছোট শহরের গল্প থেকেই একের পর এক সুপারহিট ছবি উপহার দিয়েছেন অমর কৌশিক, লক্ষ্মণ উতেকর, শশাঙ্ক খৈতান। প্রত্যেকেই তরুণ পরিচালক, একেবারে অন্যরকম গল্প বলছেন। মিথিলাও এই দিকটা বললেন। 'বাংলাদেশের এই নতুন পরিচালকদের প্রায় সকলেরই কিন্তু বয়স কম। গড় বয়সটা খেয়াল করুন। পঁচিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে। ভীষণ তরুণ, মাথাভর্তি আইডিয়া গিজগিজ করছে। নুহাশ (হুমায়ূন) যেমন, মাত্র তিরিশ বছরের ছেলে। আবার শিহাব শাহীনের বয়স যেমন পঞ্চাশ। কিন্তু এই যে দু'জন দুই বয়সের, দু'জনের গল্প বলার ধরন কিন্তু আলাদা। এই কলকাতায় যেমন একটা ব্যাপার আছে, প্রথম সারির পরিচালক, দ্বিতীয় সারির পরিচালক, ওখানে কিন্তু এমনটা নেই। লাইনটা অনেক বেশি ধোঁয়াটে।'
ছবির পাশাপাশি সমাজকর্মী ও গবেষক হিসেবে মিথিলার এই মুহূর্তে ব্যস্ততা তুঙ্গে। এই মুহূর্তে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন মিথিলা। এই বছরের শেষে সন্দর্ভ জমা করতে হবে। পাশাপাশি শিশুদের নিয়ে এশিয়া ও আফ্রিকার একাধিক দেশে কাজ করেছেন। 'পূর্ব আফ্রিকার উগান্ডা, তানজানিয়া, দক্ষিণ সুদান, রোয়ান্ডা, কেনিয়া ও পশ্চিম আফ্রিকার সিয়েরা লিওন ও লাইবেরিয়াতে কাজ করেছি। কেনিয়া যেমন বেশ উন্নত। ঢাকার থেকেও হয়ত বেশি ভাল শহর হতে পারে নাইরোবি', বললেন অভিনেত্রী। জিজ্ঞেস করা গেল, ভারতে কি ব্রাকের তরফে বা আপনার কোনও সমাজকল্যাণমূলক কাজের উদ্যোগ রয়েছে? 'পশ্চিমবঙ্গের শিশু সুরক্ষা কমিশনের পত্রিকা রয়েছে 'হুল্লোড়' বলে, আমি কিন্তু তাদের পুজোসংখ্যায় নিয়মিত লিখি। তবে ব্রাক ভারতে এখনও সরকারিভাবে কাজ করে না। আমাদের নিজস্ব কোনও দফতর নেই। কিন্তু ভারত সরকারের সঙ্গে ছোটোখাটো নানা প্রকল্পে কাজ চলছে।'
রাজনীতিতে আসতে ইচ্ছে করে না? পশ্চিমবঙ্গে তো অভিনয় জগতের অনেকেই রাজনীতির সঙ্গে রয়েছেন। বাংলাদেশেও ক্রিকেটারদের অনেকে রাজনীতিতে এসেছেন। আপনি সেখানে সমাজকর্মী। কাজ করেন সাধারণ মানুষের কল্যাণে। মিথিলা হাসেন, 'আমি এইসব থেকে বহু দূরে। আসলে দেশেই বেশিরভাগ সময় থাকি না তো। গরীব মানুষের জন্য কাজ করি, টুকটাক অভিনয় করি, এর বাইরে বেশি কিছু বুঝি না।'
তাহলে কবে আমরা তাঁকে 'ডক্টর' মিথিলা বলে ডাকব? মিথিলা বলেন, 'ওরে বাবা, এই প্রশ্নটা শুনলেই আমার বুকে ব্যথা হয়। মনে পড়ে যায় যে, আমার একটা পিএইচডি আছে এবং সেটা সময়ের জন্য শেষ করতে পারছি না। বসে যে কবে লিখব তাই জানি না। তবে হয়ে যাবে আশা করছি।'