শেষ আপডেট: 23rd September 2023 15:34
ছবি - পালান
শ্রেষ্ঠাংশে- অঞ্জন দত্ত, মমতা শঙ্কর, শ্রীলা মজুমদার, যীশু সেনগুপ্ত, পাওলি দাম, দেবপ্রতিম দাশগুপ্ত
পরিচালনা - কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়
প্রযোজনা- প্রতীক চক্রবর্তী
দ্য ওয়াল রেটিং - ৪/৫
আটের দশকের শুরুতে বিয়ের পর অঞ্জন, মমতাকে জিজ্ঞেস করেছিল "কী চাই তোমার? নিজের ফ্ল্যাট, গাড়ি নাকি শুধুই শাড়ি?"
মমতার উত্তর ছিল "না, না, না!! শুধু চাই একটা ফাই-ফরমায়েশ খাটবার বারো-তেরো বছরের চাকর?"
আর সেই চাহিদামতো মমতার জন্য এসে হাজির হয় গ্রামের কিশোর ছেলে পালান (Palan Movie Review)। মা মরা ছেলের কৈশোরের আনন্দ কেড়ে নিয়েছিল দারিদ্র্য। উনুনের ধোঁয়া থেকে তৈরি কার্বন মনোক্সাইডেই পালানের মৃত্যু হয়েছিল বন্ধ রান্নাঘরে। পালানের বাবা সেদিন তাঁর ছেলের মৃত্যুর জন্য অঞ্জন (Anjan Dutta) আর মমতাকে (Mamata Shankar) দায়ী করেননি। দায়ী করেছিলেন নিজের কপালকে। কিন্তু সেদিনের পর থেকে চার দশক ধরে সারা পাড়ার লোকের কাছে অপরাধীই হয়ে গেছিল অঞ্জন-মমতা।
চার দশক পেরিয়ে গেছে। সাল ২০২২।
খারিজের মতোই পালান ছবির শুরুও বড় রাস্তায় গাড়ির চলাচলের দৃশ্য দিয়েই। চরিত্রদের বাস্তব নামই ছবিতে রাখেন মৃণাল সেন। কৌশিকও বদলাননি। অঞ্জন সেন (অঞ্জন দত্ত) ও মমতা সেন (মমতা শংকর) বৃদ্ধ হয়েছেন। যেখানে পালানের মৃত্যু হয়েছিল অঞ্জন-মমতা সেই বেলতলা রোডের ভাড়া বাড়িতেই থাকেন। ছেলে পুপাই (যীশু সেনগুপ্ত) তাঁর বউ পাওলিকে (পাওলি দাম) নিয়ে কসবার এক অভিজাত ছোট্ট ফ্ল্যাটে থাকেন। ওঁদের এক মেয়ে। ছোট পরিবার সুখী সংসার।
বেলতলার জরাজীর্ণ বাড়ি বহুতল করার জন্য মুখিয়ে রয়েছেন প্রোমোটার। অঞ্জন-মমতার চল্লিশ বছরের প্রতিবেশী বান্ধবী শ্রীলা (শ্রীলা মজুমদার) বিয়ে করেছে এই প্রোমোটারকে। শ্রীলার বাবা-মা মারা গেছে। এক মেয়ে শ্রীলা বরকে নিয়ে ওই বাপের বাড়িতেই থাকে।
পুরনো বাড়ির চাঙড় ভেঙে পড়ে মারা যান নীচের তলার ভাড়াটে বান্টির মা। অঞ্জনের কাছেও নোটিস আসে বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার। ছবির নাম 'পালান' এখানেই সার্থক। প্রোমোটারের চক্রান্তে এতদিনের ভাড়া বাড়ি ছেড়ে পালাতে হচ্ছে অঞ্জন-মমতাকে। পুরসভা বিপজ্জনক বাড়ি ঘোষণা করার পর অঞ্জন-মমতার কানের কাছে বাজছে 'পালান, পালান, পালান...'। পালাচ্ছে সময়, পালাচ্ছে মূল্যবোধ, পালাচ্ছে সম্পর্ক। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের (Kausik Ganguly) ছবি চিরকালই বাস্তব সমাজের কথা এমনভাবে পর্দায় তুলে ধরেন যা দেখে চোখে জল আসতে বাধ্য। মমতা শংকর যখন বলেন "বাইশ বছর বয়সে বিয়ের পর প্রথম এই বাড়িতে এসেই উঠেছিলাম।" শ্রীলা নিজের বর প্রোমোটার সমীরের হয়ে যখন বলেন "সমীর কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে বাড়ি খুঁজছে কিন্তু ভাড়া যা চাইছে তাতে তো ঢাকের দায়ে মনসা বিক্রি হওয়ার জোগাড়।" অঞ্জনের জবাব "ঢাকের দাম কত, শ্রীলা? মনসার দাম কত?"
কৌশিক ছবিতে দুশ্চিন্তা আর যৌনতার অসাধারণ যুগলবন্দি দেখিয়েছেন। কৌশিক দেখিয়েছেন মধ্যরাতে অঞ্জন বারান্দায় বসে আছেন, সেই বারান্দার নীচেই ঝুলছে পুরসভা বিপজ্জনক বোর্ড। আর সেই রাতেই একই সঙ্গে অন্য ফ্ল্যাটে পুত্র-পুত্রবধূ যীশু-পাওলির মধ্যে আদর-আশ্লেষের সম্পর্ক। যীশুর কথায় "বাবা-মা এসে থাকলে এই খাটে কবে আবার শোব? কবে আবার আদর পাব।" দু'প্রজন্মের দুই ধারা। তবে কৌশিক ছবিতে কখনই ছেলে-বৌমাকে ভিলেন করেননি। তাঁরা তাঁদের ছোট্ট ফ্ল্যাটেই বাবা-মাকে রাখতে সবরকম চেষ্টা করেছেন। কিন্তু হাসপাতাল-খাট তাঁদের ফ্ল্যাটে রাখবার জায়গাটুকু নেই। আসল ভিলেন আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা। জায়গার অভাবে আমরা পালাচ্ছি। অঞ্জনের উপলব্ধি "আমার অবস্থাটা একেবারে পালানের মতো! থাকার জায়গা নেই।"
অভিনয় প্রসঙ্গে বলতে 'পালান' ছবির শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি অঞ্জন দত্তর অভিনয়। এই ছবি অঞ্জন দত্তকে ছাড়া হতই না। দার্জিলিং সত্তা খোলস ছেড়ে এক সোজা মেরুদণ্ডর গেরস্থ কর্তার চরিত্রে অঞ্জন অনবদ্য। গোটা ছবিতে তাঁর অভিনয় মুগ্ধ হয়ে দেখতে হয়। অঞ্জন দত্তর সংলাপ "আধুনিক নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির জন্য তৈরি তো? বাবা-মায়ের জন্য কোনও আলাদা লে-আউট নেই!" কিংবা অঞ্জন যখন হাসপাতালের বেডে শুয়ে শ্রীলার অপরাধী চোখের দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকেন, দুরন্ত অভিনয়ের গুণে প্রতিটি দৃশ্য ফুটিয়ে তুলেছেন অঞ্জন। ছবির শেষে প্রোমোটার সমীরের প্রতি সিগারেটের সুখটান দিয়ে অঞ্জনের ঘাড় ঘুরিয়ে সংলাপ "হ্যাঁ বলো?, বুঝিয়ে দেন অঞ্জন সেনের কোমর ভাঙলেও মেরুদণ্ড ভাঙেনি। 'পালান' ছবিতে অঞ্জন কখনও বদমেজাজি, কখনও চিন্তক কখনও শিশুর মতো সরল কখনও আবার ভীষণ ছেলেমানুষি। অঞ্জন দত্তর 'পালান' ছবিতে অভিনয় জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার দাবি রাখে।
গোটা ছবিতে মমতা শংকর অঞ্জনের সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত দিয়ে গেছেন। একেবারেই আটপৌরে চরিত্রে মমতার সহজাত অভিনয় পর্দায় চোখ টেনে রাখে। দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সারা ছবির লাগাম নিজেদের হাতে টেনে রাখলেন এবং ছবিটিকে এক অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিলেন। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবি যেন মৃণাল সেনের ধারাকেই বহন করে নিয়ে গেছে। বহুদিন পর শ্রীলা মজুমদার যোগ্য চরিত্র পেলেন। মৃণাল সেনের তৈরি করা চরিত্রে আবার শ্রীলা। মৃণাল ঘরানা শ্রীলার অভিনয়ে কৌশিকের ছবিতেও এসে পড়েছে। বয়স থাবা বসালেও 'খারিজ'-এর শ্রীলার থেকেও 'পালান'-এর শ্রীলা একটু বেশি গ্ল্যামারাস। যীশু আর পাওলি ছবিতে নতুন চরিত্র। পুপাই ছোট ছিল 'খারিজ'-এ। বড় হয়ে যে যীশু। যীশু যে নিজেকে প্রতিটি ছবিতে নতুন করে আবিষ্কার করার চেষ্টা করছেন দেখলেই বোঝা যায়। আর পাওলি দামের চরিত্রটি কখনও সিক্যুয়েলে বাড়তি মনে হয় না। সে যেন একাত্ম হয়ে গেছে পুরনো চরিত্রগুলোর সঙ্গে। এমন বুঝদার পুত্রবধূই চান সব শ্বশুর-শাশুড়ি। পাওলি ঘরোয়া লুকে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। যীশু-পাওলির মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করা শিশুশিল্পীটি সপ্রতিভ।
আর একজনের কথা না বললেই নয়। যে ছবির আর এক প্রাণশক্তি। 'খারিজ'-এর হরি। 'পালান'-এর মতোই যে ছিল এক কিশোর-পরিচারক। মৃণাল সেনের হরি চরিত্রে অভিনয় করেন দেবপ্রতিম দাশগুপ্ত ওরফে তাজু। 'খারিজ'-এর কিশোর দেবপ্রতিমের অপাপবিদ্ধ মুখ আর সততার চোখ দু'টো ভোলা যায় না। সেই অভিনেতাকেই পালান ছবিতে ফেরালেন কৌশিক। হরি পালানের বন্ধু ছিল। হরির সঙ্গেই পালান শেষ কথা বলেছিল। যুগ পাল্টেছে হরি বড় হয়েছে সে আজ একজন ট্যাক্সিচালক। কিন্তু হরির সততা ভালবাসা ঋজুতা এতটুকু বদলাইনি। তিনি ট্যাক্সি ব্যবসার ক্ষতি করেও রোজ কাকিমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন কাকুর সঙ্গে দেখা করাতে। দেবপ্রতিমকে এভাবেও ফেরানো যায় দেখালেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। এ ছবির অন্যতম সম্পদ দেবপ্রতিমের বলিষ্ঠ অভিনয়। যে চরিত্রটিকে চোখ বন্ধ করে ভরসা করা যায়। পাড়া কালচার আজ বিলুপ্ত আমাদের সমাজে। কিন্তু এই পাড়ার শ্রীলা মাসি হরিদারাই আমাদের বিপদে আপদে পরিবার হয়ে ওঠে। পুলিশ অফিসারের চরিত্রে সমীর সেনগুপ্ত নজর কাড়েন। পাড়া প্রতিবেশীদের বাকি চরিত্রগুলো মনের কোণে রয়ে যায়। নীল দত্তের মিউজিক মন্দ নয়।
তবে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় 'পালান' ছবিতে মৃণাল সেনের 'খারিজ' ছবির কিছু ক্লিপিং নতুন করে পর্দায় ফিরিয়ে আনতে পারতেন। যখন সব চরিত্ররাই তাঁর ছবিতে আছেন। এ প্রজন্মের ক'জন আর মৃণাল সেনের 'খারিজ' দেখেছেন। যদি কৌশিক 'খারিজ'-এর ঝলক দেখাতেন যোগসূত্র করতে সুবিধে হত দর্শকদের। তবে যাঁরা খারিজ দেখেননি তাঁদের কাছে পালান একটি স্বতন্ত্র ছবি হিসেবে ছাপ রাখবে। তবু বলব, মৃণাল সেনের 'খারিজ' দেখে কৌশিকের 'পালান' দেখতে যান। তাহলে প্রতিটি চরিত্রকে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় পরতে পরতে কত সুন্দর করে এঁকেছেন তা বুঝতে পারবেন। মনে রেখাপাত করবেই 'পালান'।
আরও পড়ুন: নীরবে প্রয়াত সত্যজিতের শিল্পমন্ত্রী, তরুণ মজুমদারের শিষ্য অভিনেতাকে মনে রাখেনি প্রায় কেউই