
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
পাহাড়ীদা… (Pahari Sanyal) উত্তমের বন্ধু, স্বজন আবার অভিভাবকও। উত্তম কুমার (Uttam Kumar) ফ্লপমাস্টার তকমা ঘুচিয়ে হিটমেশিন মহানায়ক যে হতে পেরেছিলেন, তার পেছনে ছিল পাহাড়ী সান্যালের অনেক অবদান।
এক সময়ে তাঁর পাহাড়ীদা, পাহাড়ী সান্যালকে নিয়ে স্মৃতিচারণায় উত্তমকুমার বলেছিলেন, “বেণু আমার মানসিকতা বোঝে। আপনাদের সুপ্রিয়া দেবীর ডাকনাম বেণু। সকলেই তাকে এই নামে ডাকে। আমিও ডাকি বেণু বলে।
আমি সুস্থ থাকলে বেণু যেন তৃপ্তিতে ভরে থাকে, আমি অসুস্থ হলে বেণুও যেন অসুস্থ হয়ে পড়ে। বন্ধুর চেয়ে বেণু অনেক বড়। নিজের হাতে রান্না করে না খাওয়ালে যেন তার তৃপ্তি নেই। সেই বেণুই ১০ তারিখের সকালে আমাকে সেই মর্মান্তিক খবরটা দিল।
পাহাড়ীদা আর নেই। পাহাড়ী সান্যাল অপ্রত্যাশিতভাবে চলে গেছেন ৯ ফেব্রুয়ারি, মধ্যরাতে। পরিচিত জগতকে পিছনে ফেলে রেখে। সাল ১৯৭৪।

আমি যখন ‘অমানুষ’-এর শ্যুটিং করতে সুন্দরবনে আসি, তখনও পাহাড়ীদা ‘বিশ্বরূপা’য় বহাল তবিয়াতে থিয়েটার করছিলেন। তিনি যে হঠাৎ কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে যাবেন তা কি তখন জানতাম!
পাহাড়ীদা ছিলেন রসিক বন্ধু আবার আমার অভিভাবকও।
অগণিত ছবিতে আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। পাহাড়ীদা আমাকে তুই-তোকারি করতেন।কতটা আপন হলে একজন আরেকজনকে এই ধরনের সম্বোধন করতে পারে। বেণুর কাছ থেকে সেই পাহাড়ীদার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে আমি সেই মুহূর্তে মূক হয়ে গেছিলাম।“
পাহাড়ী সান্যাল প্রথম জীবনে বাংলা ছবির নায়ক-গায়ক। পাশাপাশি হিন্দি ছবিতেও কাজ করেছেন। মনে পড়ছে ‘দেবদাস’ হিন্দি ছবিতে নিজের কণ্ঠে গান গেয়ে বলিউডে কীভাবে তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এবং চমকে যায় বাংলা। হিন্দি নিজেও ভাল বলতেন এবং সুচিত্রা সেন, উত্তম কুমার, সুপ্রিয়া দেবীদের হিন্দির হাতেখড়ি পাহাড়ী সান্যালের কাছেই।

নিজে নায়কের রোল থেকে সরে এসে পরবর্তীকালে পাহাড়ী সান্যাল একচেটিয়া ভাবে উত্তম-সুচিত্রার পিতা অথবা পিতৃতুল্য চরিত্র করে গেছেন। প্রতিটাই যে স্নেহশীল চরিত্র, তা নয়। বেশিরভাগ পিতার চরিত্রে পাহাড়ী সান্যাল স্নেহময় হতেন কিন্তু যেমন ‘ইন্দ্রাণী’ ছবিতে সুচিত্রা সেনের গোঁড়া ব্রাহ্মণ পিতার চরিত্রে কী কঠিন পাহাড়ী সান্যাল! কন্যার অসবর্ণ বিবাহ মেনে নেন না। ত্যাজ্য কন্যা করেন ইন্দ্রাণী সুচিত্রাকে। আবার ভাবুন, ‘সাত পাকে বাঁধা’য় কী স্নেহশীল পিতা তিনিই। তেমনি ‘শাপমোচন’-এ উত্তমের রক্ষনশীল অন্ধ বড়দার ভূমিকায় অন্য পাহাড়ী সান্যাল। এছাড়াও ‘রাজকুমারী’তে রসিক মামার চরিত্র, ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘হসপিটাল’ ছবির পিতৃসম স্যার ডাক্তার। কিংবা পাহাড়ী অভিনীত আইকনিক চরিত্র ‘বিদ্যাসাগর’, কখনও বা স্বর্গের দুষ্টু-মিষ্টি নারদদেব। পাহাড়ী সান্যালের গানের গলাটিও ছিল খুব মিষ্টি। পাহাড়ী সান্যালের কাছে গান শিখেছেন বহু গুণী শিল্পী।
উত্তম কুমার বলছেন, তাঁর গান শেখার ও ছবিতে আসার প্রেরণা ছিলেন পাহাড়ী সান্যাল ও তাঁর কণ্ঠের গান।
স্বর্ণযুগের ছবিতে ছবি-পাহাড়ি এই দুই পুরুষ কিন্তু ছিল বক্সঅফিস হিট জুটি।
ছবি বিশ্বাস-পাহাড়ী সান্যালের অনেক মজার দৃশ্য থাকত বহু ছবিতে একসঙ্গে। ‘সদানন্দের মেলা’ বা ‘শশীবাবুর সংসার’— আরও কত মন ভাল করা ছবি। মনে পড়ছে ‘বিপাশা’ ছবির কথাও।
শুরুতে যে বেণুর কথা জানলাম, সেই বেণুকে সুপ্রিয়া নাম পাহাড়ী সান্যালই দেন। তার পর থেকেই তিনি আমাদের সুপ্রিয়া দেবী।
এমপি স্টুডিওর ‘মর্যাদা’ সিনেমায় তখন কাজ করছেন উত্তম। তখন একটা রোলের জন্য তাঁকে স্টুডিওর দোরে দোরে ঘুরে বেড়াতে হয়। সিনেমায় অভিনয়ের স্বপ্নপূরণের চেষ্টা এবং ওই সময়েই তখন চলছে গৌরী দেবীর সঙ্গে উত্তমের প্রেম। কদিন পরেই গৌরীর সঙ্গে উত্তমের বিয়ে। আরও এক নতুন স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে। কিন্তু ফ্লপ তকমা তাঁর কপাল থেকে ঘুচছে না।
‘মর্যাদা’ সিনেমায় শ্যুটিং করার সময় উত্তমের সঙ্গে একদিন দেখা করতে এলেন এমপি প্রোডাকশনসের ম্যানেজার বিমল ঘোষ। বিমল বাবু তখন ফিল্ম লাইনে নামী লোক, তাঁর বেশ নামডাক। তিনি উত্তমকে বললেন ‘পাহাড়ী সান্যালের কাছ থেকে তোমার কথা অনেকবার শুনেছি। তুমি আমাদের কোম্পানিতে যুক্ত হতে ইচ্ছুক? আমাদের কোম্পানির ছবিতে বড় রোল করতে ইচ্ছুক?’ উত্তম এককথায় বললেন ‘নিশ্চয়ই ইচ্ছুক’। ভাগ্যের চাকা এইভাবেই ঘোরা শুরু হল উত্তম কুমারের।
বলা বাহুল্য, এই ‘মর্যাদা’ ছবিতে তখন পাহাড়ী সান্যালও কাজ করেছেন। সেই ছবির অন্যতম প্রধান শিল্পীই পাহাড়ী সান্যাল। খুব অল্পদিনের পরিচয় তখন উত্তমের সঙ্গে পাহাড়ী সান্যালের। তবু তিনি নতুন ছেলেটির কথা সবাইকে বলে বেড়াচ্ছেন, যে ছেলেটার চেষ্টা ও প্রতিভা আছে। উত্তম মনে-মনে পাহাড়ীদাকে শ্রদ্ধা না জানিয়ে পারলেন না।

এমপি প্রোডাকশনসের প্রচুর সুপারহিট ছবি দিয়েই উত্তম কুমার হিটের মুখ দেখলেন। ‘বসু পরিবার’, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘যাত্রা হল শুরু’— সব এমপি প্রোডাকশনসের ঘরের ছবি।
‘বসু পরিবার’ ছবিতেও পরিচালক নির্মল দে-কে পাহাড়ী সান্যাল বলেন উত্তমকে নায়ক করতে। নির্মল দে বলেছিলেন কালী ব্যানার্জীকে নায়ক করবেন ‘বসু পরিবার’ ছবিতে। উত্তম ওই ফ্লপমাস্টারকে নিলে তাঁর ছবিতে ঢিল পড়বে। শেষমেশ উত্তমই নায়ক হন পাহাড়ী বাবুর কথায়। ফ্লপমাস্টারও যে সুপারস্টার হতে পারে, বুঝেছিলেন সেদিন পাহাড়ী সান্যাল। সুপারহিট করল ‘বসু পরিবার’। যে ছবিই উত্তমের ভাগ্য খুলে দেয়। এরপর ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবি দিয়েই উত্তম-সুচিত্রা জুটির জয়যাত্রা শুরু।
এর পর কেটে গেছে কয়েক দশক। উত্তম কুমার তখন স্টার মহানায়ক। তাঁকে ঘিরেই চলছে টালিগঞ্জ পাড়া এবং প্রোডাকশান হাউসগুলো। তখন রাধারাণী স্টুডিওতে অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ছবি ‘নতুন জীবন’-এর শ্যুট চলছে। অনুপ কুমার ও সন্ধ্যা রায় নায়ক নায়িকা।একদম শুরুর দিকের শ্যুটিং শুরু হয়েছে।
সে সময়ে রাধারাণী স্টুডিওতে হঠাৎ একদিন উত্তম কুমারের গাড়ি ঢুকল। সবাই তো তাজ্জব! এই ‘নতুন জীবন’ ছবিতে উত্তমকুমার নেই, সেখানে তাঁর গাড়ি ঢুকছে কেন! কেউ তো ভাবতেই পারেননি উত্তম কুমারের আগমনের সংকেত। যে নায়ক মধ্যগগনে, তিনি অকারণে এখানে কেন আসবেন!
পরে বোঝা গেল কারন। উত্তম কুমার পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়কে ডেকে অনুরোধ করলেন, ‘ঢুলু ( অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ডাক নাম) তোমার ছবিতে পাহাড়ীদাকে একটা রোল দাও। পাহাড়ীদার অবস্থাটা খারাপ যাচ্ছে। তাই একটা ভাল রোল দাও। সেটা বলতেই আমি এই ছবির সেটে এলাম।’
অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় উত্তম কুমারের কথা ফেলতে পারেননি। ‘নতুন জীবন’ ছবিতে সন্ধ্যা রায় ও অনিল চট্টোপাধ্যায়ের পিতার চরিত্র দিলেন পাহাড়ী সান্যালকে।
‘নতুন জীবন’ ছবিতে দেখানো হয়েছিল একজন বিত্তবান বিশাল বাড়ির দয়ালু কর্তার চরিত্রে পাহাড়ী সান্যালকে। কিন্তু আদপে তাঁর অবস্থা খারাপ ছিল তখন। হাতে কোনও কাজ ছিল না পাহাড়ী সান্যালের মতো শিল্পীর। ডাক পাচ্ছিলেন না কোনও ছবিতে। পাশে দাঁড়ালেন উত্তম কুমার।
শুধু ‘নতুন জীবন’-এ কাজ দিয়েই ক্ষান্ত হননি উত্তম। নিজের পুত্র-কর্তব্যে উত্তম কুমার এরপর ‘বিশ্বরূপা’-য় পাকাপাকি ভাবে মাস মাইনেতে পাহাড়ী সান্যালের কাজের ব্যবস্থা করে দেন। পেশাদার মঞ্চে যাতে রোজকার অভিনয় করতে পারেন পাহাড়ী সান্যাল।
তখন উত্তম কুমার মধ্যগগনে, সুপারস্টার, কিন্তু তাঁর সহকর্মীদের পাশে দাঁড়াতে তিনি ভুলে যাননি।
একদিন উত্তমকে সিনেমায় সুযোগ করে দেন পাহাড়ী সান্যাল। যাতে উত্তমের ফ্লপের তকমা মুছে দেওয়া সুপারহিট ছবি হয়। সেই উত্তম পাহাড়ী সান্যালের বিপদের দিনেও পাশে দাঁড়ান। যেমন পিতা প্যারামবুলেটরে করে সন্তানকে ঘোরান, হাঁটতে শেখান হাত ধরে, সেইরকম বৃদ্ধ অসহায় পিতা পাহাড়ী সান্যালের হাতটাও পুত্র উত্তম ধরেছিলেন। সেদিন যেন একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হল।
স্টারকিডদের সঙ্গে তুলনা, প্রথম ছবি ফ্লপ, জেদ আর পরিশ্রমেই আজ বড় পর্দার বড় নাম শাশ্বত