
কীর্তন শিল্পী হয়েও কুমার শানুর গান গেয়েছি, এটাও তো বড় চ্যালেঞ্জ: পদ্ম পলাশ
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
শনি-রবি রাত ৯.৩০টা মানেই প্রতিটি বাড়ি থেকে ভেসে আসে একটাই সুর। ‘জি বাংলা সারেগামাপা’ (Zee Bangla Saregamapa) গানের অনুষ্ঠান। জি বাংলা সারেগামাপা ২০২২ রিয়্যালিটি শোয়ের প্রতিটি প্রতিযোগী আজ দর্শকদের মনের মণিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছে। আজ তাঁদের নামগুলোর সঙ্গেও দর্শকদের কত অনুভূতি জড়িয়ে। তাই পছন্দের প্রতিযোগীদের জেতাতে তাঁদের ফ্যানেদের উদ্দীপনার শেষ নেই। কেউ গাইছেন বাংলার প্রাচীন কীর্তন, কেউ বা হার্ড রক সঙ্গীত, কেউ আবার পাহাড়ি গানের সুরে দোলা লাগাচ্ছেন শ্রোতাদের মনে।
তাঁদের এখন সামনেই গ্র্যান্ড ফিনালেতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লড়াই (Saregamapa Finalists)। ছ’মাসের বেশি সময় পার করে, অনেক বাছাইয়ের পরে, ৯ জন উঠেছেন টপ নাইনে। তাঁদের মধ্যেই সকলের প্রিয় ও জনপ্রিয় প্রতিযোগী, কীর্তনসাধক পদ্মপলাশ হালদার (Padma Palash Saregamapa) খোলা মনে আড্ডা (Exclusive Interview) দিলেন ‘দ্য ওয়াল’-এর সঙ্গে।

পদ্ম পলাশ (Padma Palash Saregamapa) নাম এখন খুব চর্চায়। তোমার এমন অভিনব নাম রাখার কারণ?
এটা আমার ঠার্কুদার দেওয়া নাম। নাতি হয়েছে, তাই ভগবত গীতা খুলে পুরাণ থেকে নাম বের করেছিলেন, পদ্ম পলাশ লোচন হরি। এত বড় নাম স্কুলের খাতার জায়গা ধরত না। তাই ছোট করে পদ্মপলাশ নামটাই রাখা হয়েছে। পদ্মপলাশ হালদার।
চাকরি-ব্যবসা না করে কীর্তন গানকে পেশা করেছ। কতটা চ্যালিঞ্জং?
লড়াই তো ছিলই। আমার ঠার্কুদার থেকে এই কীর্তনের ধারাটা শুরু। আধ্যাত্মিক গানের পরিবেশ আমাদের বাড়িতে বরাবরই ছিল। ঠার্কুদা কবি গানে যোগ দিতেন। সেইভাবে আমার বাবা, কাকাও কীর্তনকে জীবনের মূল সাধনা করে চলেছেন। আমিও সেই ধারা বজায় রেখেছি। কীর্তন সাধনায় আমাকে নিয়ে তৃতীয় পুরুষ চলছে।

এতদিন আমি কীর্তন শিখেছি। বাড়িতে অর্থের প্রয়োজনে প্রফেশনাল ভাবে কীর্তন অনুষ্ঠানও করেছি বাইরে। কিন্তু সেটা তো তখন সীমিত অংশে সীমাবদ্ধ ছিল। সারেগামাপা-র মঞ্চে যে আমি কীর্তন গান গেয়ে শ্রোতাদের মন ভাল করতে পারছি, সেটা আমার কাছে বিশাল পাওয়া। পদ্মপলাশ নামটাই কেউ জানতে পারত না, সারেগামাপা-তে আমি সুযোগ না পেলে। এই মঞ্চটা আমায় সব দিয়েছে। আমি এত দূর এসেছি, বিচারকদের আশীর্বাদ থেকে গুণী মানুষদের ভালবাসা পাচ্ছি, এটা আমার কাছে বড় প্রাপ্তি। এখন লড়াইটা খানিক সহজ করে দিয়েছে এই মঞ্চ।
সারেগামাপা-র মঞ্চ স্মরণীয় ঘটনা?
শুরুর দিকে আমাদের একবার ‘ট্রায়ো চ্যালেঞ্জ’ হয়েছিল। সেই চ্যালেঞ্জ আমি গেয়েছিলাম ‘হরে কৃষ্ণ নাম দিল প্রিয় বলরাম’। আমার সেই গান শুনে মেন্টর রাঘবদা, ইমনদি, মনোময়দা, রথীজিৎ স্যার– সবার চোখে জল চলে আসে। বিচারকরা সবাই কাঁদছিলেন আর বলেছিলেন আমি মঞ্চে ঈশ্বরকে নামিয়ে এনেছি। মিউজিশিয়ান দাদারাও সবাই উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। এটা আমার একটা অ্যাচিভমেন্ট ছিল সেদিন। সব্বাই এসে আমায় আশীর্বাদ করেছিলেন। এটা আমার সারা জীবন মনে থাকবে।

বিচারকদের মধ্যে সবথেকে প্রিয় কে?
প্রত্যেকেই। মেন্টর, গ্রুমারাও। আমার গুরুজী পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর সামনে এই মঞ্চে গাইতে পারছি, সেটা ভগবানের আশীর্বাদ। আমি ওঁর কাছে ২০১৫ সাল থেকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ক্লাস করতাম। শ্রীকান্ত কাকু এত গান সম্পর্কে পড়াশোনা জানা মানুষ, সংগীত পরিচালক হিসেবে শান্তনু মৈত্র স্যারের টিপসগুলোও ভীষণ দরকারি। রিচা ম্যাম অবাঙালি হয়েও আমার কীর্তন ভালবাসেন, এটাও কিন্তু পরম প্রাপ্তি। আর একজনের কথা কখনও ভুলব না। কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য স্যার। ওঁর জন্যই আমরা আজ মেনস্ট্রিমে এভাবে কীর্তন, বাউল গাইতে পারছি।
পদ্মপলাশ কীর্তন ফরম্যাটের বাইরে অন্য গান গাইছেই না, অথচ অন্য প্রতিযোগীদের সবরকমের গান গেয়ে লড়তে হচ্ছে। কী বলবে?
আমার মনে হয় আমার গানগুলো অনেকেই খুব মন দিয়ে শোনেননি। এখনও পর্যন্ত আমার যে সকল গান টেলিকাস্ট হয়েছে, তাতে আমি কিন্তু অনেক ধরনেরই গান গেয়েছি। ‘এ আমার গুরুদক্ষিণা’ গেয়েছিলাম, যেটা কীর্তন নয়, কিশোর কুমারের গাওয়া ফিল্মি গান। দুর্গা সপ্তমীর দিন লতা মঙ্গেশকরজির ভজন গেয়েছিলাম। সব থেকে বড় কথা, কিছুদিন আগেই কুমার শানুর গাওয়া ‘যব কিসি কি তরফ দিল ঝুঁকনে লাগে’ গান গাইলাম। এই গানটা গাইব আমি কোনওদিন ভাবতেই পারি। সারেগামাপা-র জাজরা, মেন্টররা আমায় সবসময় সাহায্য করছেন, যাতে আমি প্রতিনিয়ত নতুন কিছু করতে পারি। কী নতুন এলিমেন্ট দিলে কীর্তন শুনতে আরও ভাল লাগবে, তাও আমায় শিখিয়েছেন তাঁরা।

এবার দর্শকদের মধ্যে নানা দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। প্রচুর দর্শকের থেকে ভাল ফিডব্যাক পেয়েছি। শুধু বাংলা নয়, ভারতবর্ষের নানা প্রান্ত-সহ কানাডা, লন্ডন, সিঙ্গাপুরের শ্রোতাদের থেকেও আশীর্বাদ ও ভালবাসা পাচ্ছি। এতদিন লোকে ভেবে এসেছে কীর্তন বয়স্কদের গান। সারেগামাপা কীর্তনকে প্রথম মেনস্ট্রিমে আনল। আমরা কীর্তন শিল্পীরা কীর্তন গানকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে পারছি, এটা ভাল লাগার জায়গা।
সারেগামাপা চ্যাম্পিয়ন হলে কী করার ইচ্ছে?
চ্যাম্পিয়ন হবো কি হবো না সেটা ঠাকুরের ইচ্ছা। যারা সারেগামাপা মঞ্চে এসোছে, তারা প্রত্যেকেই চ্যাম্পিয়ন। যারা যারা আমরা টপ নাইনে উঠেছি, আমাদের বন্ধুদের মধ্যে কোনও অন্তর্দ্বন্দ্ব নেই। দর্শকদের হয়তো মনে হচ্ছে আমাদের মধ্যে ভীষণ প্রতিযোগিতা, হিংসা, কিন্তু সেটা আমরা মনেই করি না। কে প্রথম হবে, কে দ্বিতীয় হবে, সেটা আমাদের কাছে ভাবার কোনও বিষয় নয়।

সবাই তো সব ধরনের গান করছে। আমি যেহেতু ছোটবেলা থেকে কীর্তন শিখেছি, তাই কীর্তন গান নিয়ে আরও অনেক মানুষের কাছে আমার এগিয়ে যাওয়াই মূল লক্ষ্য। কীর্তন সবথেকে প্রাচীন গান। তিনশো বছর আগে মহাপ্রভু চৈতন্যর সময় থেকে শুরু করে কীর্তন এখনও বাংলার মানুষের মনে রাজত্ব করছে। সেই গানের ধারা নিয়ে এগিয়ে যাব। নিজের অ্যালবাম করে বাংলার প্রত্যেকটি মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিতে চাই। কীর্তন গেয়ে আমি সব ধরনের গানের সাথে লড়াই করেছি। তাই মানুষকে বুঝতে হবে, কীর্তন আগে শিখতে হবে, যা শেখা সহজ নয় এবং কীর্তন শিখেও লড়াই করা যায় গানের দুনিয়ায়।
‘আমরা সবাই চ্যাম্পিয়ন, আমাদের কোনও দ্বন্দ্ব নেই!’ বন্ধুত্বের জয়গান পদ্মপলাশ, বুলেট, অ্যালবার্টের