নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী রূপে অনিল চট্টোপাধ্যায়কে একমাত্র ব্যবহার করেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
অনিল চট্টোপাধ্যায়, অসাধারণ অভিনয়, ম্যাজিক্যাল প্রেজেন্স এবং মিষ্টি সুরেলা কণ্ঠ, এই তিনের সমন্বয়ে যার ব্যক্তিত্ব। অনিল চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়ে কণ্ঠে সবসময় একটা আত্মভোলা সহৃদয় মানুষের ছাপ আমরা পেয়েছি, যাকে ভীষণ বিশ্বাস কর
অনিল চট্টোপাধ্যায়, অসাধারণ অভিনয়, ম্যাজিক্যাল প্রেজেন্স এবং মিষ্টি সুরেলা কণ্ঠ, এই তিনের সমন্বয়ে যার ব্যক্তিত্ব। অনিল চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়ে কণ্ঠে সবসময় একটা আত্মভোলা সহৃদয় মানুষের ছাপ আমরা পেয়েছি, যাকে ভীষণ বিশ্বাস করা যায়। তাঁকে বারবার আমরা পেয়েছি পালিয়ে বেড়ানো আত্মভোলা চরিত্রে যেমন 'মেঘে ঢাকা তারা', 'কোমল গান্ধার', 'নির্জন সৈকতে', 'পোষ্টমাষ্টার', 'দীপ জ্বেলে যাই', 'স্মৃতিটুকু থাক', 'কবিতা'র মতো অজস্র ছায়াছবিতে।
অনিল চট্টোপাধ্যায় স্ক্রিনে আসা মানেই মন ভালো হয়ে যাওয়া। যার উপস্থিতিতে দর্শকের মুখে হাসি ফুটবেই। দর্শকের মন ভালো করে দিতে অনিল পারতেন বেশিরভাগটাই তাঁর কণ্ঠ-জাদু দিয়ে। অমন সুরেলা কণ্ঠ আর দুটি খুঁজে পাওয়া যাবেনা।
স্ক্রিনে অনিল নেই অথচ তাঁর কণ্ঠ আছে। এমন কি হয়েছে কখনও? খুব একটা এ ঘটনা ঘটেনি। সত্যজিৎ রায় থেকে তপন সিনহা সকলেই অভিনেতা অনিলকে ব্যবহার করেছেন তাঁদের ছবিতে। কিন্তু তাঁদের পরবর্তী একমাত্র পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, যিনি কণ্ঠশিল্পী অনিল চট্টোপাধ্যায়কে দর্শকের সামনে হাজির করেছেন তাঁর ছবিতে। অথচ এই বিরল ঘটনা অজানাই রয়ে গেছে মানুষের কাছে। কিন্তু অনিল চট্টোপাধ্যায়ের নেপথ্যকণ্ঠ যে মুগ্ধতা সৃষ্টি করেছে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ছবিতে তা তুলনাতীত। অনিল-কণ্ঠ ছাড়া ছবিটাই দেখতে পানসে লাগবে।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করলেও তাঁর একটা কব-মন ছিল বরাবর। সেই কাব্যিক ভাবনাচিন্তা তাঁকে চলচ্চিত্র জগতে এনে ফেলল। বুদ্ধদেবের ছবি তো এক একটা কবিতা। বুদ্ধদেব ছবির ব্যাকরণগত ভাষা মানতেন না, বরং প্রকৃতির মুডের উপর তাঁর ছবির দৃশ্যায়ন আঁকতেন।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ১৯৬৮ তে তাঁর প্রথম ছোট ছবি 'সময়ের কাছে' বানালেও সে অর্থে সাফল্য পাননি। দশ বছর পর ১৯৭৮ এ বুদ্ধদেব বানালেন তাঁর প্রথম ফিচার ফিল্ম 'দূরত্ব'। যে ছবি দিয়েই লাইম লাইটে চলে এলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে 'দূরত্ব'-র গল্প ছিল দুই নর-নারীকে কেন্দ্র করে। মন্দার আর অঞ্জলি। চরিত্র চিত্রণে প্রদীপ মুখোপাধ্যায় এবং মমতা শংকর। দুজনের প্রেমে পড়া, প্রেম থেকে বিশ্বাস ভাঙা আবার কোথাও গিয়ে দুজন দুজন ছুঁয়ে থাকা ডির্ভোসের পরেও। এমন এক কঠিন অথচ অতিআধুনিক বিষয়ের গল্পের সূত্রধর ছিলেন 'দূরত্ব' ছবিতে অনিল চট্টোপাধ্যায়। নায়ক-নায়িকা দুটি চরিত্রের অর্ন্তকণ্ঠ যেন অনিল চট্টোপাধ্যায়।
'দূরত্ব'তে অভিনয় করেননি অনিল চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু 'দূরত্ব'তে ভয়েস ওভার দিয়েছিলেন তিনি। অর্থাৎ নেপথ্য কণ্ঠে অনিল চট্টোপাধ্যায় কাজ করেছিলেন।
সামাজিকভাবে মন্দার আর অঞ্জলির অবস্থান, তাঁদের প্রেম-বিরহের কাহিনি, সত্তর দশকের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সবটাই উঠে এসছিল অনিল চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠে।
[caption id="attachment_2312097" align="aligncenter" width="318"]মন্দারের চরিত্রে প্রদীপ মুখোপাধ্যায়[/caption]
'দূরত্ব'য় নেপথ্যকণ্ঠ শিল্পী হিসেবে কাজ করেছিলেন অনিল চট্টোপাধ্যায় এবং জয়তী ঘোষ। ছবি জুড়েই আছে অনিলের সুরেলা কণ্ঠস্বরের উপস্থিতি।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর পরবর্তী কোনও ছবিতেই কখনও অভিনয় করার সুযোগ পাননি অনিল চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু তাঁর আইকনিক কণ্ঠকে যে এভাবেও নেপথ্যকণ্ঠশিল্পী হিসেবে ছবির আবহে ব্যবহার করা যায় তা একমাত্র ভেবেছিলেন বুদ্ধদেব। বাংলাতে সর্বাধিক জাতীয় পুরস্কার বিজয়ী ও স্বর্ণকমল পুরস্কার জয়ী পরিচালক তিনিই। তাঁর প্রথম ফিচারফিল্ম 'দূরত্ব' জাতীয় পুরস্কারে সেরা চলচ্চিত্র বিভাগে বিজয়ী হয়েছিল।
ছবির মূল প্রোটাগনিস্ট মমতা শংকর জানাচ্ছেন "'দূরত্ব' ঐসময় দাঁড়িয়ে খুব একটা সাহসী ছবি। সেই সাহসটা বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত তাঁর প্রথম ফিচার ফিল্মেই দেখাতে পেরেছিলেন। আমি তো বলব আমি ভাগ্যবতী, এত শক্তিশালী চরিত্র করার আমি সুযোগ পেয়েছি। তখন আমার কতই বা বয়স একুশ কি বাইশ! অথচ অমন কঠিন চরিত্র করছি। এটা তো বলব ওঁনার কৃতিত্ব উনি আমাকে দিয়ে কাজটা করিয়ে নিয়েছিলেন। 'মৃগয়া', 'দূরত্ব', 'গৃহযুদ্ধ' পরপর করেছিলাম।"
অনিল চট্টোপাধ্যায়ের আবহ-কণ্ঠের উপস্থিতিতে যে ছবি জাতীয় পুরস্কারে সেরা ছবি হিসেবে পুরস্কৃত হয় সেই ছবির কথা অনিল কখনও বলেই যাননি কারও কাছে বা তাঁর পরিবারের কাছে। ওঁর মতো স্টার অভিনেতা মধ্যগগনে তখন এবং বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত সেসময় এক নবীন পরিচালক। কিন্তু নেপথ্য কণ্ঠের কাজটি করে দিয়েছিলেন অনিল চট্টোপাধ্যায়। মমতা শংকর আর প্রদীপ মুখোপাধ্যায়ের দুই চরিত্রের বোঝাপড়া কী চমৎকার ভাবে কণ্ঠজাদুতে ফুটিয়ে তোলেন অনিল চট্টোপাধ্যায়। এমন একটা আলাদা ভাবনা ভাবতে পেরেছিলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। আর সে ছবি জাতীয় পুরস্কার পেয়ে সাড়া ফেলে দিল। কিন্তু নেপথ্যে কণ্ঠে অনিল চট্টোপাধ্যায় সে অর্থে প্রচারে আসেননি, অথচ ছবি দেখলেই বোঝা যায় এ কণ্ঠ আমাদের চিরপরিচিত অনিল চট্টোপাধ্যায়ের। পরবর্তীকালে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের আরেকটি আইকনিক ছবি 'নিম অন্নপূর্ণা'তেও অনিল চট্টোপাধ্যায় নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে কাজ করেছিলেন।
আত্মপ্রচার বিমুখ অনিল বহু পরোপকার করেও সেসবের প্রচার করতেন না। এমনকি বাড়ির লোকের কাছেও বলতেন না। তাঁর কণ্ঠ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এসেই পড়ে অতীতের আরেক ঘটনা। জীবনের শুরুতে আকাশবাণীতে ঘোষকের চাকরির জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলেন অনিল এবং ঘোষক পদে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। কিন্তু সিনেমার জগতে অনিলের ব্যস্ততা বাড়ছে তাই রেডিয়োয় ঘোষকের চাকরি পেয়েও ছেড়ে দিলেন। কিন্তু এখানেও অনিল ঘটালেন এক কাণ্ড। পুলুও বসেছিলেন পরীক্ষায়। পুলু হলেন দ্বিতীয়। অনিল প্রথম। একটাই পদ। ব্যস্ততার জন্য অনিল চাকরি নিলেন না, বলা ভালো অনিলই তাঁর অর্জন করা প্রথম স্থান দিয়ে দিলেন পুলুকে। আকাশবাণীতে পরীক্ষা দিতে গিয়েই অনিল পুলুর আলাপ। দুজন দুজনের জীবন সংগ্রামের কথা জানলেন। অনিল পুলুর সবকথা শুনে বললেন "এ চাকরিটা আমার নয়, তোমার দরকার। আমার যা হোক করে চলে যাবে, এ চাকরি তুমিই কর।"
[caption id="attachment_2312077" align="aligncenter" width="600"]আকাশবাণী থেকে শুরু সৌমিত্র আর অনিলের বন্ধুত্ব[/caption]
পুলু আকাশবাণীর ঘোষক হলেন। তখন পুলু ছবির জগতে সে অর্থে আসেননি। এই পুলু হলেন কিংবদন্তি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সেই আকাশবাণী থেকে শুরু অনিল-পুলুর বন্ধুত্ব।
অথচ অনিল এ ঘটনা তাঁর স্ত্রী অনুভা দেবীকে কখনও বলেননি। অনিল চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর বন্ধুর স্মৃতিচারণায় এমন বন্ধুত্বের গল্প লিখেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তখন জানতে পারেন অনিলের পরিবার।
[caption id="attachment_2312092" align="aligncenter" width="600"]সাগর সেন, সৌমিত্র ও অনিল[/caption]
তো অনিল চট্টোপাধ্যায় তাঁর কণ্ঠজাদুতে চিরকালই এগিয়ে। আকাশবাণীর প্রবেশিকা পরীক্ষায় তিনিই প্রথম। তাঁর কণ্ঠ আজও আইকনিক। অথচ শুধুমাত্র তাঁর কণ্ঠকে কাজে লাগানো খুব কম হয়েছে। মনে পড়ছে অপর্ণা সেন পরিচালিত 'পরমা' ছবির কথা। যেখানে অনিল চট্টোপাধ্যায় একজন মনোবিদ। তিনি জীবনের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনছেন পরমাকে। সেখানে অপর্ণা অনিল চট্টোপাধ্যায়ের সংলাপ বলার সময় ঠোঁট দুটোকে ক্যামেরাতে ফোকাস করে অদ্ভুত এক দৃশ্যের সৃষ্টি করেছিলেন। অনিলের সুরেলা কণ্ঠ যেন পরমার মনে এক প্রতিধ্বনির সৃষ্টি করছে ঠিক এমনটাই তুলে ধরেন অপর্ণা সেন।
অথচ এমন এক কণ্ঠজাদুকর অনিল চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠ কখনও সে অর্থে রেডিও নাটক বা রেকর্ডে শ্রুতিনাটকে আমরা পাইনি। একটা অসাধারণ দিক যেন অব্যবহৃত রয়ে গেল। যদিও দর্শকমনে আজও আইকনিক অনিল-কণ্ঠ। একজন এমন লোকও খুঁজলে পাওয়া যাবেনা যিনি চেনেননা অনিল চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠ।
অনিল চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা অন্তরা চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন " বাবা অসাধারণ বাগ্মী ছিলেন। বাগ্মিতার জন্য বাবা বিখ্যাত ছিলেন। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতে হত শুধু বক্তা বাবাকে। যে বাগ্মিতা গুণটা আমার মেজদা কিছুটা পেয়েছেন। মেজদা জর্নালিস্ট। ওঁর মধ্যে বাবার এই গুণটা আছে।"
অথচ অনিল চট্টোপাধ্যায় ভয়েস ওভার কোনও ছবিতেই কখনও করেননি বা বলা ভালো করার সুযোগ পারেননি। ব্যতিক্রম বুদ্ধদেবের ছবিগুলো।
আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে বাঁধাগতে সিনেমা হয়তো তাই পরীক্ষা-নিরীক্ষা কম হয়। ছকভাঙা ভাবনা ভাবতে পারতেন বলেই বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত তাঁর প্রথম চলচ্চিত্রে অনিল চট্টোপাধ্যায়ের ভয়েস ওভার ব্যবহার করেন। অথচ এই ঘটনাটি একদম অনালোচিত রয়ে গেছে আজও। সিনেপ্রেমী তথা অনিল চট্টোপাধ্যায় ভক্তদের কাছে নিশ্চয়ই এ ঘটনা সামনে আনা উল্লেখযোগ্য হয়ে রইবে।