
সোহিনী চক্রবর্তী
সময়টা ১৯৭০ সাল। বহরমপুর থেকে কলকাতা পর্যন্ত ছিল একটাই রাস্তা। পাট চালান হতো ওই রাস্তা দিয়ে। কিন্তু রাতের অন্ধকার নামলেই শুরু হতো মুশকিল। স্থানীয় পাগলাচণ্ডী নদীর উপর রয়েছে একখানা ভাঙা সাঁকো। রাত হলে অন্ধকারে সেই সাঁকো পেরনো বড্ড ঝুঁকির। তাই পাট বোঝাই ট্রাকগুলো রাতভর অপেক্ষা করে। সকাল হলে ফের শুরু হয় যাত্রা।
কিন্তু একটা গোটা রাত তো আর এমনি এমনি কাটতে পারে না। আবার ঘুমে চোখ জুড়িয়ে এলে সকালে উঠতে দেরি হয়ে যেতে পারে। সময় মতো মাল না পৌঁছলে হয়তো ক্ষতি হয়ে যাবে কয়েক হাজার টাকার। সত্তর সালে কয়েক হাজার টাকা এখনকার কয়েক লাখের সমান তো বটেই। তাই রাতের আড্ডা জমাতে ট্রাক ড্রাইভাররা জড়ো হতো রাস্তার পাশের একটি ধাবায়। আড্ডার সঙ্গে চলত গান-বাজনা। সঙ্গে থাকত বাংলা মদ কিংবা চা।
কিন্তু আচমকাই একদিন হাজির হন এক মালিক। পকেটের জোর তাঁর অনেক। ক্ষমতালোভী মালিক টাকার বিনিময়ে কিনে নিতে চায় গরিব ট্রাক ড্রাইভারের অসহায়তাকে। মৃত্যু অনিবার্য জেনেও রাতের আঁধারেই ওই ভাঙা সাঁকো পেরোতে রাজি হয় ট্রাক ড্রাইভার। বাদ সাধে বাকিরা। তৈরি হয় সংগঠন বা ইউনিয়ন। শুরু হয় মালিক পক্ষের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর লড়াই।
তবে এই লড়াই কতটা প্রাসঙ্গিক, আদৌ ইউনিয়ন থাকলে শ্রমিকদের উন্নয়ন হয়, নাকি কোথাও একটা গিয়ে এই ইউনিয়ন-ই শ্রমিকদের উন্নতির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়——-এই সব প্রশ্নের উত্তর নিয়েই ১০ মে মঞ্চস্থ হবে ‘ইচ্ছেমতো’-র নতুন নাটক ‘ঘুম নেই’। পরিচালনায় সৌরভ পালোধী।
নাটকের ক্লোজ ডোর রিহার্সালের শেষদিন দ্য ওয়াল-এর সঙ্গে আড্ডা দিলেন পরিচালক সৌরভ। জানালেন, কেন সত্তরের দশকে লেখা উৎপল দত্তর নাটক ‘ঘুম নেই’-কেই বেছে নিলেন। বললেন, আজকের দিনে এই নাটক কতটা প্রাসঙ্গিক।
হঠাৎ ‘ঘুম নেই’ কেন?
“উৎপল দত্ত সত্তর সালে নাটকটা লিখেছিলেন। আমি বানিয়েছি ‘৭৫ সালের প্রেক্ষাপটে। সে সময় সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সামাজিক আবহের কারণেই তখন সরকার বলুন, বা মালিক পক্ষ, এদের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে আওয়াজ তুলতে শুরু করেছে শ্রমিক শ্রেণি। আর আজকের দিনে এটা বড্ড প্রয়োজন। তাই বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার কথা মাথায় রেখেই এই নাটকটা বেছে নিলাম।”
পোস্টারে ছয়লাপ হয়েছে শহর। সবেতেই লেখা ‘প্রাপ্তবয়স্কদের’ জন্য। সঙ্গে লেখা ‘এটি একটি ছোটলোকদের পরিবেশনা’। এমন অভিনব প্রচার কেন?
সৌরভের কথায়, নাটকের আসল স্ক্রিপ্টটা পড়লে বুঝতে পারতেন এমনটা কেন। আসলে ট্রাক ড্রাইভারদের নিয়ে নাটক। সংলাপে রয়েছে একদম গ্রাসরুট লেভেলের ভাষা। যেমনটা আজকাল আমরা আড্ডায় বলে থাকি। আমার নাটক সো কলড ভদ্রলোকেদের জন্য একেবারেই নয়। বরং তাঁরা কানে কষ্ট পেতে পারেন। কারণ ঘোর বাস্তব বোঝাতে গেলে যে ভাষার প্রয়োগ দরকার, ঠিক সেটাই এখানে করা হয়েছে। গোদা বাংলায় বেশ কিছু কাঁচা খিস্তি রয়েছে সংলাপে। সঙ্গে বিলুপ্ত প্রায় গালাগালও শোনা যাবে। আর সেই জন্যই দায়িত্ব নিয়ে আগে থেকে আমরা জানিয়ে দিয়েছি এটা প্রাপ্তবয়স্কদের নাটক। এবং সৌজন্যে ছোটলোকরাই রয়েছেন।
কৌশিক কর আপনার নাটকে প্রথমবার, কেমন অভিজ্ঞতা?
নাটকটা পড়ার সময়েই ভেবেছিলাম কৌশিককেই নেব। এ ধরণের চরিত্রে আগে ওকে দেখিনি। তবে বিশ্বাস ছিল ও অসামান্য কিছুই করবে। হয়েছেও তাই। আসলে গোটা নাটকের সব চরিত্রই সমান গুরুত্বপূর্ণ। কোনও ট্রাক ড্রাইভার অন্যজনের তুলনায় কোনও অংশে কম নয়। আর সবাই খুব খেটেছে। এখন ফার্স্ট শো দেখার পালা।
‘ক্যাপ্টেন হুররা’-র সময়ে থেকেই দেবদীপ মুখোপাধ্যায় আপনার সঙ্গী। এই নাটকেও সুর দিয়েছেন দেবদীপ। আবারও সেই লাইভ মিউজিক—–নাটকের গান নিয়ে কিছু বলবেন?
হুম নিশ্চয় বলবো। এই নাটকের গানগুলো একদম আলাদা। ঢপ কীর্তনের আদলেই তৈরি হয়েছে গানগুলো। অনেকটা খেউড় ঘরানার মতো। যেখানে চেনা সুর এবং ছন্দে বেশ কিছু স্থূল শব্দ (গালাগাল বা খিস্তি) দিয়েই গান বাঁধা হয়। আর গানটা গান ‘নিম্নশ্রেণির’ মানুষরাই। যেহেতু নাটকের প্রেক্ষাপটে রয়েছে একটা ধাবা এবং ট্রাক ড্রাইভাররা, ফলে সমাজের কঠোর রাজনীতির সঙ্গে যুঝতে গেলে যে শব্দ তাঁরা ব্যবহার করেন ঠিক সেগুলোই রয়েছে নাটকের গানে।
স্থূল শব্দ থেকে বিতর্কিত বিষয়—সবই রয়েছে ‘ইচ্ছেমতো’-র নতুন নাটকে। কী মনে হয় শো শুরু হলেই বিতর্ক শুরু হবে?
প্রথমেই বলি এই নাটক সকলের ভালোলাগার জন্য নয়। এমন কিছু গালাগাল বা শব্দের ব্যবহার এখানে রয়েছে যার সঙ্গে হয়তো সেভাবে পরিচিত নন শহরবাসী। ফলে ছি ছি করবেন না এমনটা ভাবা উচিত নয়। তবে বাস্তবটা দেখানোর জন্য উৎপলবাবু যা লিখেছিলেন, আমি সেটাই স্টেজে দেখাব। রূঢ় বাস্তব এটাই। আর যে মানুষগুলোকে নিয়ে নাটকটা তৈরি, তাঁরা সবসময় আনন্দে থাকতেই ভালোবাসেন। তবে হ্যাঁ একটা কথাই বলতে পারি নাটকে শুধু খিস্তি-খেউড়ই নেই।
সব শেষে দর্শকদের চোখে জল আসতেও বাধ্য।