Advertisement
'একটা যাচ্ছেতাই গল্প' নাটক
Advertisement
শেষ আপডেট: 19 March 2024 21:01
'যাচ্ছেতাই' শব্দটি যতই নেতিবাচক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হোক না কেন, চন্দননগর সারঙ্গ ক্রিয়েশনসের নতুন নাটক 'একটা যাচ্ছেতাই গল্প' নতুন মাত্রা যোগ করল নাটকের অঙ্গনে। এ নাটক শুধু আর নাটকে সীমাবদ্ধ নেই, এ নাটক আমাদেরই কথা বলছে। এটাই বিশেষত্ব চন্দননগর সারঙ্গের নতুন নাটকের। 'একটা যাচ্ছেতাই গল্প' এই নিয়ে তৃতীয় বার মঞ্চস্থ হল। অসীম বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে নাটকের চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছেন পিয়াল ভট্টাচার্য। নাট্যনির্দেশনায় শ্রীজাতা সেনগুপ্ত। শ্রীজাতা নাট্যপরিচালক রূপে ডেবিউ করলেন 'একটা যাচ্ছেতাই গল্প' দিয়ে।
'একটা যাচ্ছেতাই গল্প' আর পাঁচটা পেশাদার মঞ্চ নাটকের থেকে স্বতন্ত্র। একেবারেই অন্তরঙ্গ নাট্যআঙ্গিকে উপস্থাপন করা হয়েছে নাটকটি। এখানে নাটক অভিনীত হচ্ছে দর্শকদের মাঝে,কোনও মঞ্চে নয়। সম্প্রতি তৃপ্তি মিত্র নাট্যগৃহে উপস্থাপন করা হল নাটকটি। অভিনেতারা দর্শকের কাছাকাছি এসে প্রশ্ন করছেন, নিজেদের ভাঙছেন,গড়ছেন। দর্শক খুব কাছ থেকে অভিনেতাদের ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন থেকে বডি ল্যাঙ্গোয়েজ দেখতে পাচ্ছেন। যেন প্রতিটি দর্শক হয়ে উঠছেন এই নাটকের চরিত্র। অন্তরঙ্গ থিয়েটারের এটাই মজা ,এটাই ম্যাজিক। আর এই ম্যাজিক একশো ভাগ পূরণ করেছেন পিয়াল ভট্টাচার্য ও শ্রীজাতা সেনগুপ্ত। চিত্রনাট্যকার আর পরিচালকের বোঝাপড়া ভাল বলেই নাটকটি সফল হতে পেরেছে।
গল্পকার অসীম বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাটকটি দেড় পাতার। কিন্তু সেই গল্পকে এক ঘন্টার নাট্যরূপ দিয়েছেন পিয়াল। চোখা চোখা সংলাপে পিয়াল নিজের জাত চেনালেন। কখনও তাঁর কলমে আছে আটপৌরে কথার ছোঁয়া, আবার কখনও কৌতুক মিশ্রিত কমেডি। পিয়ালের কথায় " অসীম বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই গল্পটা পড়ে আমাদের মনে হয়েছিল এই গল্পটার ভিতর খুব Dramatic Element আছে। ম্যাজিক আর রিয়্যালিটি দুটোই মিলেমিশে আমাদের জীবনের মধ্যে থাকে যা দেখায় এই নাটক। নতুন একধরনের কাজ যা নিয়ে আমি প্রথম শ্রীজাতার সঙ্গে কথা বলি। নাটকের নির্দেশনা আমি এতদিন দিয়ে এসছি এবার বললাম শ্রীজাতা সেনগুপ্ত দিক।"
টানটান চিত্রনাট্যকে টানটান নির্দেশনায় দুর্দান্ত ভাবে উপস্থাপন করেছেন নির্দেশক শ্রীজাতা সেনগুপ্ত। কে বলবে শ্রীজাতা প্রথমবার নাটক পরিচালনা করেছেন! মুগ্ধ করল শ্রীজাতার সৃজন। শ্রীজাতা জানালেন "আমার অভিনয় শেখা পিয়ালদার কাছে। অভিনয় করছি সেই ২০১১ সাল থেকে। আমাদের নিজেদের হাতে তৈরি দল 'চন্দননগর সারঙ্গ ক্রিয়েশনস'। এতদিন অভিনয় করছি এবার পরিচালনার সঙ্গে অভিনয় সেটা নতুন অভিজ্ঞতা তো বটেই। তবে আমি একা কৃতিত্ব নেব না। এই নাটক আমাদের দলের সবার টিমওয়ার্ক। "
নাটকের গল্প বলে দেওয়া ঠিক নয় তাতে নাটকের মেজাজটাই নষ্ট হয়ে যায়। তবে নাটকটি এক লেখককে নিয়ে, যে লেখক হঠাৎই কোনও গল্প খুঁজে পাচ্ছেন না। তাই তিনি চিন্তিত। কিন্তু লেখকের নিজের জীবনের গল্পটা আরো চিন্তার। যেখানে তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে তাঁর স্ত্রী মালা আর পুত্রের মুখ। মালা এই লেখকের সাপোর্ট সিস্টেম। কিন্তু স্ত্রীকে নিয়ে কখনও গল্প লেখা হয়নি লেখকের। গল্প খুঁজে না পেয়ে লেখক বেরিয়ে পড়েছেন পথে। উত্তর কলকাতার রাস্তায় নানা চরিত্রের মানুষের সঙ্গে দেখা হচ্ছে তাঁর। যে মানুষগুলোরও নিজেদের জীবনের এক একটি নিজস্ব গল্প রয়েছে। তবু পথচলতি মানুষদের গল্প গুলো সরলরৈখিক নয়। লেখক দূর থেকে দুটি নারী-পুরুষকে দেখে ভাবছেন তারা নিশ্চিত কপোত-কপোতী। রবীন্দ্রনাথের ছবির সামনে যারা দাঁড়িয়ে তারা যুগল ছাড়া হতেই পারেনা। কিন্তু সামনে গিয়ে চিত্রটা একেবারে বুকে এসে ধাক্কা মারে। যখন লেখক দেখেন নারীপুরুষ দুটি আদতে একজন দেহজীবি আর খদ্দের। সেই জয় গোস্বামীর ভাষায় 'কেমন হবে আমিও যদি নষ্ট মেয়ে হই'। নাটকের শেষে লেখক কি আদৌ গল্প খুঁজে পেলেন? সেটা জানতে নাটকটি দেখতে হবে। তবে নাটকের শুরু যে বিষাদ নিয়ে, শেষে কিন্তু আছে দিনবদলের আলো।
অভিনয় প্রসঙ্গ বলতে প্রথমেই বলতে হয় লেখক চরিত্রে সৌরভ সাহা। পুরো নাটকটি একার কাঁধে টেনেছেন তিনি সফল ভাবে। বাকি চরিত্ররা আসছে যাচ্ছে কিন্তু লেখক মূল প্রোটাগনিস্ট। লেখকের অন্তর্নিহিত অপমান,জ্বালা,যন্ত্রণার ভিতর সৃষ্টির আনন্দ, নতুন ভাবনা আসার উন্মাদনা সৌরভ সাহার মুখে ফুটে উঠেছে। লেখকের স্ত্রী মালার চরিত্রে শ্রীজাতা সেনগুপ্ত। পরিচালক অভিনয়ও করেছেন। মঞ্চে প্রবেশের সময় থেকেই শ্রীজাতা জমিয়ে দিয়েছেন। একজন লেখকের হেরে যাওয়া থেকে সাফল্য সবটার সাক্ষী তাঁর স্ত্রী। সেই সম্পর্কের আঁচ কিন্তু দর্শকরা টের পাবেন শ্রীজাতার অভিনয়ে। এরপর যার কথা বলব অভীক বাগচী। প্রথম পর্বে যে মহাদেব হয়ে মঞ্চে আবিভূর্ত হচ্ছে। দ্বিতীয় ভাগে সেই উত্তর কলকাতার বিহারী রিকশওয়ালা। দু ধরনের চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় অভীকের। বিশেষ করে একটি দৃশ্য বলতে হয়, যেখানে লেখক রিকশয় উঠেও রিকশওয়ালার পেছনে বসছেন না। দুজনকেই পাশাপাশি মঞ্চের দু ধারে দেখালেন পরিচালক শ্রীজাতা।
এ ভাবনাটি মনে ছাপ ফেলল বেশ। কারণ লেখক আর রিকশওয়ালা দুজনের দুটো গল্প রয়েছে এখানে। মাটিতে রিকশওয়ালার পা দিয়ে রিকশ চালানোর স্টেপ দুর্দান্ত করলেন অভীক। দেহজীবীর চরিত্রে নন্দিনী রায় সাবলীল অভিনয়ে তাক লাগিয়ে দিলেন। সংলাপে লাস্য ছড়ালেন নন্দিনী। পথিক রূপে সৌরভ চট্টোপাধ্যায় যথাযথ। শৃণি মিত্র এক ঠগিনীর চরিত্রে কাঁপিয়ে দিলেন। এবার যার কথা বলব তিনি পিয়াল ভট্টাচার্য। পিয়াল দুটি ভিন্নধারার চরিত্রে অভিনয় করলেন। কন্ডাকটরের চরিত্রকে যেভাবে জীবন্ত করে তুললেন পিয়াল, কে বলবে তিনি পেশায় অধ্যাপক। কী অসাধারণ রপ্ত করেছেন কন্ডাকটরের উচ্চারণ। তেমনই একজন সেলসম্যানের চরিত্রে কাঁধে ভারী ব্যাগ ঝুলিয়ে ঠিক সেই চরিত্রই হয়ে উঠেছেন পিয়াল। একেই বুঝি বলে কুড়ি বছরের নাটক জীবনের অভিজ্ঞতা।
মাত্র এক ঘন্টার নাটক 'একটা যাচ্ছেতাই গল্প', কিন্তু টানটান উপস্থাপন। মঞ্চ ভাবনায় স্নেহা সরকার, পোশাক পরিকল্পনায় শৃণি মিত্র ও রূপটানে নন্দিনী রায় প্রশংসনীয়।
আবহে সৌরভ সাহা ও আলোক পরিকল্পনায় আবারও পিয়াল ভট্টাচার্য মন কেড়ে নিলেন। নাটকের শুরু অন্ধকার থেকে ভোর হওয়া দিয়ে। রাতের ঘড়ির টিকটিক শব্দে মিলে যাচ্ছে ভোরের পাখির কাকলি যা কানকে আরাম দেয়। আলো আর শব্দের খেলা এ নাটকটিকে আরো মনোগ্রাহী করেছে। শব্দ প্রক্ষেপনে সুদীপ্ত চৌধুরী ও আলোকসম্পাতে তন্ময় সেন। প্রযোজনা নিয়ন্ত্রণ পামেলা ভট্টাচার্য ও অভিষেক মণ্ডল। লেখকদের মন পড়তে পারা খুব শক্ত। আমজনতার সরলরৈখিক ঘেরাটোপে তাঁদের জীবন চলে না। তাঁরা স্বতন্ত্র।
'একটা যাচ্ছেতাই গল্প', যাচ্ছেতাই বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না এ নাটক ভাবায় এ নাটক ভাসায়। ক'মাস পরেই আবার নাটকের পরবর্তী শো হবে বলে জানা গেল।
নাটকের স্থির চিত্র : কৌস্তভ দাশগুপ্ত
Advertisement
Advertisement