এন বিশ্বনাথন ও পারমিতা বিশ্বনাথন
শেষ আপডেট: 28 April 2025 12:25
বাংলা ছবিতে চুরুট বা পাইপ মুখে অভিনেতা বললেই যার নাম প্রথমে মনে পড়ে তিনি এন বিশ্বনাথন। যিনি সাহেবি ইংরাজি উচ্চারণ, দৃপ্ত হাঁটাচলা আর আভিজাত্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বে নিজের ক্লাস বুঝিয়ে দিতেন। বেশিরভাগ বাংলা ছবিতেই তাঁর স্বল্প উপস্থিতি। তবু তিনি কত বড় অভিনেতা ও উচ্চশিক্ষিত মানুষ তা দর্শক বুঝে যেত। মানুষটি ছিলেন এক মহান শিক্ষাব্রতী, শিক্ষাবিদ, ভাষ্যকার, অভিনেতা ও বিরাট মাপের ব্যক্তিত্ব। শুধু বাংলাতেই নয়, দক্ষিণেও তিনি জনপ্রিয় ছিলেন 'ক্যালকাটা বিশ্বনাথন' নামে।
কলকাতার শরৎ বসু রোডের বাসভবনে ৮১ বছর বয়সে ২০১০ সালের ১৭ নভেম্বর প্রয়াত হন এন বিশ্বনাথন। তিনি বিয়ে করেছিলেন বাঙালি মেয়ে পারমিতাকে। সেই পারমিতাও হেলাফেলার মহিলা ছিলেন না। গত ২৫ শে এপ্রিল প্রয়াত হলেন পারমিতা বিশ্বনাথন (Paramita Viswanathan)।
আদতে বিশ্বনাথন-পরিবার ছিল দক্ষিণ ভারতের লোক। কিন্তু কলকাতাকে ভালোবেসে এন বিশ্বনাথন পুরোদস্তুর বাঙালি হয়ে উঠেছিলেন। শুধু তামিল বা ইংরাজি উচ্চারণই নয়, স্পষ্ট বাংলা উচ্চারণেও তিনি ছিলেন বিখ্যাত। দীর্ঘদিন আকাশবাণীতে বিভিন্ন নাটকে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। তাঁর ফিল্মজগতে আসা মৃণাল সেনের হাত ধরে। মৃণাল সেনও তখন প্রায় নতুন। ১৯৬১তে মৃণাল সেনের 'পুনশ্চ' ছায়াছবির মাধ্যমে এন বিশ্বনাথনের বাংলা ছবিতে আত্মপ্রকাশ। 'পুনশ্চ' বাংলা ফিচার ফিল্ম বিভাগে তৃতীয় শ্রেষ্ঠ ছায়াছবি হিসাবে বিবেচিত হয় এবং জাতীয় পুরস্কার লাভ করে। এই ছবিতে নায়ক-নায়িকা ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও কণিকা মজুমদার। তবে বিশ্বনাথনের রোলটিও গুরুত্বপূর্ণ।
পরের বছর ১৯৬২তে সত্যজিৎ রায়ের প্রথম রঙিন ছবি 'কাঞ্চনজঙ্ঘা'তে অভিনয়ের সুযোগ পান এন বিশ্বনাথন। এই ছবির পর আর এন বিশ্বনাথনকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৭০ সালে তিনি তামিল চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন এবং ললিতা, মোগম মুপাধু বরুশম ,মুনড্রু মুদিচু ছবিতে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেন। মুখ্যভূমিকায় অন্য যে তামিল ছবিগুলিতে অভিনয় করেছেন সেগুলির মধ্যে অন্যতম হল- কাভরি মান,বালু মহেন্দ্র, মুডুপানি। রজনীকান্ত অভিনীত 'বাবা' ছবিতে কাজ করেন তিনি।একাধিক মেনস্ট্রিম বাংলা ছবি ও বাংলা সিরিয়ালে থাকতেন বিশ্বনাথন।
এন বিশ্বনাথন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর ক্লাস করা ছিল সে যুগের রোমাঞ্চকর ব্যাপার। বহু কৃতী মানুষ ছিলেন তাঁর ছাত্রছাত্রী। দূরদর্শনে তিনি ইংরেজিতে সংবাদপাঠও করতেন।
বিশ্বনাথন বিয়ে করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ডঃ কালিদাস নাগ ও শান্তা দেবীর ছোটো মেয়ে পারমিতা নাগকে। বাঙালি বউয়ের সান্নিধ্যে এসে এন বিশ্বনাথন আরো বাঙালি হয়ে ওঠেন।
পারমিতা নাগ শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের গান শেখার হাতেখড়ি সেখানেই। এমনকী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্যেও আসেন পারমিতা। যা তাঁর জীবনে ছিল শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা। পারমিতার মা শান্তা দেবীও ছিলেন শান্তিনিকেতনে কলা ভবনে নন্দলাল বসুর ছাত্রী। সেখানে 'শ্রেয়সী' পত্রিকার সম্পাদনা শান্তা করতেন।
আকাশবাণীর রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে সেকালে খ্যাতি পান পারমিতা। স্কুল শিক্ষিকা রূপে সুদীর্ঘ কেরিয়ার ছিল পারমিতার। কলকাতা 'পাঠ ভবন' স্কুল প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই শিক্ষিকা ছিলেন পারমিতা বিশ্বনাথন।
পড়াশোনার পাশাপাশি নারীর সাজগোজ নিয়েও উদার মনের ছিলেন পারমিতা। মা শান্তা দেবী মেয়ের বড় টিপ পরা নিয়ে বকাবকি করতেন। কিন্তু কপালে বড় টিপের ট্রেন্ডসেটার ছিলেন পারমিতা। আগেকার দিনে মহিলারা ঘরেই চুল বাঁধতেন নানা ভাবে। বাইরে গিয়ে চুল বাঁধার চল ছিল না। পারমিতা বিশ্বনাথন প্রথম তৈরি করলেন 'কবরী' কেশসজ্জার স্যালঁ ( Hair Salon)। কলকাতা শহরে প্রথম চুল বাঁধার বিউটি স্যালঁ। পারমিতার সঙ্গে সেখানে যোগ দিলেন রুবি পালচৌধুরী ও বিখ্যাত মেক আপ আর্টিস্ট গোষ্ঠ কুমার। গোষ্ঠ কুমার সুচিত্রা সেন থেকে মাধবী মুখোপাধ্যায়ের মেক আপ করতেন। তিনি মূর্তি বানানোতেও প্রসিদ্ধ ছিলেন।
ব্লক প্রিন্ট শাড়ির বুটিকও প্রথম চালু করেন পারমিতা বিশ্বনাথন। তাঁর বুটিকের শাড়ির ব্র্যান্ড ভ্যালু তখন রমরম করছে শহরে। পাঁচ দশক ধরে শাড়ি ডিজাইনে যুক্ত ছিলেন তিনি।
এন বিশ্বনাথনের সঙ্গে দীর্ঘ ৫০ বছরের দাম্পত্য ছিল পারমিতার। ২০১০ সালে বিশ্বনাথনের প্রয়াণে যার পরিসমাপ্তি ঘটে।
ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেছিল বিশ্বনাথন পরিবার। সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে পারমিতা বিশ্বনাথনের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।
এন বিশ্বনাথন ও পারমিতা বিশ্বনাথনের ছেলে বিখ্যাত পরিচালক অশোক বিশ্বনাথন। অশোক বিশ্বনাথন পরিচালিত 'শূন্য থেকে শুরু', 'কিছু সংলাপ কিছু প্রলাপ', ব্যতিক্রমী', 'অন্ধকারের শব্দ' ছবিতে কাজ করেন তাঁর বাবা এন বিশ্বনাথন। তাঁর শেষ অভিনীত ছবি 'গুমশুদা', এই ছবির কাহিনীকারও তিনি। পরিচালক ছেলে। পারমিতার পুত্রবধূ বিখ্যাত সঞ্চালিকা ও অধ্যাপিকা মধুমন্তী মৈত্র। পারমিতার একমাত্র নাতনি এখনকার নামকরা তরুণী অভিনেত্রী অনুষা বিশ্বনাথন। স্বামী, পুত্র,পুত্রবধূ,নাতনি যতখানি প্রচারের আলোতে এসেছেন বহুগুণান্বিতা পারমিতা বিশ্বনাথন সে আলো কিন্তু পাননি। বলা ভাল চাননি। অথচ নীরবে তিনি কত কাজের শুরু করে দিয়ে গিয়েছেন কলকাতা শহরে। পড়াশোনা থেকে সাজের পথিকৃৎ পারমিতা বিশ্বনাথনকে বলাই চলে।
পারমিতার গাছপালা থেকে পশুপাখির উপর খুব ভালবাসা ছিল। তাঁর প্রয়াণে প্রকৃতি যেন আজ বিষন্ন।