ইঁদুরদৌড় আর নিউক্লিয়ার সংকীর্ণতায় আজ যখন ছুটে চলেছি আমি আপনি প্রত্যেকে ঠিক তখনই দুই শব্দের এক ছবি, যে ছবিতে তামাম তারকার চোখ ধাঁধানো গ্ল্যামার নেই, নেই সিক্স প্যাকের প্রদর্শন, বিদেশের রাস্তায় নায়িকার সিফনে লেগে থাকা নায়কের উষ্ণতা... এত নেইয়ের মধ্যে কী আছে তবে?
শেষ আপডেট: 20 June 2025 16:33
বিহঙ্গী বিশ্বাস
ছবি: রাস
চরিত্র চিত্রণে: অনসূয়া মজুমদার, অনির্বাণ চক্রবর্তী, বিক্রম চট্টোপাধ্যায়, দেবলীনা কুমার, রণজয় বিষ্ণু ও অন্যান্য
পরিচালনা: তথাগত মুখোপাধ্যায়
দ্য ওয়াল রেটিং: ৭.৫/১০
'কিছুই কোথাও যদি নেই, তবু তো ক'জন আছে বাকি, আয় আরও হাতে হাত রেখে, আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি'
তবু বেঁধে থাকা যায় কি? ইঁদুরদৌড় আর নিউক্লিয়ার সংকীর্ণতায় আজ যখন ছুটে চলেছি আমি আপনি প্রত্যেকে ঠিক তখনই দুই শব্দের এক ছবি, যে ছবিতে তামাম তারকার চোখ ধাঁধানো গ্ল্যামার নেই, নেই সিক্স প্যাকের প্রদর্শন, বিদেশের রাস্তায় নায়িকার সিফনে লেগে থাকা নায়কের উষ্ণতা... এত নেইয়ের মধ্যে কী আছে তবে? আছে ঘরে ফেরা গান, আছে ফেলে আসা স্মৃতি, হারিয়ে যাওয়া শৈশব, লোডশেডিংয়ের চপ-মুড়ি আর সময়কে আঁকড়ে রাখার অদম্য চেষ্টা।
এই গল্পের নায়ক সোমনাথ (বিক্রম চট্টোপাধ্যায়) শহুরে, ভিতু , এক কর্পোরেট কর্মচারী। ছয় অঙ্কের মাইনে পাওয়া সোমনাথ (শহুরে নাম সোম) ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছেন। মা মারা যাওয়ার পর দেশের বাড়ি মানিকপুর থেকে এক রাতে ছেলেকে নিয়ে বাবা (সুদীপ মুখোপাধ্যায়) চলে আসেন শহরে।মায়ের মৃত্যুর জন্য পরিবারকে দায়ী করে একরাশ অভিমান নিয়ে এখানেই পাতেন লাল-নীল সংসার। তবে দু' কামরার সেই ছোট্ট সংসারে লাল-নীল মিশে গিয়ে কখন যে ধূসর হয়ে গিয়েছিল তা টের পেলেও প্রকাশ করতে পারেননি কেউই।
দিদামা (অনসূয়া মজুমদার) চিঠি লেখেন তাঁর মেজো ছেলেকে। তাতে আঁকা থাকে লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ, জমে থাকে আকুতি, আর থাকে ফিরিয়ে আনার ডাক। সোম মানিকপুর ছাড়লেও, মানিকপুর সোমকে ছাড়েনি। আর সেই কারণেই বাবাকে না জানিয়েই সে একদিন পৌঁছে যায় মানিকপুরে। সেই মানিকপুর যেখানে তাঁর ফেলে আসা ছোটবেলা গুমরে কাঁদে। যেখানে আলমারিতে আজও সযত্নে তোলা আছে তাঁর মায়ের হাতের কাজ। যার পোড়োমন্দিরের চুনখসা দেওয়াল জানে তাঁর প্রথম সবকিছু।
ছবি দেখতে দেখতে মানিকপুরের মধ্যেই ভেসে উঠছিল এক টুকরো নিশ্চিন্দিপুর। ভেসে উঠছিল তরুণ মজুমদারের 'আলো'র বিক্ষিপ্ত দৃশ্যরাজি। একটা অশান্ত বাড়ি, দালানে আচার, প্রজেক্টরে ছবি, সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ, আবার উৎসবে এক হওয়ার আনন্দ, বিপদে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই-- ঠিক এমনই ছোটবেলা তো ছিল আমাদের! গল্পে সোম যদি নায়ক হন তবে তাঁর চালিকাশক্তি দেবলীনা কুমার (রাই)। সাদামাঠা মেয়ে, পড়াশোনায় মেধাবী, সোমের বাল্যবন্ধু বা ছোটবেলার অব্যক্ত প্রেমের অলেখা আখ্যানও বলা যেতে পারে তাঁকে।
সোম ফেরে, সঙ্গে ফেরে ভুলে যাওয়া অধ্যায়রাও। সোমের ফিরে আসা নিয়ে পরিবারের মধ্যে প্রশ্ন ওঠে। এ ছবিকে শুধু মাত্র বিক্রমের ছবি হিসেবে সংকীর্ণ করে রাখেননি পরিচালক তথাগত মুখোপাধ্যায়। এ ছবির আপাত নায়ক বিক্রম হলেও গোটা পরিবারই যেন হিরো। দেবলীনা ছবির অনুঘটক। শিক্ষিত অথচ তথাকথিত ধোপদুরস্তহীন লুকে তাঁকে স্ক্রিনে বেশ লাগে। ভাল লাগে অর্ণ মুখোপাধ্যায়ের মতো এক শিক্ষিত অভিনেতা এই ইন্ডাস্ট্রি পেয়েছে বলে। খারাপ লাগে তাঁকে কীভাবে ব্যবহার করতে হবে সেই হদিশ হয়তো এখনও অনেক পরিচালকই পাননি। শঙ্কর দেবনাথকে নিয়ে আলাদা করে না লিখলে বোধহয় তা তঞ্চকতা হবে। পরিবারের বড় ছেলে, যার স্মৃতি আটকে আছে এক নির্দিষ্ট সময়ে। কেন? তা বললে সাসপেন্স নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়ে যায়। তিনি যে সুঅভিনেতা আর বোধহয় নতুন করে প্রমাণের দরকার পড়ে না তাঁর। ঠিক যেমন অনসূয়া মজুমদারের বিক্রমের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে নিজের ঘরে সেই স্মৃতিচারণ মনে করিয়ে দেয় আপনার ফেলে আসা দিনগুলো। অজান্তেই চোখ ভেজে, অতীত কড়া নাড়ে অতল গহ্বরে।
অনির্বাণ চক্রবর্তীর এই ছবিতে বেশি কিছু করার ছিল না। তবে তাঁর আরসোলাসহ অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে কথোপকথন শুধুই কমিক রিলিফ নয়, 'বোকাসোকা' অন্তর্মুখী মানুষগুলো মনের গভীরে গিয়ে অনুধাবনের প্রচেষ্টাও বটে। স্বল্পরোলে রণজয় বিষ্ণু 'হ্যান্ডসাম' তবে তাঁর স্ক্রিনপ্রেজেন্স এতটাই কম যে আলাদা করে চোখে পড়েন না।
ছবির গান মনকাড়া। বিজিএম ভাল হলেও কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মনে হয়েছে। তবে এই ছবির সম্পাদনা আর কালার কারেকশন চোখ জুড়িয়ে দেয়। ছবির ক্লাইম্যাক্স চেনা। এই ক্লাইম্যাক্সের ছবি আগেও হয়েছে ইতিহাসে। তাহলে 'রাস' কোথায় আলাদা? থ্রিলার-মিস্ট্রির যুগে বাংলায় পুরোদস্তুর পারিবারিক ছবির সংখ্যা কমেছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। এ ছবি আপনি বন্ধু, বাবা-মা, ঠাকুমা-দিদিমাকে নিয়ে অনায়াসে দেখে আসতে পারেন। রাস যেন সেই হারানো গিটার, যে গিটারে তাঁর জুড়তে একটা গোটা জীবন লেগে যেতে পারে। এই ছবি আত্মঅনুসন্ধানের এক অদ্ভুত দলিল। সত্যরে লও সহজের বাইরে গিয়ে এই ছবি প্রশ্ন জাগায়, 'গ্যাছে যে দিন, একেবারেই কি গ্যাছে, কিছুই কি নেই বাকি?' মনের গভীর থেকে উঠে আসা উত্তর অজান্তেই আপনাকে দাঁড় করিয়ে দেয় এক অদ্ভুত বাস্তবতার মুখোমুখি।