Latest News

বম্বেতে হিন্দি ছবি করতে যাওয়াই মিঠুর কাল হল! কেমন আছেন স্বয়ংসিদ্ধা মর্জিনা

শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

Subhadeep Bandyopadhyay

সালটা সম্ভবত ১৯৬৭-৬৮। শ্যামবাজার ভ্রাতৃসঙ্ঘের রজত জয়ন্তী উৎসবে রবীন্দ্রনাথের ‘তাসের দেশ’ নৃত্যনাট্যে মিঠুর (Mithu Mukherjee) প্রথম মঞ্চাবতরণ। এর পর প্রতিমা মুখ উর্ব্বশী ফিগার, নাচতে ভাল পারার সুবাদে নায়িকা রূপে চলচ্চিত্রে প্রবেশ। মিঠুর প্রথম ছবি চিত্ত বসুর ‘শেষ পর্ব’, পরে হিন্দি রিমেক হয়ে যা হয় অমিতাভ-হেমার ‘বাগবান’। পাহাড়ি সান‍্যাল-ছায়াদেবী ভাগের বাপ-মাকে ছেলে মেয়েরা আলাদা করে দেয় দেখাশোনার জন‍্য। সেখানে নবাগতা নায়িকা মিঠু বড় ছেলে অজিতেশ অনুভা গুপ্তার মেয়ে। মিঠুর নায়ক শমিত ভঞ্জ। ছবিতে ছিলেন সাবিত্রী, অনুপ কুমার, উৎপল দত্তরা।

সত্তর দশকে যৌবন সরসী রূপ নিয়ে রূপোলি পর্দায় আগমন হয় নায়িকা ‘স্বয়ংসিদ্ধা’ মিঠু মুখার্জীর। তাঁর রূপে, দেহসৌষ্ঠবে ছিল অটুট যৌন আকর্ষণ, আবার দেবী মুখের মিশেল। দীনেন গুপ্তর ছবি ‘মর্জিনা আবদাল্লা’তে মিশরীয় লাস্যে মর্জিনা করে সারা বাংলায় প্রথম সারির নায়িকাতে চলে আসেন মিঠু। মর্জিনা রূপেই মিঠু প্রথম লাইমলাইটে আসেন।

যে সময় সমাজে ‘প্রেম’ শব্দ নিয়ে ছুঁতমার্গ ছিল, সেসময়ে মিঠু মুখার্জীর লিপে সেই বিখ্যাত গান হিট করে, ‘বেশ করেছি, প্রেম করেছি, করবই তো!’ সমাজে ঝড় তোলে গানের সাহসী কথা। অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘মৌচাক’-এর ভ্রমর মিঠু সারা বাংলার মন জিতে নেন। পরপর তাঁর ছবি হিট হতে থাকে এবং তাঁর রূপেও পাগল হয়ে যায় দর্শক।

একসময় মহানায়কও মিঠুকে তাঁর নায়িকা করতে চান। ‘হোটেল স্নো ফক্স’, ‘চাঁদের কাছাকাছি’ ছাড়াও, মহানায়কের সঙ্গে একই ছবিতে রঞ্জিত মল্লিকের বিপরীতে ‘মৌচাক’ তো সর্বকালীন সুপারহিট। ঋতুপর্ণর অন্তরমহলের আগে একই গল্প নিয়ে ছবি ‘প্রতিমা’তেও ছিলেন মিঠু। মূল নায়িকা যদিও সুমিত্রা মুখোপাধ্যায় ছিলেন। এছাড়াও মিঠু করেছেন ‘নিশিকন্যা’, ‘সন্ধি’, ‘প্রার্থনা’।

এরপর বলিউডেও পাড়ি দেন মিঠু। দুলাল গুহর ‘খান দোস্ত’ প্রথম বলি ডেবিউ তাঁর। করেন আরও বেশ কয়েকটি ছবি। হেমা ধর্মেন্দ্রর ‘দিল লাগি’, ‘সফেদ ঝ্যুট’, বিনোদ মেহেরার সাথে ‘ছুটির ফাঁদে’র রিমেক, ‘মায়া মালহোত্রা’ প্রভৃতি।

Image - বম্বেতে হিন্দি ছবি করতে যাওয়াই মিঠুর কাল হল! কেমন আছেন স্বয়ংসিদ্ধা মর্জিনা

মিঠুর পরপর আরও সুন্দর মুখের নায়িকা আসেন টলিউডে। সেই সব নায়িকাদের নিয়ে যেমন একটি ছবি ছিল, ‘ভাগ্যচক্র’। তাতে একদিকে গ্ল্যামার চটুলপনার শ্রীমতী মিঠু তো অন্যদিকে প্রতিমা মুখের চটকদার আল্পনা গোস্বামী। সঙ্গে আবার নিষ্পাপ টগর ফুলের মতো মুখের নন্দিনী মালিয়া। তিনজনেরই এক প্রেমিক, জয় সেনগুপ্ত। সেই টানাপড়েনের গল্প। ছবি অত আলোচিত আজকাল না হলেও ছবিতে ‘ভাগ্যের চাকাটা তো ঘুরছে’ উৎপলা সতীনাথ জুটির সর্বকালীন হিট গান। সুলতা চৌধুরী ও সমর কুমারের নাচে-গানে লিপে।
জয়-মিঠু জুটির আরও এক রঙিন ছবি ‘দুজনে’। বাপ্পি লাহিড়ীর সুরে সর্বকালীন হিট গানগুলো যে ছবির, ‘প্রেম কীসে হয় কেউ কি জানে!’

মিঠুর শেষ ছবি ‘আশ্রিতা’ সুপার ডুপার হিট ছবি। কনওয়ালজিৎ নায়ক। ছবিতে কনওয়ালজিতের মায়ের ভূমিকায় ছিলেন মিঠুর বড়দিদিও।

‘আজা নয় রাজা, আনি নয় রানি, জানি জানি আমি জানি।’ মিঠুর লিপে গানটায় লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে ডুয়েট গেয়েছিলেন লোকসঙ্গীত শিল্পী পঙ্কজ মিত্র, আর এই গানটির কথা মিঠুর নিজের লেখা। কারণ ছবিটি মিঠু মুখোপাধ্যায়েরই প্রযোজনা।

তার পর আর দেখা গেল না মিঠুকে। রুপোলি পর্দা থেকে মিলিয়ে যান, মিডিয়া থেকেও সরে যান একেবারে।লাইমলাইট থাকতে থাকতেই সরে যাওয়া উচিত, সেটা বুঝেই হয়তো সরে যান।

বেহালা চৌরাস্তার বিবেকানন্দ নারী মহাবিদ্যালয়ে পড়েছিলেন মিঠু। তখনই সিনেমার নায়িকা রূপে সবার হার্টথ্রব। পুরুষদের শুধু নয়, নারীদেরও। কলেজে মিঠুকে দেখতেই ভিড় জমে যেত।

Image - বম্বেতে হিন্দি ছবি করতে যাওয়াই মিঠুর কাল হল! কেমন আছেন স্বয়ংসিদ্ধা মর্জিনা

মিঠুর দুই বোনঝি প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের নায়িকা হয়েছিলেন স্বল্প ট্যালেন্ট নিয়ে, পিসির নামের জোরেই। পিসির সঙ্গে মুখের মিল থাকার কারণে। একজন ঋতু দাস ‘এক পশলা বৃষ্টি’র নায়িকা আর শিল্পা দাস ‘মন মানে না’, ‘ভালোবাসা’ ছবির অভিনেত্রী। সবেতেই নায়ক বুম্বা। কয়েক বছর আগে ক্যানসার হওয়ায় মিঠুর বড় ভাইঝি ঋতু প্রয়াত হন।

টলিউডে যখন মিঠু প্রথম সারিতে, তখন এক প্রভাবশালী প্রযোজকের বাগদত্তা ছিলেন মিঠু। তাঁর প্রযোজিত ছবিগুলিতে মিঠুই নায়িকা হতেন। যদিও সে সম্পর্ক পরিণতি পায়নি। বর্তমানে মুম্বইয়ের বাসিন্দা মিঠু। বম্বেতে কেরিয়ার গড়তে গিয়ে আর কলকাতায় থিতু হননি। তবে মাঝেমধ্যেই তিনি কলকাতা আসেন। একসময়ের ব্যস্ততম নায়িকা আজও প্রিয় মানুষদের নিজ হাতে রান্না করে খাওয়ান। কিন্তু তাঁর কাছে মিডিয়ার দরজা বন্ধ।

Image - বম্বেতে হিন্দি ছবি করতে যাওয়াই মিঠুর কাল হল! কেমন আছেন স্বয়ংসিদ্ধা মর্জিনা

কেন মিঠু মুখার্জী (Mithu Mukherjee) অন্তরালে চলে গেলেন? কেন তাঁর কেরিয়ার থমকে গেল?

হিন্দি ছবি করতে বম্বে যাওয়াটাই কাল হয়েছিল মিঠুর। দুলাল গুহর ‘দো আনজানে’ ছবি দিয়েই বলিউডে তৈরি হয় অমিতাভ-রেখা জুটি। সেই দুলাল গুহর ‘খান দোস্ত’ হিন্দি ছবির অফার পেয়ে মিঠু লুফে নেন। পরপর কয়েকটি হিন্দি ছবিতে কাজ করেন মিঠু, কিন্তু তাঁর স্থান হচ্ছিল সেকেন্ড লিডে। একসময় তিনি বুঝতে পারলেন, হিন্দি ছবিতে তাঁর জায়গা হচ্ছে অকিঞ্চিতকর চরিত্রে। ফিরে এলেন কলকাতায়।

তবে বাংলায় ততদিনে মিঠুর প্রথম সারির আসন দখল করে ফেলেছেন মহুয়া রায়চৌধুরী। সবার ছবিতেই সাইন করছেন মহুয়া। মিঠুর প্রযোজক আনুকল্য আর কাজে লাগল না। আবার পাশাপাশি ত্রয়ী, থার্টিসিক্স চৌরঙ্গী লেন, বিষবৃক্ষ করে সবার নয়নের মণি হয়ে উঠেছেন দেবশ্রী রায়। অসিত সেনের ‘প্রার্থনা’ ছবিতে মৌসুমী ও দেবশ্রীর পাশে মিঠু এক বাঈজি চরিত্রে। অর্থাৎ বাংলাতেও লিড রোল থেকে মিঠু বঞ্চিত হচ্ছিলেন।

রঞ্জিত মল্লিক মিঠুর সঙ্গে তাঁর জুটি ভেঙে যাওয়ার কারণ হিসেবে মিঠুর বম্বে যাওয়াকেই দায়ী করেন। নয়তো রঞ্জিত-মিঠুর ‘স্বয়ংসিদ্ধা’ বম্বেতে অনুকরণ করে হিন্দি ছবি হয়। মিঠু পরবর্তী নায়ক জয় সেনগুপ্ত বা দীপঙ্কর দের সঙ্গেও জমাতে পারলেন না।

Image - বম্বেতে হিন্দি ছবি করতে যাওয়াই মিঠুর কাল হল! কেমন আছেন স্বয়ংসিদ্ধা মর্জিনা

তবু মিঠু মুখার্জীর প্রস্থান ছবি ফ্লপ করার কারণে নয়। বরং সংযম থেকেই জনপ্রিয়তা নিয়ে সসম্মানে সরে যান মিঠু। তার আগে নয়ের দশকে শেষ বার রংমশালের মতো জ্বলে ওঠেন মিঠু। সুপার ডুপার হিট করে মিঠু মুখার্জী অভিনীত ও প্রযোজিত ছবি ‘আশ্রিতা’। বাংলার প্রতিটি মহিলা এই ছবি হল হাউসফুল করে দেখেছিল। ভিসিআর যুগে ‘আশ্রিতা’ ছিল সর্বাধিক চাহিদার ছবি। মিঠুর কামব্যাক যে পরিমাণ হিট করে নায়িকা রোলে, তা আর কোনও নায়িকা পারেননি। সুচিত্রা সেনও না।

নার্গিসকে ভালবেসে আগুনে ঝাঁপ দেন সুনীল দত্ত, রূপকথার প্রেমকেও যেন হার মানান তাঁরা

You might also like