শেষ আপডেট: 19th January 2025 13:33
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ‘রাজকন্যা চিঠিতে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন?’
একটি মাত্র বাক্যে জবাবি-পত্র লিখেছিলেন মাধো রাও শিন্ডে, গোয়ালিয়রের মহারাজ। পাঠিয়েছিলেন বরোদায়, সায়াজিরাও গায়কোয়াড়ের দরবারে। যদিও চিঠিটি পাঠানো উচিত ছিল সায়াজির কন্যা ইন্দিরাকে। যিনি তাঁর পত্রে ‘প্রেম’ নয়, ‘অপ্রেমে’র বাসনা কবুল করেছিলেন। জানিয়েছিলেন, মাধো রাওয়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ে স্থির হয়েছে ঠিকই। কিন্তু অন্তর থেকে তিনি ভালোবেসে ফেলেছেন অন্য একজনকে। তিনি কোচবিহার রাজপরিবারের সন্তান। রাজরানি সুনীতি দেবীর মধ্যমপুত্র জিতেন্দ্র নারায়ণ। দিল্লি দরবারে আলাপ। তারপর সম্পর্কের সূত্রপাত এবং প্রেম। অতএব, মাধো রাও নন, জিতেন্দ্রকেই বিয়ে করতে চান তিনি।
বিশ শতকের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে এক বাগদত্তা তাঁর হৃদয়ের ব্যাকুল কথাটি স্পষ্টভাবে বলতে চেয়েছিলেন, বলতে পেরেছিলেন। গোয়ালিয়র-বরোদার রাজনৈতিক সম্পর্কের জটিলতা, বাবা-মায়ের তুমুল অসন্তোষ, পারিবারিক চাপ—কোনওকিছু ইন্দিরা দেবীকে টলাতে পারেনি। বিয়ে তিনি জিতেন্দ্রকেই করেছিলেন। যাঁর রাজত্বলাভের কোনও সম্ভাবনাই সেদিন ছিল না। কারণ, জিতেন্দ্রর দাদা রাজেন্দ্র নারায়ণ তখনও জীবিত। উত্তরাধিকারসূত্রে তিনিই সিংহাসনের ন্যায্য দাবিদার।
একরোখা মেয়েকে বিলক্ষণ চিনতেন সায়াজিরাও, চিমনাবাঈ। জানতেন ইন্দিরাকে রাজি করানো একপ্রকার অসম্ভব৷ তাই বাধ্য হয়ে মধ্যমপন্থা বেছে নেন তাঁরা। জানান, জিতেন্দ্রকে বিয়ে করতে চাইলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাক ইন্দিরা, কেউ তাকে আটকাবে না। কিন্তু এদেশে নয়, বিয়ের অনুষ্ঠান সারতে হবে বিদেশে। আর হ্যাঁ… বিয়ের দিন বরোদা রাজপরিবারের কেউ সেখানে উপস্থিত থাকবে না।
লক্ষ্মী ভিলা প্যালেসে বিলাস-ব্যাসনে বেড়ে ওঠা রাজকন্যা এভাবেই বাবা-মায়ের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। জিতেন্দ্রর হাত ধরে চলে যান সুদূর লন্ডন। লন্ডনের একটি হোটেলে বিয়ে করেন তাঁরা (অগস্ট, ১৯১৩)। সুনীতি দেবীর (জিতেন্দ্রর মা, কেশবচন্দ্র সেনের কন্যা) নির্দেশে ব্রাহ্ম মতে বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়।
বিশ শতকের অবরোধ ভেঙে এভাবেই দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিলেন ইন্দিরা দেবী। স্বামীর মৃত্যুর পর পাঁচ ছেলেমেয়েকে মানুষ করে তোলা, আত্মীয়দের সিংহাসন দখলের দুরভিসন্ধি ভেস্তে দিয়ে পিতৃহীন, নাবালক পুত্রের তত্ত্বাবধায়ক (রিজেন্ট) হিসেবে আস্ত রাজ্য নিয়ন্ত্রণ, দরবারে ঘনিয়ে ওঠা বিদ্রোহ দমন, আর্থিক মন্দার ঢেউ সামালানো—ইন্দিরা দেবীর কুশলী পরিচালন-দক্ষতায় শতাব্দীপ্রাচীন রাজত্ব তার গৌরব ধরে রাখতে সমর্থ হয়।
ব্যক্তিগত জীবনে যেমন ছকভাঙা, রুচির দিক দিয়েও ইন্দিরা দেবী ছিলেন অন্য ধাঁচের মানুষ। এখনকার চালু লব্জে যাকে বলা যেতে পারে ‘ট্রেন্ডসেটার’! জন্ম বরোদায়। সংসারজীবন কোচবিহারে। মৃত্যু মুম্বইয়ে। অথচ জীবনের একটা বড় অংশ তিনি কাটিয়েছেন বিদেশে (প্রধানত লন্ডনে)। শৈশব ও কৈশোরে পাশ্চাত্য শিক্ষায় বেড়ে উঠেছিলেন ইন্দিরা। তাই রাজ-সংস্কৃতির বনেদিয়ানা, সুমহান ঐতিহ্যের গরিমার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আধুনিকতা ও প্রগতিশীলতার অভিরুচি। চিন্তায়, দর্শনে, মননে এমনকি বেশভূষার ক্ষেত্রেও যার ছাপ স্পষ্ট লক্ষ করা যায়।
স্বামীর মৃত্যুর পর চিরাচরিত সংস্কারকে মেনে নিয়েই সাদা শাড়ি পরতে শুরু করেন ইন্দিরা। কিন্তু বৈধব্যকে ‘গ্রহণ’ নয়, যেন ‘বরণ’ করে নিয়েছিলেন তিনি। ফ্রান্স সফরে গিয়ে ইন্দিরার নজরে আসে এক অদ্ভুত কাপড়—শিফন। তখনও শিফন ফেব্রিকের চল ভারতে ছিল না। লিয়ঁ শহর ঘুরতে ঘুরতে এই বিশেষ ধাঁচের তন্তুর বুনন মনে ধরে তাঁর। সিল্ক থেকে বানানো; কিন্তু ঠিক সিল্কের মতো নয়। বুঝতে পারেন, এই কাপড় দিয়ে উন্নত ধরনের শাড়ি তৈরি করা যেতে পারে। তাই দেশে ফিরেই শিফনের অর্ডার পাঠান। তৈরি হয় শাড়ি। নিজে পরেন। একা হাতে একটা ঘরানার জন্ম দেন। ভারতে শিফন শাড়ির প্রচলন শুরু হয়। সিল্কের বিকল্প হিসেবে তা ধীরে ধীরে বাজার দখল করে। ইন্দিরা দেবীর বিভিন্ন পোর্ট্রেটে গলায় পান্নার নেকলেস, পায়ে হিরেখচিত জুতোর পাশাপাশি যে শ্বেতশুভ্র শাড়িটি পরে বসে থাকতে দেখা যায় তা আসলে শিফনের। মহারানির এই চিরায়ত ‘ফ্যাশন আউটলুক’কে সম্মান জানিয়ে ডিজাইনার সব্যসাচী মুখার্জি ২০১৩ সালে একটি লিমিটেড এডিশন শাড়ির সম্ভার তৈরি করেন।