শেষ আপডেট: 4th July 2024 18:41
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
'শ্রাবণের কালো যে মেঘ
তারে যদি নাম দাও "চণ্ডাল',
তা ব'লে কি জাত ঘুচিবে তার,
অশুচি হবে কি তার জল?'
'চণ্ডালিকা'-র যে প্রশ্নে কেঁপে উঠেছিলেন ধরিত্রীমাত্রা। শ্রাবস্তী নগরের বহিষ্কৃত চণ্ডাল-কন্যার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমাজের বর্ণবৈষম্য, লিঙ্গবৈষম্য, জাতপাতের প্রান্তিকতা তুলে ধরেছিলেন। এই ঘটনা আজও প্রাসঙ্গিক। রবীন্দ্রনাথের গুরুত্বপূর্ণ নৃত্যনাট্য 'চণ্ডালিকা'।
কিংবদন্তী নৃত্যশিল্পী অমলাশঙ্করের ১০৫ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে গত ২৮ শে জুন মমতাশঙ্কর ডান্স কোম্পানির পক্ষ থেকে 'চণ্ডালিকা' অনুষ্ঠিত হল রবীন্দ্র সদনে । নিবেদনে বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী মমতাশঙ্কর ও তাঁর 'উদয়ন' কলাকেন্দ্রের ছাত্রছাত্রীরা।
বাংলা তথা ভারতীয় নৃত্য জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র অমলাশঙ্কর। জন্ম ১৯১৯ সালের ২৭ শে জুন যশোরে। ১৯৩১ সালে ১১ বছর বয়সে অমলা নন্দী ইন্টারন্যাশনাল কলোনিয়াল এক্সিবিশনে যোগ দিতে প্যারিস যান। সেখানে তাঁর সঙ্গে উদয়শঙ্করের প্রথম দেখা। আলমোড়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঠিক করে দিল, নাচই অমলার ভবিতব্য আর উদয়শঙ্কর তাঁর ভবিষ্যৎ। উদয়শঙ্করের ডান্স ট্রুপে যোগ দেন তিনি। ১৯৪২-এ বিয়ে করেন তাঁরা। মমতাশঙ্কর ও আনন্দশঙ্করের গর্বিত জননী তিনি। পণ্ডিত রবিশঙ্কর তাঁর দেওর। উদয়শঙ্করের পরিচালনায় অমলা অভিনয় করেছেন ‘কল্পনা’ ছবিতেও। তিনি উমার চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকের মন জয় করে নেন। ২০১২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়েছিল ছবিটি। প্রায় ৯০ বছর বয়সে অমলাশঙ্কর নিজে গিয়েছিলেন কানে। লেখিকা,অভিনেত্রী,চিত্রশিল্পী, নৃত্যশিল্পী এবং অবশ্যই শ্রেষ্ঠ স্ত্রী ও সার্থক মা রূপে অমলা শঙ্কর বহুমুখী প্রতিভার ঈশ্বরী।
রবীন্দ্রসদনে অনুষ্ঠানের মুখবন্ধে অমলাশঙ্করের ছবিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন সপরিবারে মমতা শঙ্কর ও তাঁর স্বামী চন্দ্রোদয় ঘোষ। ছিলেন মণিপুরি ঘরানার পথিকৃৎ নৃত্যাঙ্গনা পূর্ণিমা ঘোষ এবং শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার। এই প্রথম দর্শকের সামনে অমলাশঙ্কর পুষ্পশ্রদ্ধা পেলেন তাঁর প্রদৌহিত্র-র হাত থেকে। মমতাশঙ্করের ছোট্ট নাতি প্রণাম জানাল বড় দিদাকে।
উদ্বোধনী নৃত্যে 'আকাশ ভরা সূর্যতারা' গানে নৃত্যপরিবেশন মন ভাল করে দিল। গানে ছিল প্রমিতা মল্লিকের 'বৈতালিক'। এরপর পর্দায় প্রদর্শিত হল উদয়শঙ্করের লেজেন্ডারি ছবি 'কল্পনা'। এতদিন পর বড় পর্দায় 'কল্পনা' দেখা এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। শিব-পার্বতী রূপে উদয়-অমলা যেন সত্যিকারের দেব-দেবী। উদযশঙ্কর ঘরানার নৃত্যশৈলি সময়ের থেকে কত এগিয়ে ছিল তা প্রমাণ করে দিল। আরো বোঝা গেল, উদয় শঙ্করের সমুদয় নৃত্য পরিকল্পনার মূলে অমলা শঙ্করের অনুপ্রেরণা এনে দিয়েছে তাঁর সাফল্য ।দ্বিতীয়ার্ধের অনুষ্ঠানে ছিল মমতাশঙ্কর ডান্স কোম্পানির 'চণ্ডালিকা', যা দেখতে হাউসফুল ছিল রবীন্দ্রসদন। দর্শকের বিশাল লাইন পড়েছিল বহু সময় আগে থেকেই।
মমতাশঙ্করের পরিচালনায় 'চণ্ডালিকা' সে তো রত্নখনি দর্শন। 'চণ্ডালিকা' উদয় শঙ্কর নৃত্যঘরানায় প্রথম কোরিওগ্রাফি করেছিলেন উদয়শঙ্কর নিজেই। তারপর ১৯৭৯ সালে মমতা শঙ্কর প্রথম কোরিওগ্রাফি করেন 'চণ্ডালিকা'। উদয় শঙ্কর ঐতিহ্য রেখেই মমতা নিজের সিগনেচার মার্ক রাখেন। কিন্তু তখন কপিরাইট থাকার হেতু বিশ্বভারতীর থেকে অনুমোদনের দরকার হত। এই 'চণ্ডালিকা' অনুমোদন করাতে মমতাশঙ্করকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। বারেবারে এই প্রোডাকশন মঞ্চস্থ করেছে মমতাশঙ্কর ব্যালে ট্রুপ। হয়েছে নতুন সংযোজন। কিন্তু মূলধারার বদল করেননি মমতা। ২০২৪ সালে এসে ৪৫ বছর পূর্ণ করল মমতাশঙ্করের 'চণ্ডালিকা'। মমতাশঙ্করের নাচে পাশ্চাত্য প্রভাবের থেকেও বেশি প্রাচ্য প্রভাব। ইদানিং কালের পাশ্চাত্য নাচের থেকে শতভাগ দূরে থাকেন তিনি। পাশ্চাত্য অনুকরণ করে না বসিয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের স্পর্শ রাখতেই ভালবাসেন মমতাশঙ্কর। নব্বই দশকে এই রবীন্দ্রসদনে 'ডান্সারস গিল্ড'-র নিবেদনে মঞ্জুশ্রী চাকি সরকার ও রঞ্জাবতী সরকারের 'চণ্ডালিকা' মুগ্ধ করেছিল আমাকে। সেই নাচে পাশ্চাত্য থেকে আফ্রিকান প্রভাব অনেক বেশি। কিন্তু মমতা হাঁটলেন দেশীয় নৃত্যশৈলীর সনাতনী ছন্দে।
মমতাশঙ্করের 'চণ্ডালিকা' এক দশক আগে যখন দেখেছিলাম তখন মমতা প্রকৃতির মায়ের ভূমিকায় দাপট দেখিয়েছিলেন। কালো লাল পোশাকে খোলা চুলে চমকে দিয়েছিলেন তিনি। এবারও সেই রূপ দেখব ভেবেই গেছিলাম মমতাশঙ্করের আমন্ত্রণে। কিন্তু তিনি নতুন চমক আমাদের জন্য রাখছেন কে জানত। চন্দ্রোদয় ঘোষ ঘোষনায় বললেন মমতাশঙ্কর থাকছেন এক বিশেষ ভূমিকায়। মঞ্চে পীত বসনে, বুদ্ধের মতো জটার চুড়ো মাথায়।যেন স্বর্গীয় আবির্ভাব তাঁর মঞ্চে। তিনি এবার 'চণ্ডালিকা'র আনন্দ। কলকাতার দর্শক প্রথম মমতাকে দেখল আনন্দ রূপে। নারী চরিত্রে নয়, বৌদ্ধ সাধকের রূপে বিরাজমান মমতাশঙ্কর। আনন্দ রূপে মমতার কন্ঠে তাঁর স্বামী চন্দ্রোদয় ঘোষ। যেটি ছিল আরো এক চমক।
'জল দাও আমায় জল দাও' বলে মমতা যখন মঞ্চে প্রবেশ করছেন অনেকেই চিনতে পারেননি প্রথমে, ইনিই সবার প্রিয় মমতাশঙ্কর।
'যে মানব আমি সেই মানব তুমি কন্যা।
সেই বারি তীর্থবারি
যাহা তৃপ্ত করে তৃষিতেরে,
যাহা তাপিত শ্রান্তেরে স্নিগ্ধ ক'রে
সেই তো পবিত্র বারি'
জলের কোন জাত হয়না। জলের অপর নাম যে জীবন।
চণ্ডালিকার ভূমিকায় শ্রেয়া ও মায়ের ভূমিকায় অমৃতা। চণ্ডালিকার গানে প্রয়াত রমা মণ্ডল ও মায়ের গানে প্রমিতা মল্লিক। বহুদিন পর রবীন্দ্রসদনের মঞ্চে প্রয়াত শিল্পী রমা মণ্ডলের কন্ঠে চণ্ডালিকার গান মন ছুঁয়ে গেল। নাচে মা-মেয়ে শ্রেয়া ও অমৃতার যুগলবন্দী দুর্দান্ত। তবে মায়ের দাপটে অমৃতাকে একটু বেশি এগিয়ে রাখব। যে কথা বেশি করে বলার যারা সমবেত নাচলেন তাঁদের নাচ ও কোরিওগ্রাফি বেশি করে মন কাড়ল। উদয়শঙ্করের নৃত্যশৈলী দলগত নাচে প্রকাশ পেল বেশি। সখীদের মধ্য নাচে নজর কাড়লেন সৌরিতা শঙ্কর ঘোষ।
'জাগে নি এখনো জাগে নি/ রসাতলবাসিনী নাগিনী।
বাজ্ বাজ্ বাজ্ বাঁশি,বাজ্ রে মহাভীমপাতালী রাগিণী
জেগে ওঠ্ মায়াকালী নাগিনী -'
মায়ের মায়ামন্ত্র পড়ার দৃশ্য গুলিতে কোরিওগ্রাফি ও আলোকসম্পাত এতটাই দুর্দান্ত যা গায়ে কাঁটা দেয়। পোশাক পরিকল্পনা খুব সুন্দর । আলোর খেলায় কঙ্কাল পোশাক দেখে হাউসফুল রবীন্দ্রসদন হাততালি দিয়ে উঠল। নাগপাশ বন্ধনমন্ত্রে মায়ের মুখে প্রেতদাঁতের প্রয়োগ এই প্রথম দেখে চমকে উঠলাম। হাড়হিম উপস্থাপনা চমকপ্রদ। আলোক প্রক্ষেপনে রাতুলশঙ্কর ঘোষের ভূমিকা অনন্য। তাঁর আলোর গুণেই প্রোডাকশনটি ঐশ্বরিক হতে পেরেছে।
'প্রভু, এসেছ উদ্ধারিতে আমায়,
দিলে তার এত মূল্য, নিলে তার এত দুঃখ'
সমাপ্তিতে যেন শান্তির জল ছড়িয়ে দিলেন আনন্দ মমতা শঙ্কর দু হাত তুলে 'কল্যাণ হোক তব, কল্যাণী' আশীর্বাদে।
অনুষ্ঠান শেষে ব্যক্তিগত সাক্ষাতে মমতাশঙ্কর দ্য ওয়াল-কে বললেন, "১৯৭৯ সালে শুরু করেছিলাম এই 'চণ্ডালিকা'। প্রথমে আমিই হতাম প্রকৃতি চণ্ডালিকা । তারপর করলাম মায়ের ভূমিকা। এবার এলাম আনন্দের ভূমিকায়। জীবনের প্রতি পর্বে আমিও বদলে বদলে নিচ্ছি নিজেকে।"
দৌড়ে এসে আনন্দ মমতার গালে গাল ঠেকিয়ে আদর করলেন মণিপুরী চিত্রাঙ্গদা পূর্ণিমা ঘোষ।
নায়িকার ভূমিকা থেকে সরে গিয়েও যে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকা যায় তা বুঝিয়ে দিলেন মমতাশঙ্কর। আনন্দ রূপে পীতবসন পরা সন্ন্যাসী মমতাশঙ্করকে দেখতে পরবর্তী কোথাও এই প্রোডাকশন হলে অবশ্যই দেখতে হবে।
'বুদ্ধো সুসুদ্ধো করুণামহাণ্নবো
যোচ্চন্ত সুদ্ধব্বর-ঞানলোচনো।
লোকস্স পাপূপকিলেসঘাতকো।
বন্দামি বুদ্ধম্ অহমাদরেণ তম্॥'
কৃতজ্ঞতা - অভিজিত শ্রী দাস