
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
‘পিত্তি দিয়ে গাঁথব মালা, পচা রজনীগন্ধার,
মিলব যেদিন চারজনেতে আমি, পেদো, কালা, মন্দার … ‘
শেক্সপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’-এর নির্যাস নিয়ে তৈরি অনির্বাণ ভট্টাচার্য পরিচালিত ওয়েবসিরিজ ‘মন্দার’। সাম্প্রতিক কালে সবথেকে চর্চিত ‘মন্দার’-এর দুই ডাইনি হল, মজনু বুড়ি ও তাঁর ছেলে পেদো। সিরিজের সম্পদ তারা। আর বাংলা অভিনয়ের নতুন সম্পদ এই দুই চরিত্রে অভিনয় করা সজল মণ্ডল ও সুদীপ ধাড়া। সজল ও সুদীপকে অভূতপূর্ব রূপটান দিয়ে চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম করেছেন মেক আপ শিল্পী সোমনাথ কুন্ডু।
মন্দারের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি বলা যায় ম্যাকবেথের তিন ডাইনির বঙ্গ-রূপ। তিন ডাইনি হয়ে গেছে মা মজনু বুড়ি, ছেলে পেদো এবং পোষ্য বেড়াল কালা। তবে মজনু বুড়ি আর পেদো আজ যতই লাইমলাইটে থাক, এই দুই চরিত্রের পেছনে থাকা দুই লড়াকু থিয়েটারশিল্পীর জীবনযুদ্ধের গল্পও কিন্তু কম রোমহর্ষক নয়। এমন দুটি বর্ণময় চরিত্র করতে কোথা থেকে এল তারা! সিরিজের সঙ্গেই আলোচিত হতে পারে সে গল্পও।‘কে হবে রাজা, কে রাজার বাপ…’
গেইলপুর। নোনাসাগরের কোল ঘেঁষে জেলেদের এক মৎস্যনগরী, যে গ্রামকে কেন্দ্র করেই ‘মন্দার’ ওয়েবসিরিজের পাঁচটি পর্বের গল্প। উইলিয়ম শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথের গল্পকে অনির্বাণ ভট্টাচার্য এনে ফেলেছেন নিম্নবিত্ত উপকূলবর্তী মানুষদের জীবনকাব্যে।আদিম যৌনতা, লোভ, মোহর খেলা যেন এই গল্প। কেউ চায় রাজা হতে, কেউ রাজার পিতা, কেউ চায় সন্তান, কেউ চায় সন্তানের মঙ্গল, কেউ চায় ক্ষমতা। আর এসবের মাঝে গেইলপুরের লোকেদের ভাগ্য নির্ধারণ করে ডাইনি এক বুড়ি, তার ন্যাড়া ছেলে ও তাদের পোষ্য কালো বেড়াল।
গেইলপুর নামটা এখন মন্দারের দৌলতে ভীষণ রকম চর্চায়। কিন্তু আদতে গেইলপুর বলে কোনও জায়গার অস্তিত্ব নেই। এটি একটি কাল্পনিক জায়গা। মন্দারের শ্যুটিং হয়েছে মন্দারমণি ও তাজপুরের উপকূলবর্তী এলাকায়। মন্দারের নামভূমিকায় দেবাশিস মণ্ডল ও তাঁর স্ত্রী লাইলির ভূমিকায় সোহিনী সরকার। দু’জনেই নাড়িয়ে দিয়েছেন অভিনয়ে। বহুদিন পর অভিনয়ে ফিরলেন দেবেশ রায়চৌধুরী, ডাবলু ভাই হয়ে। শঙ্কর দেবনাথ (বঙ্কা), লোকনাথ দে (মদন), সুমনা মুখোপাধ্যায়ও (ডাবলু ভাইয়ের স্ত্রী) দুরন্ত।
তবে সবাইকে ছাপিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে ইন্ডাস্ট্রির মন কেড়ে নিয়েছেন ডাইনি মজনু বুড়ি আর পেদো। এতদিন এই দুই অভিনেতাকে সেভাবে মানুষ না চিনলেও, ‘মন্দার’-এর পর এই দুটি চরিত্র সবথেকে আলোচনায়। থিয়েটার থেকে উঠে আসা এই দুটো মানুষের বাস্তব জীবনের পরতে পরতেও জড়িয়ে আছে নানা সংগ্রাম। তাই হয়তো ওঁরা এমন অনবদ্য হয়ে উঠেছেন চরিত্রের আয়নায়!
আমির খানের জায়গায় অভিনয় করেছিলেন মজনু বুড়ি!
‘আকাশ যখন ডাকে, চাতক তাকায়ে থাকে…’
হাঁটু অবধি সাদা শাড়ি, সাদা-ঘিয়ে মেশানো এলোকেশ, কপাল মাখা লাল সিঁদুর। বিগতযৌবনেও তেজ এতটুকু কমেনি। যেন দশমহাবিদ্যার ধূমাবতী রূপ তাঁর। অথচ সে দেবী নয়, ডাইনি। গেইলপুরের ডাইনি। শেক্সপীয়রের প্রথম ডাইনি চরিত্রের নবতম রূপ মজনু বুড়ি, যাঁর মুখের কথাই যেন গেইলপুরের বাসিন্দাদের নিয়তি নির্ধারণ করে!বৃদ্ধা মজনু বুড়ির চরিত্র কেমন করে করলেন বছর চল্লিশের অভিনেতা সজল মণ্ডল ওরফে পচাদা? একজন পুরুষ হয়েও বৃদ্ধার চরিত্রে অভিনয় করাটা কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল? জানালেন মজনু সজল নিজেই।
“মন্দারে মজনু বুড়ির চরিত্রে অনির্বাণ যে আমাকে ভেবেছে এবং আমার অভিনয় যে এত মানুষের ভাল লাগছে তা আমার পরম প্রাপ্তি। তবে আমি এই চর্চায় উচ্ছ্বসিত নই, কারণ এই রুপোলি জগতের চড়াই-উতরাই আমার দেখা। আজ থেকে কুড়ি বছর আগেও আমি চলচ্চিত্র, টেলিভিশন ও বিজ্ঞাপন জগতের মুখচেনা আর্টিস্ট ছিলাম। সেসব থেকে সরে গেলেও আমি অভিনয় ছাড়িনি। এই জগতে তো লাইমলাইট চিরকাল থাকে না। জীবনযুদ্ধে পোড় খাওয়া মানুষ বলেই আমি খুব একটা ভেসে যাই না। আমি কাজ করে যেতে চাই, দর্শকদের কাজ উপহার দিয়ে যেতে চাই।
থিয়েটারকে কেউ ডমিনেট করতে পারে না: অনির্বাণ ভট্টাচার্য
আমি সুন্দরবনের ছেলে। বাসন্তীতে আমার বাড়ি। আমাদের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল ছিল না। বাবা, মা বাংলাদেশ থেকে অনেক আগে আসা মানুষ। ভাড়া বাড়িতে থাকতাম। রাস্তার ধারে বাবা একটা মুদির দোকান করেছিলেন, সেটাই ছিল আমাদের একমাত্র উপার্জনের উৎস। যদিও বাবা ওখানে বাজারের মধ্যে আজ একটা বড় দোকান করেছেন। কিন্তু সে সময়ে এইরকম পরিবারের ছেলে হয়ে, অভিনয় করে, নাটক করে পেট চালানোটা চাপের ব্যাপার ছিল। কিন্তু আমার মা খুব মুক্তমনা মহিলা ছিলেন।অভিনয়ের প্রতি প্যাশনটা ছিল ছোট থেকেই। আমরা স্কুলজীবনে নিজেরা নাটক করেছি। ১৯৯৮ সালে আমি সুন্দরবন থেকে মাধ্যমিক পাশ করে কলকাতায় চলে আসি কাজের খোঁজে। এখানে এসে হঠাৎই একদিন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাটকের কোর্সে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে ভর্তির ফর্ম তুলি এবং চান্সও পেয়ে যাই। কিন্তু কলকাতা শহরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকার মতো সামর্থ আমার ছিল না। তাই বারুইপুরের মল্লিকপুরে বাড়ি ভাড়া নিই। সঙ্গে ছোটখাটো নানা কাজ করতাম ওই অঞ্চলেই।
‘আমার শিল্পবোধটা একান্তই আমার, সেটা আমাকেই গড়ে তুলতে হবে’
রবীন্দ্রভারতীতে জোড়াসাঁকো ক্যাম্পাসে পড়তে পড়তেই আমি একটা সিনেমায় অভিনয় করার অফার পেয়েছিলাম। সত্যজিৎ রায় ফিল্ম ইন্সটিটিউটের এডিটিং প্রফেসর শ্যামল কর্মকারের চিলড্রেন রাইটসের উপর ছবি ‘রাণু’র লিড রোল। এই আমার রোলটাই প্রথমে আমির খানকে কাস্টিং করা হয়েছিল, উনি করতেও রাজি ছিলেন কিন্তু কোনও কারণে ডেট দিতে পারেননি। আমি সেই সুযোগটা পাই। ২০০১ সালে ‘রাণু’ ছবিটা পুরস্কৃত ও প্রশংসিত হয়েছিল। ফেস্টিভালেও আসে ছবিটা এবং সংবাদপত্র রিভিউতে আমার নামও বেরোয়।সেসময় বেশ কিছু কাজের অফার পরপর পাই। তখন ইটিভি বাংলা, আকাশ বাংলা এসব চ্যানেলে রাতের টেলিছবি খুব জনপ্রিয় ছিল। সেখানে ‘বিস্ফোরণ’ বলে একটা টেলফিল্মে অভিনয়ও করি।
রবীন্দ্রভারতী থেকে টুয়েলভ পাশ করে স্নাতকে ভর্তি হই, তার পর নাটকে এমএ-ও পাশ করি। অন্যদিকে, ২০০২ সাল থেকে থিয়েটারের সঙ্গেও আমি জুড়ে যাই। নাট্যকার শান্তনু বসুর দলে যোগ দিই। থিয়েটার করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরেও কাজ করেছি ইন্দো-জার্মান, ইন্দো-আফগান মঞ্চ। সে সময়ে নানারকম কাজের দরজা খুললেও অর্থনেতিক ভাবে তেমন মজবুত হতে পারিনি। অনেক আপস করতে হয়। বিদেশের ডান্স কোরিওগ্রাফি বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাপ্লাই করেছিলাম, কিন্তু এখান থেকে স্কলারশিপ না পাওয়ায় তিন মাস পরে ফিরে আসতে হয়।
এখানে দর্শক গ্রিনরুমে ঢুকে পড়ে, যা কোনও সভ্য দেশে হয় না: অনির্বাণ
এর পর ২০০৮ সালে ‘ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা’-তে সুযোগ পাই। ডিজাইন টেকনিক নিয়ে পড়াশোনা করি। ওটা যেন আমার স্বপ্নরাজ্য ছিল। অনুরাধা কাপুর, আদিল হুসেনের মতো শিক্ষকদের পেয়েছি। পাশ করে ফের সুন্দরবন ফিরে আসি। সুন্দরবনে প্রথম আমি ‘ম্যানগ্রোভ থিয়েটার সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করি ও বনবিবি পালা নির্দেশনা দিই। আমি সুন্দরবনে সমাজমূলক কাজেও জড়িত। আয়লা থেকে আমফান পর্যন্ত বহু কাজ করেছি। লোকশিল্পীদের সবরকম সাহায্য করি। এছাড়াও মহিলাদের মধ্যে মেনস্ট্রুয়াল সচেতনতা নিয়ে কাজ করি।অনির্বাণ ভট্টাচার্য রবীন্দ্রভারতীতে আমার এক বছরের জুনিয়র ছিল। অনির্বাণ সেভাবে আমার নাটকের শো দেখেনি কখনও। তবে আমি তো নাটকের ক্লাসে ডিরেকশন দিতাম, সেগুলো ও দেখেছে। তারপর অনির্বাণ, ওর স্ত্রী মধুরিমা লকডাউনের সময়ে আমাদের সুন্দরবনে এসেছিল লোকাল আর্টিস্টদের সাহায্য করতে।
এর পরে অনির্বাণ যখন মন্দারের ডাইনি বৃদ্ধার চরিত্র আমাকে করতে বলল, সেটা করতে গিয়ে আমি আমার পর্যবেক্ষণগুলো কাজে লাগালাম। ট্রেনে আমি অনেক নিম্নবিত্ত বৃদ্ধাদের দেখেছি যারা দেখতে অনেকটা পুরুষ প্রকৃতির হয়ে যান বয়সকালে। এখানেও মেক আপ আর্টিস্ট সোমনাথদা ও তাঁর সহকারীরা আমায় সেভাবেই সাজিয়েছেন। একজন বৃদ্ধার সে অর্থে ভরা স্তন থাকে না, তাই এখানেও সেটা নেই। আর আমার মুখে প্রস্থেটিক মেক আপের ব্যবহার হয়েছে। অনির্বাণ দেখে বলল ‘বাহ ঠিক আছে সজলদা!’কন্ঠস্বর, শব্দোচ্চারণ নাটকের মতো করেই করেছি। ফুলসজ্জার স্বপ্নদৃশ্যটা অনির্বাণ বলেছিল, ‘পচাদা তুমি নিজের মতো করো।’ তাই করেছি। শাড়ি পরে যে অভিনয় করেছি, সেটা এই ভেবেই করেছি যে একজন থিয়েটার আর্টিস্টকে সবরকমের রোল করতে হয়। যেভাবে মজনু বুড়িতে অনির্বাণ আমাকে কাস্টিং করেছে সেটা আমার সৌভাগ্য। কিন্তু পরবর্তীকালে অন্য পরিচালকরা কি আমাকে সেভাবে ব্যবহার করবেন? জানি না।তাই একবার খাদ থেকে উঠে আজ এখানে পৌঁছেও খুব উচ্ছ্বসিত হতে পারি না আমরা। ২০০২-০৩ সালে বিজ্ঞাপন নির্মাতা অমিত সেনের সঙ্গে বহু কাজ করেছি। ওই সময় আমিও সেলেব্রিটি ছিলাম। টিভি খুললে আমায় দেখা যেত। অভিনেতা ভোলা তামাং আর আমি বম্বে গেছিলাম ‘পার্লে চয়েস মারি’ বিস্কুটের বিজ্ঞাপনে। মটন মশা মারার ধূপ, তুমি ক্যান্ডি– অনেক বিজ্ঞাপন ছিল তখন আমার। সে সময় অভীক মুখার্জীর পরিচালনায় ঋতুপর্ণ ঘোষ দুর্গাপুজো নিয়ে একটা তথ্যচিত্র করেন, সেই ছবিতে আমি অভিনয় করি। লাহা বাড়িতে শ্যুট হয়। তবে অনেক কাজ করেও প্রচারের আলো পাইনি। ‘মন্দার’ এর পরে কী হয়, সেটাই দেখার।”
তাবড় অভিনেতাদের মাঝে জুনিয়র পেদো আজ স্টার
‘রাক্ষস চায় মাংসের স্বাদ
কী বা পুণ্য, কী বা পাপ
এই সাগরের পাড়ে
পুঁতে রেখেছে কতকে
গেইলপুরের কোন দানবী
শিকার খোঁজে রাতে…’
পরিচালক অনির্বাণ ভট্টাচার্য সুদীপকে বলেছিলেন, ‘তুই কি লাঠি দিয়ে টায়ার ঘোরাতে পারিস আর সাঁতার কাটতে পারিস?’ সুদীপ বলেছিল ‘পারি’। কে জানত, ছেলেবেলায় বন্ধুদের সঙ্গে টায়ার ঘোরানোর খেলা তাকে সারা বিশ্বে আলোচিত করে তুলবে! তখনও সে জানতই না, তার জন্য অপেক্ষা করছে ম্যাকবেথের একটি স্বপ্নের চরিত্র।
উত্তর কলকাতার বিডন স্ট্রিটের এক জরাজীর্ণ ভাড়া বাড়িতে থাকেন সুদীপ ধাড়া। সেখানেই কেটেছে ছেলেবেলা। সুদীপের বাবা আগে ব্যবসা করতেন, সেটা উঠে যেতে এখন ছোট একটা চাকরি করেন। অভাবের সংসারে তবু ছেলেকে পড়িয়েছেন স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুল থেকে। তার পর সুদীপ বিকম পাশ করেছে।অভাবের মাঝেও আলো পেয়েছে প্রতিভা। ছোটবেলা থেকেই খুব কথা বলত সুদীপ। বলতে গেলে সে জন্যই চার বছর বয়স থেকে শুরু নাটকের তালিম। তবে কুড়ির কোঠায় এসে সুদীপ বোঝেন, শুধু নাটক করে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকা যাবে না। তাই পাশাপাশি গ্রাফিক্স ডিজাইন শিখেও কাজ শুরু করেন তিনি। পসার জমেনি সেখানে। তবু বাবা-মার নিরন্তর সহযোগিতা আর নাট্যদল ‘বিডন স্ট্রিট শুভম’ সুদীপকে করে তুলেছে আজকের পেদো।
মির্নাভা থিয়েটারের কাছেই ‘শুভম’ নাট্যদল। এখানেই একদিন অনির্বাণ ভট্টাচার্য তাঁর নাটকের জন্য এসেছিলেন, এক কিশোর অভিনেতার খোঁজে। অনির্বাণ তখন এমএ পড়ছেন, স্টার হয়ে ওঠেননি। সেখানে তিনি তখনই বেছে নেন সুদীপকে। যদিও সে নাটক আর বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু এতদিন পরে মন্দার হল। তাতেই সেই সুদীপ পেদোর রোল করে আজ সকলের চর্চায়। তাবড় অভিনেতাদের মাঝেও সবথেকে জুনিয়র, রোগা-পাতলা, ২৫ বছরের সুদীপ আজ স্টার। তিনিও বললেন নিজের কথা।
“আমার যা রোগা-পাতলা চেহারা, তাতে আমার পক্ষে কোনও নায়ক বা ভিলেন চরিত্র কখনও পাওয়া সম্ভব হতো না। যদিও আমি নাটকের ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে উঠে এসেছি। আমি অনির্বাণদার কাছে কৃতজ্ঞ এমন একটা ডাইনি পেদোর চরিত্রে আমায় কাস্ট করার জন্য। আমি তো এখনও বিশ্বাসই করতে পারছি না, যে আমার মতো অনামী একটা ছেলেকে নিয়ে লোকে এত আলোচনা করছে।‘মন্দার’ আমার প্রথম ওয়েবসিরিজ নয়। এর আগে দেবালয় ভট্টাচার্যর ‘বৌ কেন সাইকো’ আর ‘মন্টু পাইলট’-এ সৌরভ দাসের বন্ধুর চরিত্র করি। তবে পেদো সকলের চেয়ে আলাদা। চরিত্রটার অদ্ভুত বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, লাফঝাঁপ দিয়ে হাঁটা, নাচ করা– এসব অনির্বাণদা আমাকে আমার মতো করেই করতে বলেছিল। এই যে ছবিতে আমার কিম্ভূতকিমাকার হাঁটার স্টাইল নিয়ে লোকে এত চর্চা করছে, সেটা আমি বিডন স্ট্রিটেই কোনও এক বাচ্চা ছেলেকে হাঁটতে দেখেছিলাম। কলকাতা শহরের সেই সব দেখা, দৃশ্য, উপকূল অঞ্চলের লোকরা করলে কেমন হবে সেইটা ভেবে নিজে নিজেই সব করেছি ছবিতে। যা করতাম, সারা লকডাউন জুড়ে অনির্বাণদাকে ভিডিও করে করে পাঠিয়েছি। কোনওটা বলত ভাল, কোনওটা বলত বাদ। এভাবেই জীবন থেকে গড়েছি পেদোকে।
এছাড়া ছড়া বা গেইলপুরের যে ভাষায় সংলাপ বলছি সেটা সম্পূর্ণ চিত্রনাট্যকার প্রতীকদা ও অনির্বাণদার কৃতিত্ব। সেই সঙ্গে আমার অভিনয় আরও প্রাণ পেয়েছে সোমনাথদার মেকআপের গুণে। যেদিন প্রথম লুক টেস্ট ছিল, সেদিন প্রথমেই আমার মাথা ন্যাড়া করে শুধু একটা ন্যাঙোট পরিয়ে খুব নোংরা দেখতে লাগার মতো প্রস্থেটিক মেক আপ করানো হল। নিজেকে দেখে নিজেই চমকে গেছিলাম। কিন্তু আমরা থিয়েটারের ছেলেরা তো সব করতে পারি।”
মেকআপ কৃতিত্ব আমার নয় আমার সহকারীদের: সোমনাথ কুন্ডু
মন্দারের ডাইনিরা এত রোমাঞ্চকর হয়ে উঠত না, যদি না তাদের রূপটান দিতেন প্রখ্যাত মেকআপ আর্টিস্ট সোমনাথ কুন্ডু। বর্তমানে তাঁর হাতেই সবথেকে ভাল খেলে প্রস্থেটিক মেকআপ। সোমনাথ কুণ্ডুও কথা বললেন দ্য ওয়ালের সঙ্গে।
পেদো সুদীপের যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না! জরাজীর্ণ ভাড়াবাড়ি থেকে মন্দারের লাইমলাইট
“মন্দারে সকলের মেকআপের দায়িত্ব আর লুক সেট আমার হাতে করা। ডাইনিদের লুক সেটও আমিই করে দিয়েছিলাম। কেমন হবে লুকগুলো, সেটা অনির্বাণ আমার উপরেই ছেড়ে দিয়েছিল। আমার দেখানো লুকেই মেক আপ হয়েছে।যখন শ্যুটিংয়ে গেলাম, ছ’দিন শ্যুট করে আমার পক্স হয়েছিল। তাই আমি পুরো শ্যুটিংটায় থাকতে পারিনি, বাড়ি চলে আসতে বাধ্য হই। পুরো দায়িত্বটা সামলেছেন আমার তিনজন সহকারী মেকআপ আর্টিস্ট, শানু সিংহরায়, আনন্দ হাজরা ও তন্ময় সুবীর রায়। পুরো কৃতিত্বটা আমি ওদেরই দেব। অনেকেই দেখছি রিভিউতে আমার প্রশংসা করছেন, যেহেতু টাইটেল কার্ডে আমার নাম আছে। কিন্তু কাজটা আসলে আমার সহকারীদের হাত থেকে বেরিয়েছে। কস্টিউম করেছে সঞ্চিতা। আমি এখানেই বলার সুযোগ পেলাম বিষয়টা।
ডাইনি বুড়ির হেলদোল নেই কোনও, খ্যাতি পেয়েও খাদে পড়েছিলেন সজল
আমি প্রথমে স্ক্রিপ্টটা পড়ি। তারপর একটা লুক ভেবে পরিচালককে দেখাই। যেমন মজনু বুড়ির ব্রেস্ট রাখতে চেয়েছিলাম প্রস্থেটিক করে। কিন্তু অনির্বাণ বলল না ব্রেস্ট চাই না, পুরুষসুলভই থাক। সজলদার মতো গুণী শিল্পী যেভাবে মজনু বুড়ি সাজাতে আমাকে সাহায্য করেছেন, তা তুলনাতীত। সুদীপ পেদোর নাক দিয়ে সর্দি গড়াচ্ছে লুক ছিল, ওই সর্দিটা করেছিলাম পাকা কলা দিয়ে। মেক আপ ক্যারি করাও কিন্তু বড় ব্যাপার। সজলবাবু আর সুদীপ মেক আপ নিয়ে দুরন্ত অভিনয় করেছিল বলেই সবটা এত ভাল হল। অনির্বাণকে অভিনেতা হিসেবে প্রথম মেক আপ করেছিলাম অপর্ণা সেনের ‘আরশিনগর’ ছবিতে। তারপর ওর সঙ্গে সাত-আটটা ছবি করেছি। অনির্বাণ প্রথম পরিচালনা করতে এসে মেক আপের জন্য আমায় ভরসা করেছিল, এটা বড় প্রাপ্তি।”
বম্বে থেকে এল কালা
‘মিলব যেদিন চারজনেতে আমি, পেদো, কালা, মন্দার… ‘
মন্দারে আছে কালো একটি বিড়াল, কালা। সে মজনু বুড়ির পোষ্য। সেই বিড়াল নিয়ে মজনু বুড়ি সজল জানালেন, বিড়ালটাকে বম্বে থেকে আনা হয়েছিল। সে আগেও অনেক অভিনয় করেছে, ভীষণ দামী বিড়াল! আমরা যা পারিশ্রমিক পেয়েছি, বিড়ালটার পারিশ্রমিক তার চেয়ে অনেক বেশি। বিড়ালটার একজন ট্রেনার ছিলেন।বিড়ালটাকে যে ছবিতে বিভিন্ন কাজ করতে দেখা যাচ্ছে, সেটা ওকে খাবার দেখিয়ে করানো হয়েছিল। ও খুবই কুল বিড়াল। কামড়ায় না। তবে শট দিতে দেরি করে আর কী, তাই আমাদের সবাইকে ওর জন্য অপেক্ষা করতে হত। শেষ দৃশ্যে যেখানে বিড়ালটা মন্দারের গায়ের উপর দিয়ে আসছে, সেটাও করানো হয়েছে সাত-আটটা টেকে।
বিড়াল কালাকে নিয়ে মায়ে-পোয়ে খুব খুনসুটি চলত সজল আর সুদীপের। পেদো সুদীপ জানালেন, তিনি বিড়াল খুব ভয় পান বাস্তবে। কিন্তু মন্দারে সে ভয় কাটিয়ে তাঁকে কাজ করতে হয়েছে। কাঁকড়াও ধরতে হয়েছে। এতে পাশ করে তিনি বেশ খুশি।
তবে চতুর্থ ডাইনি কে?
Fair is Foul, Foul is Fair…
মন্দারের তিন ডাইনির পরও কি আছে কোনও চতুর্থ ডাইনি? দর্শকরা কি বুঝতে পেরেছেন কে মন্দারের চার নম্বর ডাইনি? সে কখনও বিবেক হয়েও দাঁড়ায় অপরাধীদের সামনে আবার কখনও তার কার্যকলাপ দেখে ঘেন্না লাগে। মোক্কাদার মুখার্জী, যার চশমা পরা লুক কিছুটা যেন মনে করায় ‘থানা থেকে আসছি’র তিনকড়ি হালদার উত্তমকুমারকে।সজল মণ্ডল বলছেন “আমি যদি বলি অনির্বাণের রোলটা কেমন লাগল? বিড়ালের সঙ্গে ওর প্রথম চোখাচোখি দিয়ে শুরু। ওর মধ্যে একটা মেয়েলি ভাব আছে, নরম প্রকৃতির। আবার সেই কখনও ঘৃণ্য কাজ করে। আমাদের সমাজে যদি আমরা একটু চোখ খুলে রাখি তাহলে অনেক কিছু রিলেট করতে পারি। আমি অনির্বাণকে জিজ্ঞেস করিনি, এটা আমার নিজস্ব অবজারভেশান। কেউ বলুক আর না বলুক, আমি বলব অনির্বাণের রোলটাই চতুর্থ ডাইনি।”
শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার গোটা টিমই
মন্দারের চিত্রনাট্য লিখেছেন প্রতীক দত্ত ও অনির্বাণ। চিত্রগ্রহণে ছিলেন সৌমিক হালদার। সম্পাদনায় সংলাপ ভৌমিক, সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন শুভদীপ ঘোষ। নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার তাঁরাও, যাঁরা ছাড়া এমন ছবি সম্ভব হত না।
মন্দারের বিড়ালের পারিশ্রমিক অনেক অভিনেতার থেকেও বেশি! ‘কালা’রফুল কেরিয়ার তার
অনির্বাণ এখন পুরুলিয়ায় নতুন ছবির শ্যুটিংয়ে, আউটডোরে। দম ফেলার ফুরসত নেই তাঁর। তিনি নিজে বহু বছর ধরে থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত বলেই কি পরিচালক হিসেবে থিয়েটার আর্টিস্টদেরই কাস্ট করলেন বেছে বেছে?“একেবারেই তা নয়,” বললেন অনির্বাণ। “আমার মনে যে ধরনের মুখ বা শরীরগুলো ছিল, সেটা আমি কাকতালীয়ভাবে থিয়েটার থেকেই পেয়ে গেলাম। আমার কোনও গোঁড়ামি ছিল না যে থিয়েটার থেকেই অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিতে হবে।”