শেষ আপডেট: 25th September 2023 08:32
"ছবি হিট হোক আর ফ্লপ হোক, কখনও শোনা যায়নি মহুয়া (Mahua Roy Chowdhury) খারাপ অভিনয় করেছে। ওঁর অসম্ভব অভিনয় ক্ষমতার কতটুকুই বা এক্সপ্লয়েট করা গেছে! যেটুকু করা হয়েছে তাতে আমি বলতে পারি মহুয়া অসাধারণ অভিনেত্রী।" মহুয়া রায়চৌধুরীর সম্পর্কে বলেছিলেন প্রখ্যাত পরিচালক তরুণ মজুমদার। যিনি ছিলেন মহুয়ার মেন্টর, গুরু, অভিভাবক। মহুয়া নাম তাঁরই দেওয়া।
কিন্তু মহুয়া ফুল ঝরে গেল অকালেই। ২২ জুলাই ১৯৮৫, ভোর না হতেই কলকাতা শহরবাসীর ঘুম ভাঙল দুঃসংবাদে। মহুয়া নেই। অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান বাংলা ছবির সোনার প্রতিমা। বহু ছবি সাইন করে বা অর্ধেক শ্যুট করে মহুয়া বাংলা ছবির দর্শকদের ছেড়ে চলে যান। পরিচালক প্রযোজকদের মাথায় হাত। উত্তমকুমারের মৃত্যুর পর সবথেকে বেশি টাকা লগ্নি করা যেত যে নায়িকার উপর, তিনি আর নেই!
মহুয়ার মৃত্যুর পরের বছর, ১৯৮৬ সালে মুক্তি পেয়েছিল মহুয়া অভিনীত একাধিক ছবি। জহর বিশ্বাসের ‘অনুরাগের ছোঁয়া’, সুজিত গুহর 'অভিমান' বা বীরেশ চট্টোপাধ্যায়ের 'আশীর্বাদ'। সব কটি ছবিতেই মহুয়া সে বছর শীর্ষে। এছাড়াও তাঁর একাধিক ছবি পরপর রিলিজ করে। তপন সিনহার 'আদমি অউর অউরত' ছবিতে অভিনয় করে মহুয়া শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পান। সেই পুরস্কার গ্রহণ করার লোক পাওয়া যায়নি। মহুয়া বেঁচে থাকতে এত সাফল্য দেখে যেতে পারেননি। মহুয়া রায়চৌধুরীই একমাত্র নায়িকা, যিনি মৃত্যুর পর সুপারস্টার আখ্যা পান। দর্শক মনে তাঁর সেই জায়গা আজও সরেনি।
তবে ধীরে ধীরে মহুয়ার ছবি রিলিজের সংখ্যা কমে এল। সেটাই স্বাভাবিক। যেখানে অভিনেত্রী প্রয়াত। মহুয়ার ছেড়ে যাওয়া বহু ছবি পেয়ে যান সমসাময়িক অভিনেত্রীরা। যদিও তাঁরা মহুয়ার অভাব পূরণ করতে পারেননি।
মহুয়ার মৃত্যুর পাঁচ বছর পর ১৯৯০ সালে রিলিজ করে মহুয়া অভিনীত ছবি 'সংক্রান্তি' (Sangkranti)। ছবিতে ছিলেন ওম পুরি, অপর্ণা সেন, বসন্ত চৌধুরী, প্রসেনজিৎ, দেবিকা মুখোপাধ্যায় সহ আরও অনেকে। পরিচালক খুব নামী কেউ নন, মলয় মিত্র। প্রযোজনা রঞ্জিত ঘোষ ও চুনিলাল মুখার্জী। ছবিটা পাঁচ বছর আগে শ্যুট হলেও রিলিজ করেছিল অনেক পরে। দর্শক যাতে বুঝতে না পারে ছবিটি পুরনো, তাই ছবি মুক্তির আগে প্রচারে কোথাও মহুয়ার নাম রাখা হয়নি। অথচ বেশ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেন মহুয়া। কিন্তু তাঁর নামটাই বাদ দিয়ে ছবির প্রচার করা হয়।
ছবি রিলিজের দিনও পোস্টারে কোথাও মহুয়ার (Bengali actress Mahua) মুখের ছবি দেওয়া হয়নি। পোস্টার আর প্রচার জুড়ে শুধুই ছিলেন অপর্ণা সেন। অপর্ণা সেনের বক্সঅফিস একসময় পিছিয়ে পড়েছিল মহুয়ার দাপটে। বীরেশ চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে 'মোহনার দিকে' বা 'একান্ত আপন' ছবি করেই অপর্ণা আশির দশকে কমার্শিয়াল ছবির বাজারে টিকে ছিলেন। যদিও অপর্ণা সেসময় সফল পরিচালক হয়ে ওঠেন। কিছু বছর আগেই মুক্তি পেয়েছিল অপর্ণা পরিচালিত দ্বিতীয় ছবি 'পরমা'। সেই ছবিতেও একটি ছোট্ট চরিত্রে অভিনয় করেন মহুয়া। অপর্ণা বলেছিলেন "ভাবতে পারিনি, এত ছোট্ট রোলও মহুয়ার মতো অভিনেত্রী এক কথায় করবে। আসলে মহুয়া চরিত্রটা দেখে করত, যাতে অভিনয় করার আছে।"
'সংক্রান্তি' ছবির প্রচার থেকে যে মহুয়াকে বাদ দেওয়া হল সেই নিয়ে ইন্ডাস্ট্রির একজন শিল্পীও প্রতিবাদ করেননি সেসময়। চরম অবহেলার শিকার হন মহুয়া। মহুয়া বেঁচে থাকলে এই অবহেলা করা নিশ্চয়ই সম্ভব হত না।
'সংক্রান্তি' ছবিতে শুধুই অপর্ণা সেন আছেন, ছবির প্রচার দেখে দর্শক তেমনটাই ভেবেছিল। কিন্তু গুণী অভিনেত্রী মহুয়া মৃত্যুর পরও তাঁর ছাপ ফেলে যান। দর্শক যখন সিনেমাহলে গিয়ে দেখল ওম পুরির স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করছেন প্রয়াত অভিনেত্রী মহুয়া রায়চৌধুরী, তখন হাততালিতে ফেটে পড়ল হল। আবার পর্দায় জীবন্ত মহুয়া। গ্রাম্য অন্ত্যজ বউয়ের চরিত্র করেছিলেন মহুয়া। মেক আপ করে গায়ের রং কালো করা হয়েছিল মহুয়ার। গ্ল্যামার ঝেড়ে ফেলে খালি গায়ে হাঁটুর ওপর কাপড় পরেই মহুয়া মাত করেন অভিনয়ে।
বম্বের বলিষ্ঠ অভিনেতা ওম পুরির (Om Puri) সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর ভূমিকায় মহুয়ার অভিনয় ছিল অনবদ্য। অপর্ণা সেন ছবির প্রচারে বিশেষ গুরুত্ব পেলেও তাঁর অভিনয় পিছিয়ে পড়েছিল মহুয়ার কাছে। শুধু তাই নয়, মহুয়ার অভিনয় দেখে দর্শক থেকে শুরু করে সমালোচকরা পর্যন্ত এতটাই প্রশংসা করেছিল যে ক'দিন পরই ছবির প্রচার বিজ্ঞাপনে মহুয়ার নাম বড় বড় হরফে যুক্ত করতে বাধ্য হয় প্রযোজক গোষ্ঠী। ফের 'সংক্রান্তি' ছবির পোস্টারে লেখা হয় "সবার ভাল লেগেছে মহুয়া রায়চৌধুরীকে। আবার বাংলা ছবি জনপ্রিয়।"
যদিও 'সংক্রান্তি'কে (Sangkranti) সুপারহিট ছবি বলা চলে না। কিন্তু ছবির প্রচারে যে মহুয়াকে অবহেলা করা হয়েছিল, পরে তাঁকে দিয়েই ছবির ব্যবসা তুলতে হয়। গায়ে বসন্ত নিয়ে মহুয়ার অভিনয় এক স্ত্রীর ভূমিকায়, এক মায়ের ভূমিকায় দাগ কেটে যাওয়ার মতোই ছিল। ছবির গল্প ছিল কিছুটা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'অগ্রদানী' র মতো। বাচ্চা বদলের গল্প। ছবির সুরকার অমল মুখোপাধ্যায়ের সুরে মহুয়ার লিপে দারুণ ঘুমপাড়ানি গান গেয়েছিলেন অরুন্ধতী হোম চৌধুরী।
মহুয়ার মৃত্যুর পাঁচ বছর পর যেহেতু 'সংক্রান্তি' ছবিটি মুক্তি পায় তাই মহুয়া (Mahua Roy Chowdhury) তাঁর ডাবিং করে যেতে পারেননি। মহুয়ার লিপে ডাবিং করেছিলেন তাঁর প্রিয় বান্ধবী, অভিনেত্রী রত্না ঘোষাল।
মহুয়ার মৃত্যুর পর তাঁর নাম বাদ দিয়ে বঞ্চনার খবর কিছু বিনোদনপত্র সামনে আনলেও প্রতিবাদ করেননি টলিপাড়ার একজন শিল্পীও। কিন্তু মহুয়া মৃত্যুর পরও নিজের জমি জিতে নেন। তাঁর অভিনয়ই ছবির প্রচারে তাঁর নাম ফের জুড়তে বাধ্য করে। এখানেই মহুয়া টলিপাড়ার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী।
কৃতজ্ঞতা - রমেন দত্ত
নীরবে প্রয়াত সত্যজিতের শিল্পমন্ত্রী, তরুণ মজুমদারের শিষ্য অভিনেতাকে মনে রাখেনি প্রায় কেউই