মাধবী মুখোপাধ্যায় ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: 9th August 2024 15:28
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রয়াণে আজ মনে পড়ছে ২০০১ সালে ঘটা একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সরাসরি রাজনীতি যাঁর জগৎ নয়, তেমন এক মানুষ এক সময়ে তাঁর সঙ্গে লড়েছিলেন ভোটের ময়দানে। সে বার বিধানসভা নির্বাচনে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিপক্ষে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী করেছিল কিংবদন্তি নায়িকা মাধবী মুখোপাধ্যায়কে। যাদবপুর কেন্দ্র থেকে মুখোমুখি লড়াই।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস দল গঠনের পর সেটা ছিল তাঁদের প্রথম বিধানসভা নির্বাচন। সেখানেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুব্রত মুখোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিপরীতে দাঁড় করান মাধবী মুখোপাধ্যায়কে। বুদ্ধর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ২৯ হাজার ভোটে পরাজিত হন 'মহানগর'-এর আরতি।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রয়াণের খবরে সেসব অতীত দিনের কথাই ভাবছেন মাধবী। কেন তিনি হঠাৎ এলেন রাজনীতিতে? মাধবী সেই প্রশ্নের উত্তর দিলেন 'দ্য ওয়াল'কে।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন মাধবী, প্রথমেই এই কথার বিনীত প্রতিবাদ করে মাধবী মুখোপাধ্যায় বললেন, 'বুদ্ধদেববাবুর বিরুদ্ধে আমি দাঁড়াইনি। একটা পার্টি তার বিপক্ষ পার্টির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। সেই তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে আমি দাঁড়িয়েছিলাম। মানুষ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে আমি কখনও দাঁড়াইনি। তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে তৃণমূলের হয়ে লড়েছিলাম।'
সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় মাধবী যতটা ভাল অভিনেত্রী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে রাজনীতির ময়দানে মাধবী ততটাই ফ্লপ হয়েছিলেন। তবু মাধবী কেন লড়তে এসেছিলেন রাজনীতির ময়দানে?
চারুলতা বললেন, 'আমার ভোটে দাঁড়ানোর কারণ একজনই ছিলেন। সুব্রত মুখোপাধ্যায়। আমি জানতামও না, সুব্রত মুখোপাধ্যায় এমন প্রস্তাব আমায় দেবেন। আসল ব্যাপারটা ছিল কী, একটু বলি। সুব্রত মুখোপাধ্যায় যখন মেয়র হলেন, তখন ওঁকে বলেছিলাম, যে আপনি 'স্টার থিয়েটার'টা আবার নতুন করে গড়ে দিন। ফিরিয়ে দিন আমাদের স্টার থিয়েটার। কারণ আমি পাঁচ বছর বয়স থেকে স্টারে অভিনয় করেছি। এটাও বলেছিলাম ওঁকে, পুড়ে যাওয়া স্টার থিয়েটার যদি আপনি নতুন ভাবে করে দেন, আপনি যা বলবেন আমি তাই করব।
সুব্রত মুখোপাধ্যায় নবীকরণ করে ফিরিয়ে দিলেন আমাদের স্টার থিয়েটার। কিন্তু আমি কখনও স্বপ্নেও ভাবিনি এর পরে সুব্রতবাবু আমাকে বলবেন যাদবপুর থেকে ভোটে দাঁড়ানোর কথা। যখন উনি বললেন, আমি কিন্তু না বলিনি। বলেছি হ্যাঁ, ঠিক আছে। কিন্তু আমি জানতাম, হারব। তখন বামফ্রন্ট জমানা। বুদ্ধদেববাবুর সঙ্গে লড়তে আমি পারব না। হারব জেনেশুনেই আমি হ্যাঁ বলেছিলাম। বুদ্ধদেববাবু ওঁর মতো ভোট প্রচার করেছিলেন, আমি আমার মতো। এই রাজনৈতিক প্রচারে আজকাল একে অন্যকে যেভাবে কাদা ছোড়াছুড়ি করেন, সেটা দেখেই আশ্চর্য হয়ে যাই। সেই সময় বুদ্ধদেববাবু আমার সম্পর্কে কোনও খারাপ কথা বলেননি। আমিও ওঁর সঙ্গে কোনও খারাপ কথা বলিনি। বলার প্রয়োজন হয়নি।
আমি মনে করি না, কাউকে খারাপ বলে আর একজন ভাল হতে পারে। আমি তো জানতামই, বুদ্ধদেববাবুর বিরুদ্ধে জিতব না। কেবল সৌজন্য রাখতেই দাঁড়িয়েছিলাম। তবে রাজনীতিতে না থেকেও মানুষের জন্য কাজ করা যায়। সে কাজ আমি সবসময় করি। করোনার সময় আমার এলাকায় বৃদ্ধবৃদ্ধাদের জন্য বাড়ি গিয়ে ভ্যাকসিন দেওয়ানোর ব্যবস্থা করেছিলাম একটি বেসরকারি ক্লিনিকের মাধ্যমে।'
ভোটের ময়দানে হোক বা ব্যক্তি জীবনে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে শ্রদ্ধার চোখেই দেখেন মাধবী। তাই অকপটে বলেলেন, 'বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ভীষণ ভাল মানুষ। অতি সজ্জন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাইপো ছিলেন। তাই আলাদা একটা সম্ভ্রম বুদ্ধদেববাবুর প্রতি ছিলই। কারণ কবি সুকান্তকে আমরা সকলেই ভালবাসি। ওঁর লেখার ভক্ত আমি। কাজেই ওই যোগসূত্রটা তো আমাদের ভাল লাগতই। সেই শ্রদ্ধাটাও ছিল।'
মাধবী আরও বললেন, 'আমি হারব জানতাম। কিন্তু তখন পাবলিক বলেছিল, মাধবী মুখোপাধ্যায়কে সিপিএম রিগিং করে হারিয়ে দিয়েছে। আমি নিজে জানি না রিগিং করতে, বাসনাও নেই করার। তৃণমৃল পার্টির থেকেও আমি মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বেশি শ্রদ্ধা করি। কারণ আমাদের শিল্পীদের জন্য টেকনিশিয়ানদের জন্য বামফ্রন্ট সরকার, বা তার আগের কংগ্রেস সরকার কেউই কিছু করেননি। ভাবেনি আমাদের কথা। মমতা ভেবেছেন, করেছেন। তাই সেটা তো বলতে হবেই। সেই কৃতজ্ঞতা তো থাকবেই। তবে তার জন্য বুদ্ধদেববাবুকে অসম্মান করব, তা নয়। আজ আমার মনে হচ্ছে, সিপিএম পার্টির মধ্যে সবাই প্রায় চলে গেলেন। একটা খুব সুন্দর পার্টি ছিল তো! এক এক করে যেন সবাই চলে যাচ্ছেন। একটা শক্তিশালী বিরোধী দল সবসময় থাকা দরকার। সেটা তো আর নেই। সিপিএম পার্টির স্বর্ণযুগ শেষ হল।'