সত্যজিৎ রায়, লিলি চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: 2 May 2025 23:51
সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিনে দ্য ওয়ালে গল্প করলেন প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী লিলি চক্রবর্তী।
সত্যজিৎ রায় 'অপুর সংসার' ছবিতে অপর্ণার চরিত্রে শর্মিলা ঠাকুর ছাড়াও আপনাকেও তো দেখেছিলেন?
সেই কোন ছোটবেলায় ওঁর বাড়ি গিয়েছিলাম। 'অপুর সংসার' ছবিতে আমার কাজ করা হয়নি। সত্যজিৎ বাবু বললেন 'তোমায় সৌমিত্রর বিপরীতে পছন্দ হয়েছে আমার। তবে রিঙ্কু বলে একটি মেয়েকেও দেখেছি। রিঙ্কুকে না পেলে তোমায় নেব।' তারপর তো শর্মিলাই করল।
খারাপ লাগেনি তখন এমন কথা শুনে?
আমি কোনওদিনই খুব একটা জীবনে আশা করিনি। যা পেয়েছি তাতেই খুশি হয়েছি।
এরপর বহু বছর পর তো আপনার কাছে আবার সত্যজিৎ রায়ের ছবির অফার এল?
সাদা রঙের খামে একটা চিঠি এল। আমি তো চিঠি পরে থ। দীর্ঘ পনের বছর পর সত্যজিৎ আমায় ডাকছেন। লেখা ছিল 'তরুণ মজুমদারের 'ফুলেশ্বরী'তে তোমার অভিনয় দেখে মুগ্ধ হলাম। শংকরের 'জন-অরণ্য' চলচ্চিত্রায়িত করব ভাবছি। কাহিনিতে দুটো বৌদি চরিত্র আছে। আমি কেটে ছেঁটে একটি বৌদি করেছি। কমলা বৌদি। তোমার বম্বেতে কাজের চাপ কেমন? ব্যস্ত না থাকলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ কর। সত্যজিৎ রায়।'
কোথাও কোনও ঠিকানা নেই চিঠিতে। চিঠির উত্তর দেব কী করে? সেই কবে ছোটবেলায় ওঁর লেক টেম্পল রোডের বাড়িতে গেছি। শেষে পরিচালক বাসু ভট্টাচার্যর স্ত্রী রিঙ্কিকে জানালাম। রিঙ্কির মা বিমল রায়ের স্ত্রী। উনিই দিলেন ঠিকানা। সত্যজিৎ রায়কে চিঠি লিখলাম 'এ সুযোগ বারবার আসে না। যে কোন মূল্যে আমি আপনার ছবিতে কাজ করব।'
তখন হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের 'চুপকে চুপকে' ছবির শ্যুটিং করছি। হৃষিদা বললেন 'লিলি, শিগ্গির যা। এটা তোর লাইফটাইম কাজ হয়ে থাকবে।'
সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে এত বছর পর দেখা করার অভিজ্ঞতা?
সোজা কলকাতা এসে পৌঁছলাম। দরজা খুলে দিলেন বিজয়া রায়। বললেন 'লিলি, তোমার সেই কোমর ছাপানো চুল কই?' পেছন থেকে ভেসে এল সেই ব্যারিটোন ভয়েস 'কী যাতা বলছ! আমি লিলির ফুলেশ্বরী দেখেছি। ওর অনেক লম্বা চুল।' আমি ওঁর সামনেই হেসে ফেললাম। এখন বুঝি সেটা করা উচিত হয়নি। হেসেহেসে ওঁকে বললাম ওটা তো উইগ ছিল!
সত্যজিৎ রায় বললেন 'সে কী আমার চোখকে ফাঁকি! কে বানাল এমন উইগ?' বললাম পিয়ার আলি। উনি অনিল চৌধুরীকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন 'পিয়ার আলিকে খবর পাঠাও। জন-অরণ্য-তে লিলির জন্য উইগ বানাও'।
শ্যুটিংয়ের এগারোটা দিন কী ভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। ইউনিটের প্রতিটি খুঁটিনাটি নিয়ে ওঁর নজর ছিল।
সত্যজিতের 'শাখা প্রশাখা'র বড় বউ তো আপনি? সেই অভিজ্ঞতা?
তখন সত্যজিৎ রায় কিংবদন্তি। খ্যাতির আলো ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। সেই ব্যারিটোন ভয়েসে ফোন 'তোমাকে অনেকদিন দেখিনি লিলি। একদিন এসো। 'শাখা প্রশাখা' নতুন ছবি করছি। এই ছবির আউটডোরে আমরা ট্রেনে করে সবাই গেছিলাম। সত্যজিৎ রায়ও আমাদের সঙ্গে। তখন ওঁনার শরীর ভাল ছিল না। তাই একজন রেলের অফিসার আর ডাক্তার ছিলেন আমাদের সঙ্গে। আমি আর মমতা শংকর ছবিতে দুই জা। আমরা দু'জন একসঙ্গেই থাকতাম। মমর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভাল চিরকাল। শ্যুটিংয়ে সবথেকে মজা হত রঞ্জিত মল্লিককে নিয়ে। রঞ্জিতের অভ্যেস ছিল মুখ চেপে কথা বলার অভ্যেস। সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন 'রঞ্জিত মুখ খুলে কথা বলবে স্পষ্ট উচ্চারণে। রঞ্জিত পড়ে গেল টেনশনে। সে রোজ রঞ্জিত উপোস করে ভয়েভয়ে শ্যুটিংয়ে পৌঁছত। সে রঞ্জিতের ল্যাজে গোবরে অবস্থা। ওঁর একটা বড় সংলাপ ছিল। সেটা শেষ হতে আমরা সবাই রঞ্জিতকে পেতলের থালা-বাটি সাজিয়ে খাইয়েছিলাম।
মানুষ সত্যজিৎ রায়?
আমি ছবির পারিশ্রমিক নিয়ে খুব একটা দরাদরি করতাম না। সত্যজিৎ রায়ের বেলায় তো কোন কথাই বলিনি। শ্যুটিং শেষে খাম খুলে পারিশ্রমিকের টাকা দেখে আমি তো অবাক! মমও অবাক। হিন্দি ছবি করেও কেউ এত টাকা পায় না। টাকার অঙ্ক সেসময় অনেক। গোর্কি সদনে 'শাখা প্রশাখা'র প্রথম স্ক্রিনিং হয়েছিল। সেই সত্যজিৎ বাবুর সঙ্গে শেষ দেখা। অস্কার যখন পেলেন তখন উনি অসুস্থ। আমি ছুটে গেলাম ওঁর বাড়ি। সত্যজিৎ রায় নার্সিংহোমে। বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে বৌদি ছুটে এসে বললেন 'দেখবে অস্কার? এসো লিলি'। ছুঁয়ে দেখলাম অস্কার। গর্বে বুক ভরে গেল। মনে মনে বললাম 'এই মানুষটার সঙ্গে দুটো ছবি করেছি। জীবনে আর কিচ্ছু চাই না।'