রূপাঞ্জনা মিত্র
শেষ আপডেট: 22nd April 2024 17:59
সন্ধ্যা সাড়ে ছটা। সেদিন 'রোজগেরে গিন্নি' হতে চলেছেন যিনি তাঁর বৈবাহিক জীবন লাইমলাইটে এসেছিল। তখন সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ নয়। তারকাদের স্পর্শ পাওয়া সহজ ছিলনা। আর তিনি তখন টলিপাড়ার উঠতি অভিনেত্রী। কিন্তু ততদিনে বেশ নামডাক। ফ্ল্যাটের নেমপ্লেটে লেখা রূপাঞ্জনা মিত্র হক। রোজগেরে গিন্নি খ্যাত সঞ্চালিকা পরমা বন্দ্যোপাধ্যায় রূপাঞ্জনার নেমপ্লেটের দিকে হাত দেখিয়ে দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। মিত্র পদবীর সঙ্গে জুড়ে গেছে হক। তাহলে কি ধর্মান্তরিত হয়েছেন রূপাঞ্জনা? পর্দায় তিনি শুধু মিত্র হলেও অফিসিয়ালি তিনি হক। রূপাঞ্জনা ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন মুসলিম প্রেমিককে। সেদিনকার কাপল রাউন্ডে ধরা ছিল রূপাঞ্জনা আর তাঁর স্বামী রেজাউল হকের আদরে সোহাগে মাখা হাসিমুখ। যদিও পরবর্তীকালে ফিকে হয়ে আসে সেই ফ্রেম। গত ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দ্বিতীয়বার গাঁটছড়া বেঁধেছেন অভিনেত্রী, রাতুল মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে।
রূপাঞ্জনার পরিবার কিন্তু সংস্কৃতি জগতের নামকরা পরিবার। আজ যখন রূপাঞ্জনা চর্চায় তখন অনেকেই হয়তো খোঁজ রাখেননি রূপাঞ্জনার বাবার ব্যাকগ্রাউন্ড। রূপাঞ্জনার বাবা সঙ্গীতশিল্পী গৌতম মিত্র, যাকে বলা হত আশির দশকের হেমন্ত। সুদর্শন গৌতম মিত্রের কন্ঠ ছিল একদম হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো তাঁর নিজের মৌলিক গান হিট করেছিল তৎকালীন পলিডোর মিউজিক কোম্পানি থেকে। 'লাল পাহাড়ি' ছবির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন গৌতম মিত্র। তাঁর সুরে এই ছবিতে গান গেয়েছিলেন আশা ভোঁসলে। তখনকার দূরদর্শনের সিরিয়ালেও গৌতম মিত্রর কন্ঠে শোনা যেত গান। কিন্তু প্রতিভার দাম তিনি পাননি। প্লেব্যাক গানে তিনি রাজনীতির শিকার হন, বাদ পড়েন বারবার সুপারহিট ছবির প্লেব্যাক থেকে। সে কারণেই আধুনিক গান থেকে সরে গিয়ে নিজের পরিচয় তৈরি করেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে। পঁচিশে বৈশাখের সকালগুলোতে তাঁর কন্ঠেই শ্রোতারা পেতেন হেমন্তর গা কন্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ছোঁয়া। রসিক গানপাগল গৌতম মিত্র সঙ্গীতের শিক্ষক রূপে শ্রদ্ধার আসন পেয়েছেন। সঙ্গীত জীবনের ৫০ বছর পার করে এখনও তিনি সতেজ-কন্ঠ।
গৌতম মিত্রর স্ত্রী শুক্লা মিত্র পরিচালক প্রযোজক। টলিউডের মহিলা পরিচালকদের মধ্যে শুক্লা মিত্রের নামটিও থাকবে। রবি ঠাকুরের গোরা চলচ্চিত্র করেছিলেন তিনি। মনে পড়ছে রবি ঠাকুরের তিনটি কবিতার চিত্ররূপ নিয়ে তিনি তৈরি করেন তিনটি ছোট ছবির সমাহারে 'তিন তনয়া' ছবি। তিন নায়িকার গল্প। যার একটি চরিত্রে ছিলেন রূপাঞ্জনা। এই ছবির সংগীত পরিচালক গৌতম মিত্র। ছোট পর্দাতেও শুক্লা মিত্রকে পেয়েছি আমরা নানা সময়ে। 'চোখের বালি' সিরিয়াল ভুলি কী করে। এতে বিনোদিনীর চরিত্রে সাদা থান পরিহিতা রূপাঞ্জনাকে দর্শক ভোলেননি। কেরিয়ারের শুরুতেই নজর কেড়ে নেন তিনি।ঋতুপর্ণর ঐশ্বর্যর আগেই সিরিয়ালে বিনোদিনী হন রূপাঞ্জনা।
গৌতম-শুক্লার দুই পরমা সুন্দরী মেয়ের মধ্যে বিনোদন দুনিয়ায় আসেন রূপাঞ্জনা। 'বিউটি পার্লার' সিরিয়াল দিয়ে সবার নজর কেড়ে নেন ছিপছিপে সদ্য যুবতী রূপাঞ্জনা। 'বিউটি পার্লার' ছিল তিন নারীর বিউটি পার্লার ব্যবসা খোলার গল্প। অনুরাধা রায়, অপরাজিতা আঢ্য এবং রূপাঞ্জনা মিত্র মুখ্য চরিত্রে। নবাগতা স্মার্ট রূপাঞ্জনা সহজেই সবার চোখে পড়ে যান। এরপর জন্মভূমি থেকে এক আকাশের নীচে। পরের পর সিরিয়ালে রূপাঞ্জনা হয়ে ওঠেন টলিউডের জনপ্রিয় অভিনেত্রী। তবে রূপাঞ্জনার শ্রেষ্ঠ অভিনয় যে সিরিয়াল দিয়ে মনে রাখব তা হল রবি ওঝার 'খেলা'। বেকার ছেলেকে ভালবেসে বিয়ে করেছিল বড়লোক রতিকান্ত বর্মণের বড় মেয়ে। বাপের বাড়িতেই তাঁর স্বামী রয়ে যায় ঘরজামাই হয়ে। বাবার দাপটের তোয়াক্কা না করে মেয়েটি হোম ডেলিভারির ব্যবসা করে স্বামীর মর্যাদা ফিরিয়ে দেয়। রূপাঞ্জনার এই অভিনয় যারা দেখেছেন তারাই বুঝবেন ওঁর অভিনয় ক্ষমতা। যা ওঁর গ্ল্যামারকে ছাপিয়ে গেছিল। স্বামীর ভূমিকায় ছিলেন জয়জিৎ ব্যানার্জি। বাংলা ছবি রূপাঞ্জনাকে মুখ্য চরিত্র কখনই দেয়নি। অথচ রূপে গুণে রূপাঞ্জনার ক্ষমতা ছিল চলচ্চিত্রে মুখ্য চরিত্র পাওয়ার মতো। এখন বাংলা হিন্দি সিরিয়ালে গ্ল্যামারাস মা রূপাঞ্জনা। খুব অল্প বয়সেই বাস্তবেও বিয়ে করে ফেলেন রূপাঞ্জনা।
রূপাঞ্জনার প্রথম স্বামী রেজাউল হক ওঁর সঙ্গেই থাকতেন। দুজনের সংসার। শোনা যায় রূপাঞ্জনার বাবা মা প্রথমে মেয়ের এই ভিনধর্মে বিয়ে মেনে নেননি। তবু সেদিন হাসিমুখে রূপাঞ্জনা বলেছিলেন সুদর্শন রেজাউল তাঁর অভিনয়ের শক্তি। মুসলিম স্বামী বলে রূপাঞ্জনা চর্চায় ছিলেন সেই সময়। কিন্তু সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি নিজের লড়াই নিজে লড়েছিলেন। যদিও সে সংসার টিঁকল না। মা হিসেবে রূপাঞ্জনার লড়াই সম্পূর্ণ একার। ছেলের দায়িত্ব কোনদিনই রেজাউল পালন করেননি। তখন মেয়ের পাশে গৌতম মিত্র দাঁড়িয়েছিলেন।
একার লড়াইতে রূপাঞ্জনার পাশে এলেন তাঁর রাতুল। ইন্ডাস্ট্রির উঠতি পরিচালক রাতুল মুখোপাধ্যায়। প্রেমিকা বয়সে অনেকটা বড়। তবে তাতে তাঁদের সম্পর্কে চিড় ধরেনি। আমরা চিরকালই ধরে নিই স্বামী বয়সে কুড়ি বছরের বড় হলে ক্ষতি নেই। স্বামী গুরুর মতো। কিন্তু স্ত্রী বয়সে বড় হলেই সমাজের যত সমস্যা। অথচ রূপাঞ্জনা মিত্র, সোহিনী সেনগুপ্ত এমনকী স্বর্ণযুগের অভিনেত্রী ললিতা চ্যাটার্জি বয়সে ছোট প্রেমিকের সাথেই সংসার পেতেছিলেন। রূপাঞ্জনার ছেলের কাছে মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে সমস্যা ছিল না। দীর্ঘদিন লিভ ইনের পর ছেলে কোলেই দ্বিতীয় বার বিয়ের পিড়িতে বসেছেন অভিনেত্রী।
আজকের সোশ্যাল মিডিয়া কিন্তু রূপাঞ্জনার লড়াইকে খুব একটা ট্রোল করেনি। কারণ রূপাঞ্জনার সততা ও সাহস। ইন্ডাস্ট্রিতে চলা অনৈতিক আচরণের প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি। রূপাঞ্জনা বলেন "শরীর দেখিয়ে কাজ পাওয়া যায় না, সম্মান পাওয়া যায় না"। পারিবারিক ঐতিহ্যকে কখনও অবমাননা করেননি তিনি। সে শিক্ষা তাঁর রক্তে। ভিনধর্মে বিয়ে হোক বা বয়সে ছোট পুরুষকে ভালবেসে বরণ করা -কোনোটাই তো অপরাধ নয়। আধুনিক হয়েছেন তিনি মনে। রূপাঞ্জনার সিঁথিতে অক্ষয় হোক রাঙা রাতুল।