শেষ আপডেট: 18th January 2024 19:08
'বিজয়ার পরে' দেখে মমতাশঙ্করকে খোলা চিঠি লিখলেন শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।
শ্রীচরণেষু মমদি,
আমরা সকলেই জানি আপনার বাবা উদয়শঙ্কর প্রবাদপ্রতিম নৃত্যশিল্পী, আপনার মা অমলাশঙ্কর নৃত্যকিন্নরী। 'শঙ্করস্কোপ'-এর অসামান্য নৃত্য পরিবেশনা কল্পনা'য় উদয়-অমলা যেন সাক্ষাত হর-পার্বতী। আপনার কাকা বিখ্যাত সেতারশিল্পী রবিশঙ্কর। আর এই সব পরিচয় ছাড়াও আপনি নিজে একজন অসাধারণ অভিনেত্রী এবং অনন্য আপনার নৃত্য প্রতিভা।এত বিশেষণ পেরিয়েও খুবই সহজ আপনার জীবনের যাপনচিত্র।
অসাধারণ হয়েও আপনি এতো সাধারণ যে সবাই আপনাকে 'মমদি'বলে ডাকার সাহস পায়। মমতাশঙ্কর আমাদের সকলের মমদি। তাই মমদি ডেকেই আপনাকে এই খোলা চিঠি লিখতে বসলাম। আজকাল শর্ট মেসেজ হোয়াটস অ্যাপের যুগে চিঠি লেখার পাঠ তো উঠেই গেছে। তবু মমদি মানেই আটপৌরে বনেদিয়ানা। তাঁকে তো খোলা চিঠি লেখাই যায়।
প্রিমিয়ারে দেখলাম 'বিজয়ার পরে'।একই প্রেক্ষাগৃহে আপনার সঙ্গে বসে। এই নিয়ে দ্বিতীয় বার দেখা। প্রথম দেখি ২০২৩ আন্তর্জাতিক কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে। সেখানেও দেখলাম স্বামী চন্দ্রোদয় ঘোষকে নিয়ে আপনি স্বমহিমায় আবির্ভূতা। অভিজিৎ শ্রী দাস,নবাগত পরিচালক। নতুন পরিচালকদের ছবি প্রদর্শনে কী অবলীলায় আপনি চলে আসেন মমদি? নিজের হাজারো ব্যস্ততার মাঝে দিদির মতোই আসেন ,উৎসাহ দেন। অরিন্দম ভট্টাচার্য,প্রতীম ডি গাঙ্গুলি এমনকি বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর মতো পরিচালকের প্রথম ছবির নায়িকা আপনি। তখন যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রী আপনি। প্রথম ছবি মৃণাল সেনের 'মৃগয়া'থেকেই তো সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন ইন্ডাস্ট্রিতে নবীনদের ছবিতে কাজ করার সেই ধারাবাহিকতা আপনি বজায় রেখেছেন আজও।
'বিজয়ার পরে' শেষ হতে মনে হল একটাই কথা- এ কোন মমতাশঙ্কর? এমন চরিত্র তো আপনি আগে করেননি। কঠিন চরিত্র। নিজেকে ভেঙেচুরে আবার গড়ে রক্তমাংসের অলকানন্দা হয়ে উঠেছেন আপনি।
জেনেছি এই ছবির অলকানন্দা চরিত্রটি করার কথা ছিল শর্মিলা ঠাকুরের। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-শর্মিলা ঠাকুর জুটিকে আবার ফেরানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন পরিচালক। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেঙেছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে। তখনশর্মিলা জানিয়ে দিয়েছিলেন সৌমিত্র ছাড়া এ ছবি তাঁর পক্ষে করা সম্ভব নয়। পরিচালক অভিজিৎ শ্রী দাসের দ্বিতীয় চয়েস ছিলেন দীপঙ্কর দে। দীপঙ্কর চিত্রনাট্য শুনে করতে রাজি হয়েছিলেন। তবে শর্ত ছিল অলকানন্দা চরিত্রটি দিতে হবে আপনাকে কী অসম্ভব ভরসা! আর কেনই বা হবে না, যুগের পর যুগ ধরে যে দীপঙ্কর-মমতা মননশীল বাংলা ছবির হিট জুটি। নারায়ণ রায়ের 'নিশান্তে' ছবিতে এই জুটি কাজ শুরু করলেও আপনাদের প্রথম হিট সত্যজিৎ রায়ের 'গণশত্রু'। আরও বড় সাফল্য এল 'শাখাপ্রশাখা' ও 'আগুন্তুক' ছবিতে। এর পরে বিপ্লব চট্টোপাধ্যায় সমরেশ বসুর 'প্রজাপতি' ছবিতে আপনাদের দুটি পার্শ্ব চরিত্রে কাস্ট করেন।
দুজনের উল্লেখযোগ্য কাজ ঋতুপর্ণ ঘোষের 'উৎসব' ও 'আবহমান'।তেরো বছর পর 'বিজয়ার পরে' ছবিতে আবার স্বামী-স্ত্রী জুটিতে পেলাম আপনাদের।
'বিজয়ার পরে' ছবি জুড়ে রয়েছেন অলকানন্দা। জীবনের অমোঘ সত্য যখন সামনে আসে কী করে তার মুখোমুখি হতে হয়, কান্না বুকে চেপে কেমন করে সহজ আচরণে নিজেকে ঢেকে রাখতে হয় তা আপনার অভিনয়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। আপনি আর অলকানন্দা মিলেমিশে এক হয়ে গেছেন।
যাঁরা 'বিজয়ার পরে' দেখতে যাবেন তাঁদের জন্য আপনার চিঠির মধ্যেই ছোট্ট করে বলে দিই ছবির কাহিনী।
জীবনের বহু বসন্ত পার করছেন বনেদি বাড়ি 'গুলঞ্চ'র দম্পতি অলকানন্দা (মমতাশঙ্কর) ও আনন্দ (দীপঙ্কর দে)। দুর্গাপুজোর প্রেক্ষাপটে ক্রমশ নিরুদ্দেশ হতে থাকা ছেলেমেয়েদের খুঁজে বেড়ান তাঁরা। বাবা-মাযের জন্য তাদের সময় নেই একটুও। খাঁ খাঁ বাড়িতে বুড়োবুড়ি খুঁজে ফেরেন আগলানো অতীত। শরতের শিউলি ফুল, দুর্গাপুজোর ঢাকের আওয়াজ যেন তাঁদের এসব অতীতকে আরও বেশি করে মনে করায়। সংসারে মানিয়ে নেবার ক্ষমতা মেয়েদের চিরকালই বেশি কিন্তু আনন্দ কিছুতেই ছেলেমেয়ের এই আচরণ মেনে নিতে পারেন না। এমন একলা থাকার বিষাদ মাঝেই আলোর দিন এসে যায়। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর চণ্ডীপাঠ দিয়েই শুরু হয় নতুন উদ্যম। দূরে থাকা ছেলেমেয়েদের পুজোয় ঘরে ফিরতে বলেন তাঁরা। এই আসা কী বড্ড দেরিতে হল? ছবির ক্লাইম্যাক্স এখানেই। শুধু ক্লাইম্যাক্স নয় চিত্রনাট্যের বাঁক বদল এত দৃঢ় যা আসন ছেড়ে দর্শককে উঠতে দেয় না।
মমদি আপনিই এই ছবির প্রাণপ্রতিমা। তবে প্রথম ভাগের থেকেও ছবির দ্বিতীয় ভাগে যে বাঁকবদল ঘটে সেখানেই আসল চমক। কী অসাধারণ সাবলীল অভিনয় আপনার। স্বামীর সঙ্গে ঘরের ভিতর একরকম অভিনয় ,আবার ঘরের বাইরে এসে ছেলেমেয়ে নাতি নাতনিদের সঙ্গে আর এক রকম অভিনয়। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বসে থাকতে হয়। আপনি বলেছেন এটি আপনার করা সবথেকে কঠিন চরিত্র।সে হয়তো ঠিকই। কিম্তু অভিনয়ের ক্ষেত্রে আপনার ডেডিকেশন তো সেই প্রথম ছবি 'মৃগয়া"থেকেই ছিল। শুনেছি পরিচালক মৃণাল সেন চেয়েছিলেন মেকআপ ছাড়াই গায়ের রঙ কালো করতে। তাই আপনি মার্চ থেকে ডিসেম্বর গায়ে নুনজল আর ক্রিম মেখে ছাদে বসে থাকতেন। তারপর একে একে আরও কত ছবি... দখল,একদিন প্রতিদিন,খারিজ,গরম ভাত,নয়নতারা,বালিগঞ্জ কোর্ট,দহন,মাছের ঝোল।
এ কথা বলতে দ্বিধা নেই,সত্যজিৎ রায়, ঋতুপর্ণ ঘোষের মতো খ্যাতিমান পরিচালকের ছবির পর একেবারে নতুন পরিচালক অভিজিৎ শ্রী দাসের 'বিজয়ার পরে' ছবিতেই আপনাদের জুটি সার্থকতা পেল।
মমদি আপনার মেয়ের চরিত্রে স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় খুব ভাল কাজ করেছেন।স্বস্তিকাকে তো আপনি সেই ছোট্ট থেকে দেখছেন। তাই মা-মেয়ের বোঝাপড়া এত সুন্দর।স্বস্তিকার বাবা প্রয়াত অভিনেতা সন্তু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও ছোট পর্দাতে অনেক কাজ রয়েছে আপনার। মনে পড়ছে সেই নয়ের দশকের শুরুতে দেখা সন্তু-মমতার সিরিয়াল 'প্রথম কদম ফুল'। কী অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন আপনারা। আর 'জন্মভূমি' সিরিয়াল তো আপনাদের আর একটি হিট। ছোটবেলা থেকে মমো পিসির সঙ্গে মিষ্টি একটা সম্পর্ক ছিল। তাই ছবিতেই আপনাদের মা মেয়ের রসায়ন চোখে জল এনে দেয়। মাতৃত্বের স্নেহস্পর্শে,শাঁখা পলার শব্দে স্বস্তিকাও যেন নিজের প্রয়াত মাকে খুঁজে পেয়েছেন।
ঋতুপর্ণ ঘোষের আবহমানের পর আবার বিজয়ার পরে তে কী অনবদ্য কোরিওগ্রাফি দেখলাম আপনার। আরও দেখতে চাই মমদি।
ছবির শেষে চোখে জল আসবেই দর্শকের । যেন তাঁদের জীবনকাব্য উঠে এসেছে পর্দায়। সন্তানরা বুঝবেন সময় বড় অল্প! বাবা-মাকে কাজের ব্যস্ততার বাহানা না দিয়ে একটু যত্নে রাখতে হবে।
মমদি ,আপনার কেরিয়ারগ্রাফে 'বিজয়ার পরে'র অলকনন্দা ল্যান্ডমার্ক হয়ে থাকবে।
মমদি , বহু বছর ধরেই আপনার মোবাইলের কলার টিউনে বাজে সত্য সাঁইবাবার ভজনের সুর।
আপনি অনেক সাক্ষাৎকারেই বলেছেন আপনার ইষ্টদেবতা সত্য সাঁইবাবার আশীর্বাদে আপনি অলকানন্দার মতো কঠিন চরিত্রে সাবলীল অভিনয় করতে পেরেছেন। তবে কি অলকানন্দার এই সাফল্যকে আপনি সমর্পণ করেছেন সত্য সাঁইবাবার চরণে?