
প্রেম বারবার এসেছিল নীরবে, তবু গানকেই জীবনসঙ্গী করেন রহস্যময়ী লতা
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
‘যে আলো হয়ে এসেছিল কাছে মোর,
তারে আজ আলেয়া যে মনে হয়,
এ আঁধারে একাকী এ মন আজ
আঁধারেরই সাথে শুধু কথা কয়।
আজ কাছে তারে এত আমি ডাকি গো,
সে যে মরীচিকা হয়ে দেয় ফাঁকি গো
ভাগ্যে যে আছে লেখা হায় রে,
তারে চিরদিনই হবে জানি মানতে।’
‘বিয়েই কি জীবনের সবকিছু!’ তাঁকে বিয়ে সম্পর্কিত প্রশ্ন করা হলে এই উত্তরই বারবার দিয়েছেন লতা মঙ্গেশকর (Lata Mangeshkar)। তবু জনমানসে কৌতূহলের শেষ নেই। আজীবন কেন একা থাকলেন লতা মঙ্গেশকর? বিয়ে কেন করলেন না তিনি?
কোনও মানুষ একা বাঁচতে চাইলে তাঁকে সমাজ বারবার এই প্রশ্নই করে। কোনও পুরুষ বা মহিলা অবিবাহিত সারা জীবন রয়ে গেলে মানুষটির জীবন নিয়ে সমাজে অদ্ভুত এক কৌতূহল তৈরি হয়। আর সে মানুষ যদি হন লাইমলাইটে থাকা কোনও শিল্পী, তাহলে গসিপ আরও বাড়তে থাকে।কিন্তু সবটাই তো গসিপ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কোনও মানুষই বোধ হয় সাধ করে একা থাকে না। জীবনে নানা ঠোক্কর মানুষকে একা থাকতে বাধ্য করে। আবার একা থাকা মানেই একাকীত্বে ভোগা নয়। একলা যাপনের সুখ একবার যে পেয়েছে, সে কখনই অন্যের বশ্যতা স্বীকার করবে না। জীবনসঙ্গী হলেও তাঁর অধিকারবোধে জর্জরিত হতে চান না একা মানুষটি। একা মানুষদের প্রেম জীবন যতই গোপন হয় তাতে রহস্য ততই বাড়ে। ঠিক যেমন লতা মঙ্গেশকর।
তিনি সঙ্গীতের সরস্বতী। তিনি সকলের আরাধ্যা দেবী। দেবতাদের বা মনীষীদের প্রেম নিয়ে আলোচনা যেমন অলিখিত ভাবে নিষিদ্ধ একটা ব্যাপার, ঠিক তেমনই সঙ্গীতের সরস্বতী লতাজির প্রেম-অপ্রেম চর্চাও আড়ালে রাখার বিষয়। কিন্তু তিনিও তো রক্ত মাংসের মানুষ, তাঁর জীবনেও এসছে দুর্বলতা, প্রণয়, অভিমান, প্রবঞ্চনা।শ্বেতশুভ্র সরস্বতীকে সিংহাসনে বসিয়ে রাখলেও তাঁর মানসিক টানাপড়েনের সময়গুলো কম শিক্ষনীয় নয়। বারবার তাঁর জীবনে প্রেম এসেছে। বারবারই তাঁর জীবনে পুরুষ এসছে। বেশিরভাগ পুরুষই বিবাহিত। এক একটা সম্পর্কের দহনে যত জ্বলেছেন লতা, ততই যেন ক্ষুরধার হয়েছে তাঁর কোকিলকণ্ঠ।
বহু পাঠক-শ্রোতারাই হয়তো, বলবেন সরস্বতীর গোপন গল্প টেনে এনে কাদা ছেটানোর কী দরকার। তাঁর গানের সাধনাই আমাদের পাথেয়। কিন্তু লতা মঙ্গেশকর শুধু দেবী নন, তিনিও মানুষ। প্রেমের সম্পর্কে ঘা খেয়ে গানকে কীভাবে জীবনসঙ্গী বানাতে হয় সেই সাধনা আজীবন করে গেছেন সুরসম্রাজ্ঞী।লতা কোনওদিনই তাঁর বিয়ে,সংসার নিয়ে মুখ খোলেননি। লতার প্রেম নিয়ে হাজারো খবর ছাপা হয়েছে দশকের পর দশক জুড়ে। কিন্তু সবই যেন রহস্যময়। এই প্রতিবেদনে আলোচ্য ঘটনাগুলি এমন ব্যক্তিদের থেকেই প্রাপ্ত, যাঁরা লতা মঙ্গেশকরের সমসাময়িক সুরকার, গীতিকার, সঙ্গীত পরিচালক, সহকারী সঙ্গীত পরিচালক, ফিল্ম ডিরেক্টর এবং তাঁদের ঘনিষ্ঠ মহলের লোকজন। সঙ্গে প্রামাণ্য দলিল আলোচিত তারকাদের জীবনীগ্রন্থ। লতার ব্যক্তিগত জীবন পোস্টমর্টেম করতে নয়, বরং লতার জীবন যৌবনের সাধনা জানতেই ফেলে আসা প্রণয়পথে আলো ফেলা।
রামচন্দ্র তাঁর সীতা করতে চেয়েছিলেন লতাকে (Lata Mangeshkar)
রামচন্দ্র নহরহর চিতলকার, বম্বে ইন্ডাস্ট্রিতে তিনি পরিচিত সি রামচন্দ্র নামে। প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক ও গায়ক। রামচন্দ্রর গায়িকা হিসেবে প্রথম পছন্দের ছিলেন নূরজাহান। কিন্তু নূরজাহান পাকিস্তান চলে যাওয়াতে তাঁর বিকল্প হিসেবে লতাকে নেন তিনি। লতা মঙ্গেশকর-রামচন্দ্র জুটি হিন্দি ফিল্ম জগতের গানে বাঁকবদল জুটি হয়ে ওঠে।
‘আনারকলি’ ছবিতে লতাকে দিয়ে রামচন্দ্র যেসব গান গাওয়ান, তা আজও অবিস্মরণীয়। সমাধি, কবি, মিনার– বহু ছবিতেই সি রামচন্দ্রের সুরে গান গেয়েছিলেন লতা। শুধু গানেই দুজনের সম্পর্ক সীমাবদ্ধ ছিল না। গড়িয়েছিল আরও গভীরে। সব জায়গাতেই সেইসময় লতা আর রামচন্দ্রকে একসঙ্গে দেখা যেত। লতার তখন কাঁচা যৌবন, তাই তাঁকে নিয়ে জল্পনাও কম হয়নি। রামচন্দ্র একসময় সত্যিসত্যিই লতা মঙ্গেশকরকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। রামচন্দ্র ভেবেছিলেন তাঁদের অন্তরঙ্গতাকে বাস্তব রূপ দেবেন।

কিন্তু লতা নাকচ করে দেন বিবাহিত রামচন্দ্রর বিয়ের প্রস্তাব। লতার উপর তখন গোটা মঙ্গেশকর পরিবার নির্ভরশীল ছিল। লতা বিবাহিত লোককে বিয়ে করে ‘দুসরি দুলহন’ হতে চাননি। আর এতেই ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন রামচন্দ্র। রামচন্দ্র ভাবেন, লতা তাঁকে ব্যবহার করেছে গানের জগতে ওপরে উঠতে। লতা এক অতীতের সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “রামচন্দ্রের ইউনিটের এক রেকর্ডিস্ট তাঁদের এই সম্পর্কের গল্প মিডিয়ার কাছে রটিয়ে দেয়। কিন্তু তবু ওই রেকর্ডিস্টকে রামচন্দ্র বরখাস্ত করেননি। সবটাই রামচন্দ্রর পরিকল্পনা।”
চরিত্রে দাগ লাগছে দেখে লতা সমস্ত ব্যবসায়িক চুক্তি ছিন্ন করে দেন রামচন্দ্রের সঙ্গে। রামচন্দ্র শেষ অবধি লতাকে পাননি, কিন্তু তিনি পরে আর একটি উপপত্নী রেখেছিলেন। রামচন্দ্রর অনেক প্রতিভা থাকলেও লতার সঙ্গে বিচ্ছেদ তাঁর কাল হয়ে দাঁড়ায়। রামচন্দ্রকে কোনও ফিল্ম প্রোডিউসার আর কাজ দেননি। তাঁরা চাননি রামচন্দ্রকে কাজ দিয়ে লতা মঙ্গেশকরের চক্ষুশূল হতে। শেষ অবধি কর্মহীন হয়েই শেষ জীবন কেটেছিল সি রামচন্দ্রর।এই রামচন্দ্রের সুরেই রয়েছে লতা মঙ্গেশকরের সেই অমর গান ‘অ্যায় মেরে ওয়াতনকি লোগো’। এই গান রামচন্দ্র আশা ভোঁসলেকে বাদ দিয়ে লতাকে দিয়েই গাইয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে লতা-রামচন্দ্রর মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যায়।
‘নীলা আসমান শো গ্যয়া’
লতা মঙ্গেশকর অন্তর থেকে যে পুরুষকে ভালবেসেছিলেন তিনি ডুঙ্গারপুর রাজপরিবারের মহারাজা, রাজ সিংহ। রাজ সিংহ তৎকালীন সময়ের একজন বিখ্যাত ক্রিকেটার। এছাড়াও তিনি সে সময়ে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিআই) প্রেসিডেন্ট ছিলেন। রাজ সিংহ ছিলেন লতা মঙ্গেশকরের ভাই হৃদয়নাথ মঙ্গেশকরের বন্ধু। পরবর্তীকালে তিনি লতারও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। লতার গানের ভক্ত ছিলেন রাজ।
সেই সুঠাম চেহারার ক্রিকেটার ঝড় তুলেছিলেন লতার বুকে। এরপর যখন ভালবাসাকে পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় এল, তখনই বাধ সাধল রাজ সিংহের পরিবার। রাজ সিংহের বাবা মহারাজ লক্ষণ সিংজি সেই সময় দুঙ্গারপুরে রাজত্ব করছিলেন। তিনি তাঁর ছোট ছেলের বিয়ে কোনওমতেই এক সাধারণ পরিবারের মেয়ের সঙ্গে হতে দিতে রাজি ছিলেন না। লতা বিখ্যাত গায়িকা হলেও অভিজাত রক্ত তাঁর ছিল না জন্মসূত্রে।

মহারাজ লক্ষণ সিংজির প্রবল আপত্তির কারণেই রাজ সিংহ এবং লতা মঙ্গেশকরের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। বাবা-মায়ের কাছে রাজ সিংহকে প্রতিজ্ঞা করতে হয়েছিল, কোনও সাধারণ পরিবারের মেয়েকে তিনি রাজ ঘরানার পুত্রবধূ করবেন না। রাজ সিংহও বাবা মায়ের কথার অমান্য না করতে পেরে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন তিনি আজীবন বিয়ে না করে অকৃতদার থাকবেন।
রাজ সিংহ যখন এমন প্রতিজ্ঞা করেন তখন তাঁর ভালবাসা এবং প্রতিজ্ঞাকে সম্মান দেখিয়ে লতাও আজীবন অবিবাহিত থাকার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর বাকি সময়টা তাঁরা একে অপরের ভাল বন্ধু হিসেবেই কাটিয়ে দেন। ভালবাসা হয়তো অপূর্ণ থাকল, তবে অধিকারবোধ না রেখে এক স্বর্গীয় ভালবাসার পরিণতি পেল এই প্রেম।২০০৯ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর, স্নায়ু ও মস্তিষ্কের রোগে আক্রান্ত হয়ে রাজ সিংহ দুঙ্গারপুরের মৃত্যু হয়। লতার থেকে ৬ বছরের বড় রাজ সিং আদর করে লতাকে ‘মিট্টু’ বলে ডাকতেন আর পকেটে সবসময় একটি টেপ রেকর্ডার নিয়ে ঘুরতেন। সেই রেকর্ডারের মধ্যে রেকর্ড করা থাকত তাঁর ‘মিট্টু’ লতা মঙ্গেশকরের বিখ্যাত কিছু প্রেমের গান।
‘দিল হুম হুম করে’… কলঙ্কভাগী লতা
লতার জীবন, যৌবন পুরোটাই যে স্বর্গীয় প্রেমে দেবীত্ব প্রাপ্ত হয়েছিল তা কিন্তু নয়। আরও অনেক বিখ্যাত পুরুষ এসেছিল লতার জীবনে। তেমনি অভিযোগ করেছিলেন সেইসব নামী পুরুষদের স্ত্রী-রাও।
প্রথম নাম ভূপেন হাজারিকা। ভূপেন হাজারিকা ভালবেসেই বিয়ে করেন উচ্চশিক্ষিতা নৃত্যশিল্পী প্রিয়ম্বদা প্যাটেলকে। কিন্তু ভূপেনের জীবনে বহু নারীর ঘনঘটা ছিল, যার একটি নাম লতা মঙ্গেশকর। প্ৰিয়ম্বদা তাঁর সংসার ভাঙার নেপথ্যে লতাকেই দায়ী করেছিলেন প্রেসের কাছে। দায়ী শুধু নয়, প্ৰিয়ম্বদার অভিযোগ ছিল আরও গুরুত্বর। কলকাতা শহরকে ঘিরেই দানা বেঁধেছিল এই ত্রিকোণ প্রেম। প্ৰিয়ম্বদা হাজারিকা বলেছিলেন, “টালিগঞ্জে আমাদের থ্রি বেডরুম ফ্ল্যাট ছিল। লতা কলকাতা এলে আমাদের ফ্ল্যাটে এসে উঠতেন এবং ভূপেনের সঙ্গে লতা একটি বেডরুম শেয়ার করতেন। আমার কোন বাকস্বাধীনতা ছিল না। দিনের পর দিন এই যন্ত্রণা সহ্য করে উঠতে পারিনি।”

কেন লতা মঙ্গেশকরের মতো গায়িকার গায়ে এমন কাদা ছেটানোর চেষ্টা করেছিলেন প্ৰিয়ম্বদা? সত্যি কি ভূপেন হাজারিকার সঙ্গে থাকতেন লতা? এ প্রশ্নের উত্তরে প্ৰিয়ম্বদা শেষ বয়সে আগল খুলে বলেছিলেন “কল্যাণজী-আনন্দজী ভূপেনকে আমার ঘরে সেইসব রাতে ফেরাতে পারেননি। প্রশ্ন করেছিলাম, স্বামীকে কেন লতার সঙ্গে সারারাত এক ঘরে কাটাতে হয়! ভূপেন বলেছিলেন ‘করতে হয় এসব।’ একবার তো লতা বলেও বসেছিলেন এয়ারপোর্টে, ‘তোমার থেকে তোমার স্বামীকে আমি বেশি ভালবাসি। টালিগঞ্জের ফ্ল্যাটের দেওয়াল জানে আমার নীরব কান্নার কথা।”– এসব অভিযোগ ভূপেনের স্ত্রীর।
ভূপেন হাজারিকার জীবনে পরেও আসেন বহু নারী। পরিচালিকা কল্পনা লাজমি শেষ বয়সে ভূপেনের সহায় হন। সতেরোর কল্পনা পড়েন চল্লিশ পেরোনো ভূপেনের প্রেমে। কল্পনার ‘রুদালি’ ছবিতেই সেই গান ‘দিল হুম হুম করে’, লতা গেয়েছিলেন ভূপেনের সুরে। ভূপেন জায়ার অভিযোগ অবশ্য তাঁর চরিত্রে কাদা ছেটানোর চেষ্টা বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন লতা। আজ তাঁদের এক জনও আর জীবিত নেই তবু তাঁদের অকথিত সে প্রেমের কথা লেখা আছে এ শহরের বুকে।
আর যেন নেই কোনও ভাবনা…
‘জীবন তৃষ্ণা’ ছবির কাস্টিংয়ে ছিলেন উত্তম কুমার ও অরুন্ধতী দেবী। পরিচালক অসিত সেন। তার আগে অসিত সেনের সঙ্গেই অরুন্ধতীর ‘পঞ্চতপা’, ‘চলাচল’ ছবি সুপারহিট। কিন্তু যখন ‘জীবন তৃষ্ণা’র গানের রেকর্ডিং পাকা হল, তখনই অরুন্ধতী অসিত সেনকে না বলেকয়ে বিদেশ চলে গেলেন। একেবারে ভরাডুবি অবস্থা অসিত সেনের। সেসময় অসিত সেনকে মনের জোর দিতে তাঁর পাশে এসে দাঁড়ান লতা মঙ্গেশকর। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও কলকাতার সূত্রেই লতার সঙ্গে অসিতের আলাপ। যখন অসিত সেন নায়িকা বিরহে পাগলের মতো ঘুরছেন, সেসময় লতা তাঁকে দিয়েছিলেন মনের জোর। দীর্ঘদিন ঘনিষ্ঠ অন্তরঙ্গতা ছিল তাঁদের।
অসিত সেন তাঁর আত্মজীবনীতেও বুঝিয়ে দিয়েছেন, বম্বের এক নির্জন স্থানে লতার কাঁধে মাথা রেখে খুঁজে পেয়েছিলেন মনোবল। শেষ অবধি অরুন্ধতী দেবীর পরিবর্তে নায়িকা এলেন সুচিত্রা সেন। আর অসিত সেন গানের রেকর্ডিং লতার কথাতেই করলেন বম্বেতে। ‘জীবন তৃষ্ণা’ ছবিতে লতা প্লে ব্যাক করলেন দীপ্তি রায়ের লিপে, ‘ফেলে আসা পথপানে কে ডাকে আমায়?’
অসিত সেনের ‘জীবন তৃষ্ণা’ ও ‘দীপ জ্বেলে যাই’ দুটি ছবিতেই লতা গেয়েছিলেন। তবে বাংলা ছবিতে লতা কণ্ঠ সুচিত্রা সেনের লিপে ছিল না। তবে ‘মমতা’তে লতা গাইলেন সুচিত্রার লিপে। অসিত সেনকে বম্বের মাটিতে একাকীত্ব ঘুচিয়ে মনে শক্তি দিয়েছিলেন যিনি, তিনি লতা মঙ্গেশকর। লতা অসিত সেনের ছবিতে গান করায় ছবির ব্র্যান্ডভ্যালু অনেক বেড়ে যেত। লতা-অসিত সেন অন্তরঙ্গতা যে মিথ্যে নয়, তা বলেছেন তাঁদের ঘনিষ্ঠরাই।
সাতসকালে মনের দোরে কড়া নাড়ল কে …
সলিল চৌধুরী-লতা মঙ্গেশকর জুটি ভারতীয় সঙ্গীতে ইতিহাস সৃষ্টিকারী জুটি। এই জুটির ফ্লপ গান নেই বললেই চলে। লতা-সলিলের সফলতার পেছনে ছিল কোন রসায়ন? অবশ্যই দুজনের উপর মা সরস্বতীর আশীর্বাদ। তবে সুরের জাদু যেমন তামাম দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা, তেমন নিজেরাও জড়িয়ে পড়েছিলেন অন্তরঙ্গ দুর্বল মুহূর্তে।
মাঝেমধ্যেই রেকর্ডিং ফেলে সলিল চলে আসতেন লতার বাড়ি। আজও কান পাতলে শোনা যায় এসব গুঞ্জন। সলিলের প্রথম স্ত্রীকে চিরকাল থেকে যেতে হয়েছিল অপরিচিতা পরিচয়ে। দ্বিতীয় স্ত্রী সবিতা চৌধুরী চিরকাল ‘বউ কথা কউ’-এর মতো প্রতিবাদী গানই পেয়েছেন সলিলের থেকে। সলিল রোম্যান্টিক গান লিখতেন একজনের জন্যই, তিনি লতা মঙ্গেশকর। আর এই সম্পর্কের সুযোগও নেন লতা। নিজের পছন্দের গান পেতে লতা শেষ জীবনে চোরাবালিতে এনে দাঁড় করান সলিল চৌধুরীকে। লতা সলিলের কাছে বায়না ধরে বসেন, তিনি গাইবেন আবার ‘রানার’।
হেমন্তের কণ্ঠে আইকনিক হয়ে ওঠা ‘রানার’ কিছুতেই লতাকে গাইতে দিতে রাজি হন না সলিল। শেষ অবধি লতা হুমকি দেন, সলিল যদি না তাঁকে ‘রানার’ গান দেন, তাহলে প্রেস ডেকে লতা তাঁদের দুজনের গোপন গল্প বেআব্রু করে দেবেন। শেষ অবধি নিরুপায় সলিল লতার কাছে নতিস্বীকার করেন।
শিল্পীদের শিল্পকে সামনে রাখা হয় তাঁদের ব্যক্তিগত জীবন আড়াল করে। তবু ইতিহাস কথা বলে। গানগুলো কথা বলে।
১৯৮৮ সালে লতা গাইলেন, ‘অবাক রাতের তারারা’ অ্যালবামে, সলিলের সুরে ‘রানার ছুটেছে তাই ঝুমঝুম ঘন্টা বাজছে রাতে’। কিন্তু লতার বাংলা উচ্চারণে সেই হেমন্ত কণ্ঠের নাটকীয়তা ফুটল না। হেমন্ত অবশ্য বলেছিলেন, ” লতা ভালই তো গেয়েছে।” হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কোনও দিন কারও সমালোচনা করেননি। শ্রোতারাই তাঁর হয়ে জবাব দিয়েছিল। শ্রোতারা বুঝিয়ে দিল, ‘রানার’ সলিল চৌধুরীর একার গান নয়,’রানার’ সলিল-হেমন্ত জুটির যুগলবন্দি, যার বিকল্প লতা মঙ্গেশকরও নন।
মধু গন্ধে ভরা…
লতা মঙ্গেশকর বাংলা গান গাইতে পেরেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সাহচর্যে। তাই লতা চিরকাল হেমন্তর কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। লতার বাংলা শেখার হাতখড়িও হেমন্তের কাছেই। লতা প্রথম কলকাতা এসে উঠেওছিলেন হেমন্তের বাড়িতে। তখন হেমন্তর বিয়ে হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, হেমন্তদের তখন যৌথ পরিবার। তাতেও সুন্দর মানিয়ে নিয়েছিলেন লতা। লতা বলতেন “হেমন্তদার পরিবার যেন ঠিক শরৎচন্দ্রের গল্পের মতো।”
হেমন্ত-লতা সম্পর্ক নিয়ে কম গসিপ হয়নি। কিছু কথা হেমন্ত নিজেই লিখে গেছেন তাঁর আত্মজীবনীতে। “তখন ১৯৫৪ সাল। সেই বছরই আমার মেয়ে রাণু হল। যেদিন রাণু হল, সেদিনটা আমার বেশ মনে আছে। সেদিন আমার লতার সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ডিং ছিল। ‘তোমার হল শুরু আমার হল সারা’ আর ‘মধু গন্ধে ভরা।’ লতার সঙ্গে তখন আমার সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। প্রায় ঘরের লোকের মতো। লতার ইচ্ছেতেই ডুয়েটটা হয়েছিল। খবর পেলাম বেলা নার্সিংহোমে চলে গেছে লেবার পেন ওঠায়। বেলার তখন সাত মাস চলছে। আমি আর নার্সিংহোমে গেলাম না, ফিল্মিস্তানে যাওয়ার ব্যস্ততায়। রাণুর জন্ম হল।”
কেন হেমন্ত এতই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যে মেয়ে হওয়ার সময়ে হাসপাতালে গেলেন না। এক হেমন্ত-সহকারী জানাচ্ছেন, সেদিন লেবার পেন ওঠার আগেই ওই অবস্থায় বেলা মুখোপাধ্যায় হাজির হয়েছিলেন হেমন্ত-লতার রেকর্ডিং স্টুডিওতে। কেন? সব কেন-র উত্তর পাওয়া যায় না। তার আগে অবশ্য লতাই বেলার সাধ দিয়েছিলেন রাণু হওয়ার সময়।
আবার লতার প্রেম নিয়ে এমন গুঞ্জনও রটেছিল যে বাঙালি সুরকার নচিকেতা ঘোষ বম্বে গিয়ে লতাকে নিয়ে উধাও হয়ে গেছেন। তবে ক্ষণিকের সন্দেহ দিয়ে পুরো জীবন বিচার করা যায় না। দু’জন নারীর মধ্যে চাপা অধিকার বোধের লড়াইও এত সহজে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো মানুষকে কলুষিত করতে পারে না।
এই প্রতিবেদনে উঠে এসছেন লেজেন্ডারি মানুষরা, যাঁদের সাধারণ বুদ্ধিতে ছোঁয়া যায় না। সবথেকে বড় কথা, একটি প্রতিভা আর এক প্রতিভার সামনে এলে দু’জনেরই স্বাভাবিক মুগ্ধতার সৃষ্টি হয়। দু’জনেই একই সৃষ্টিতে মগ্ন। সে মুগ্ধতা শিল্পের। এই মুগ্ধতা এড়িয়ে চলতে পারেননি অনেকই। লতা ও তাঁর প্রেমিকরাও ব্যতিক্রম নন।
২১ বার বন্দেমাতরম গান রেকর্ডিং করতে হয় লতা মঙ্গেশকরকে! জানুন অজানা কাহিনি