Latest News

স্তনহীন তরুণীর কথা বলে সমাজের ছক চুরমার করেন কৌশিক, এগিয়ে দেন বাংলা ছবিকে

শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

Subhadeep Bandyopadhyay

‘ভরা বুক’ না ‘বুক ভরা ভালবাসা’– ২০০৫ সালে এই একটি লাইন লেখা পোস্টারে ভরে গেছিল সারা কলকাতা। উত্তর থেকে দক্ষিণ, গোটা কলকাতার দেওয়ালে এই পোস্টার কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কী অর্থ, জানতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল সবার মন। কিন্তু বিষয়টি সবার কাছেই যেন ছিল গোপনীয়। কেন এমন রহস্যময় পোস্টার লাগানো হয়েছিল কলকাতা জুড়ে?

নারী শরীরের স্তন নিয়ে পুরুষের ফান্ট্যাসির শেষ নেই। সেই আদিম কাল্পনিক যৌনবাসনা বাস্তবে না পেলে কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে সেই নিয়েই ছবি করেছিলেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় (Koushik Ganguly), ‘শূন্য এ বুকে’ (Shunyo E Bukey)। সেই ছবিরই ট্যাগলাইন লেখা ছিল শহরে সাঁটা পোস্টারগুলিতে। ফ্যান্টাসির সঙ্গে বাস্তব না মিললে যে হতাশা ও হাহাকার শুরু হয়, তা খুব কাছের মানুষের সঙ্গেও ভাগ করে নেওয়া যায় না। চলতে থাকে নিজের সঙ্গে নিজের টানাপড়েন। এই নিয়েই সেই ছকভাঙা ছবি।

সৌমিত্র, একজন প্রতিভাবান চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর, আর্ট ওয়ার্কশপের জন্য খাজুরাহোতে যায় এবং সেখানে তাঁর সঙ্গে তিস্তার আলাপ হয়। কলকাতায় এসে সেই ভাললাগা ভালবাসায় পরিণতি পায়। তাঁরা একে অপরের প্রেমে পড়ে। পারিবারিক ও অর্থনৈতিক বিশাল ফারাক থাকা সত্ত্বেও তাঁরা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। তিস্তা তাঁর ধনী, বনেদি পরিবার ছাড়ে চালচুলোহীন সৌমিত্রকে ভালবেসে।

এত পর্যন্ত সবই ঠিক চলছিল, কিন্তু বিশ্বাস টলে যায় ফুলশয্যার প্রথম রাতেই।

সৌমিত্র স্তম্ভিত হয়ে আবিষ্কার করেন, স্ত্রী তিস্তার বুক সমতল। ধাক্কাটি প্রথমে প্রতারণা, রাগ এবং অবশেষে তা ঘৃণার রূপ নেয়। খানখান হয়ে যায় সংসার। একজন আর্টিস্ট তাঁর তুলির টানে হাতের জাদুতে, তাঁর মনের মাধুরী দিয়ে যে নারীমূর্তি তৈরি করেন, সেটি যদি তাঁর বাস্তবের ভালবাসার নারীর সঙ্গে না মেলে, তাহলে কী পরিণতি হতে পারে, সেই নিয়েই এমন সাহসী ছবি, ‘শূন্য এ বুকে’।

কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ছকভাঙা ছবি প্রশ্ন তুলেছিল, জীবনে কোনটা বেশি জরুরি, নিখুঁত শরীর নাকি মনের ভালবাসা? পুরুষের চোখে কি নারীর শরীরটাই সব? শারীরিক কমতি থাকলে নারী কি স্বামী-সন্তান নিয়ে সত্যিই সুখে সংসার করতে পারে না? সব পুরুষের দৃষ্টিই কি সমান? ভাবনাতেই কি রয়ে যায় পুরুষতন্ত্রের বীজ! সব প্রশ্নেরই প্রায় উত্তর দিয়েছিল এই ছবি। তাতে করেই যেন সময়ের থেকে এগিয়ে গিয়েছিলেন কৌশিক।

Image - স্তনহীন তরুণীর কথা বলে সমাজের ছক চুরমার করেন কৌশিক, এগিয়ে দেন বাংলা ছবিকে

‘শূন্য এ বুকে’ ছিল কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় ছবি। এর আগে ২০০৪ সালে ‘ওয়ারিশ’ ছবি দিয়ে কৌশিকের বড় পর্দায় আত্মপ্রকাশ ঘটে। কৌশিক প্রথম এক সংবাদপত্রে রবিবাসরীয় সাময়িকীতে লিখেছিলেন তাঁর লেখা ‘আবক্ষ’ গল্প। যে গল্পটি নাড়িয়ে দিয়েছিল সেই রোববার। গল্পের সঙ্গে ছিল শুধু একটি বক্ষ আবরণীর ছবি।

বছর দুয়েক পর এই গল্প অবলম্বনেই কৌশিক ভাবলেন তাঁর ফিচার ফিল্ম ‘শূন্য এ বুকে’। এই ছবির প্লট বাংলা ছবিকে একধাক্কায় সাবালক করে দিয়েছিল। তবে দাম্পত্য জীবনের বন্ধ দরজার আড়ালের সেই গল্প নিয়ে কোনও প্রযোজক ছবি করতে চাননি। সবাই ফিরিয়ে দিয়েছিলেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়কে। প্রায় নিরাশ হয়ে যান কৌশিক। ভাবেন, তাঁর নিজের লেখা গল্পের আর ছবি হল না।

কিন্তু সেসময় কৌশিককে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেন এক নারীই। দূরদর্শন সঞ্চালিকা শাশ্বতী গুহঠাকুরতা প্রযোজনা করেছিলেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের আধুনিক ছবি, ‘শূন্য এ বুকে’। বিদুষী শাশ্বতীর মনে হয়েছিল, এমন ঘটনা কত বিবাহিত মেয়ের জীবনে ঘটে কিন্তু তা প্রকাশ্যে আসে না। ফ্ল্যাট চেস্টেড নারীরাও সাহস পাবেন এই নিয়ে ছবি হলে। সমাজের কাছে যাবে শুভবার্তা।

Image - স্তনহীন তরুণীর কথা বলে সমাজের ছক চুরমার করেন কৌশিক, এগিয়ে দেন বাংলা ছবিকে

ছবিতে অভিনয় করেন চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়, কৌশিক সেন, টোটা রায়চৌধুরী, খরাজ মুখোপাধ্যায় ও রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। শর্মিষ্ঠাদির ভূমিকায় রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের চরিত্রটি ছিল অত্যন্ত সাহসী এক আধুনিকার। ‘বিয়ের আগে পৌরুষের পরীক্ষা দিতে কোনও পুরুষ কি তাঁর হবু স্ত্রীর সামনে প্যান্টের চেন খুলে শিশ্ন প্রদর্শন করে? তাহলে কেন একজন মেয়ে সমতল স্তনের কারণে অপরাধী হবে?’– রূপার এই সংলাপ কাঁপিয়ে দিয়েছিল পর্দা।

বহু ছেলেই তাঁদের আড্ডায় মেয়েদের বুকের মাপ নিয়ে যৌনরসাত্মক আলোচনায় মেতে ওঠে। সে আলোচনার গতিমুখে সবসময়ই বাতিল হয় সমতল স্তন বা ছোট স্তনের মেয়েরা। তারা যেন ভালবাসার, প্রেমের, বিয়ের, আদরের অযোগ্য। শুধুই হাসির খোরাক। যেন পুরুষের কাছে নারীর স্তন সেক্স টয় ছাড়া কিছু নয়। স্বামীর জীবনে স্ত্রীর ভূমিকাও যেন স্তন দিয়েই বিচার্য হয়ে ওঠে। ছোট স্তন বা সমতল বুক তো বহু মেয়ের থাকেই, তা ছাড়াও ব্রেস্ট ক্যানসারের মতো অসুখে কত মহিলার স্তন বাদ যায়। সমাজের নিচু ধারণা তাঁদের আজও হয়তো অপরাধী বানিয়ে দেয় ভালবাসার জনের কাছে।

এই ধারণাকেই ভেঙে খানখান করে কৌশিকের ছবি। বার্তা দেয়, স্তনের ঊর্ধ্বে ভালবাসার।

Image - স্তনহীন তরুণীর কথা বলে সমাজের ছক চুরমার করেন কৌশিক, এগিয়ে দেন বাংলা ছবিকে

২০০৫ সালে নন্দন সিনেমা হলে মুক্তি পায় ‘শূন্য এ বুকে’ ছবিটি। ‘ভরা বুক’ না ‘বুক ভরা ভালবাসা’ পোস্টার দেখেও কৌতূহলী হয়ে ওঠা জনতা ভিড় করেছিলেন হলে। পরবর্তী কালে কৌশিক সমপ্রেম নিয়ে ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’ থেকে তৃতীয় লিঙ্গ নিয়ে ‘নগর কীর্তন’– একাধিক ছবি করলেও ‘শূন্য এ বুকে’ ছিল সময়ের থেকে অনেকটা এগিয়ে থাকা ছবি। এত গোপন কথা যে পর্দায় ফুটিয়ে তোলা যায়, তা দেখিয়েছিলেন একমাত্র কৌশিকই। এ ছবির তারিফ করেছিলেন খোদ ঋতুপর্ণ ঘোষ।

অভিনয়ে চূর্ণী এই ছবির প্রাপ্তি ছিলেন। বড় পর্দায় নায়িকা রূপে এটি চূর্ণীর দ্বিতীয় ছবি ছিল। কৌশিকের যোগ্য সহধর্মিণী চূর্ণী। পরবর্তীকালে চূর্ণী পরিচালক হিসেবে সমাদৃত এবং কৌশিক একজন সফল অভিনেতাও হয়ে ওঠেন। দু’জনে আবার বিপরীত ভূমিকাতেও সফল। এক অপরাধবোধে ভোগা চরিত্রে দুর্দান্ত ছিলেন কৌশিক সেন। আর সমাজের শ্রেষ্ঠ পুরুষের ভূমিকায় নজর কেড়েছিলেন টোটা রায়চৌধুরী। ছবিতে প্লে ব্যাক করেন খরাজ। আবহ সঙ্গীত চিরদীপ দাশগুপ্তর, যিনি বর্তমানে ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত নামে বিখ্যাত। অপূর্ব পোশাক পরিকল্পনার দায়িত্বে ছিলেন চূর্ণী নিজেই। পোস্টার ক্যালিগ্রাফি করেন গৌতম বরাট।

কৌশিক যে ছক ভাঙতেই টলিউডে এসছেন তা তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। এই ছবির মাধ্যমে অপর্ণা সেন, গৌতম ঘোষ, ঋতুপর্ণ ঘোষের পরে সেরা পরিচালক হিসেবে নাম উঠে এসেছিল কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের। তাঁর প্রথম ছবি ‘ওয়ারিশ’ ভাল ছবি হলেও, সফলতা পাইনি। তাই ‘শূন্য এ বুকে’ই কৌশিককে প্রথম লাইমলাইটে নিয়ে আসে।

Image - স্তনহীন তরুণীর কথা বলে সমাজের ছক চুরমার করেন কৌশিক, এগিয়ে দেন বাংলা ছবিকে

আমজনতা ছবির বিষয় নিষিদ্ধ মনে করলেও ছবির বিষয়বস্তুকে অস্বীকার করতে পারেনি। তাই ছবিটি বক্সঅফিসকেও নিরাশ করেনি। নারী-পুরুষের আদিম সম্পর্কের নানা প্রশ্ন দর্শকনন্দিত হয়েছিল। প্রশংসিত হয় কয়েকটি চলচ্চিত্র উৎসবেও। মহিলাদের মন ঋতুপর্ণর পরে পড়তে পেরেছিলেন কৌশিকই।

ছবিটি নিয়ে বর্তমানে চর্চা কম হলেও, আজও কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের সেরা ছবির একটি এই ‘শূন্য এ বুকে’।

সত্যজিতের প্রথম ইংরেজি ছবির নায়িকা এই মিস ইন্ডিয়া! শেষ জীবনে নিঃস্ব, নিঃসঙ্গ

You might also like