শেষ আপডেট: 8th November 2023 18:06
দ্য ওয়াল ব্যুরো: আশির দশকের মাঝামাঝি কোনও একটা সময়ের ঘটনা। বিলেতের এক কনসার্টে তখনও মঞ্চে ওঠেননি বিজয় বেনেডিক্ট! সবে গিটার আর পারকাশনে গানের প্রিলিউড শুরু হয়েছে আর সেই তরঙ্গে যেন কাঁটা দিচ্ছে গায়ে। মঞ্চে আলো-আঁধারি। বেনেডিক্ট গান শুরু করবেন কী... গোটা হল সমস্বরে গাইতে শুরু করে দিল—‘কসম প্যায়দা করনে ওয়ালে কি!’
বাকিটা ইতিহাস! বিজয়ের পায়ের তলায় তখন সর্ষে। অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটিয়ে দুনিয়া চষে ফেলছেন। সঙ্গে ‘বাপ্পি দা’।
বাপ্পি লাহিড়ীর সোনার প্রতি ঝোঁক ছিল। কিন্তু তিনি যে হিরে খুঁজে আনবেন বব্বর সুভাষের ধারণাও ছিল না। ডিসকো ড্যান্সার আগেই সুপার ডুপার হিট। ‘কসম প্যায়দা করনে ওয়ালে কি’ বক্স অফিসে পড়তেই প্রথম সপ্তাহে উঠে এসেছে ছবি তৈরির গোটা টাকা। ‘ঝুম ঝুম ঝুম বাবা’ গানে দুলছে গোটা দেশ!
এ গল্পের শুরুটা জানতে হলে ফ্ল্যাশ ব্যাকে চলে যেতে হবে আশির দশকের একদম গোড়ায়। সম্ভবত সেটা ছিল ৮১ সাল। বাপ্পি লাহিড়ী ততদিনে মুম্বইয়ের স্টার কম্পোজার-সিঙ্গার। তাঁর দেওয়া সুরে কিশোর কুমারের গাওয়া একের পর এক গান হিট করে গেছে। বিজয় বেনেডিক্টকে তখনও খুব একটা কেউ চিনতেন না। তার আগে দেব আনন্দের একটা ছবিতে গান গেয়েছেন মাত্র। তার পর লন্ডনের এক কনসার্টে হঠাৎ বাপ্পি লাহিড়ীর সঙ্গে দেখা।
বব্বর সুভাষ তার ৬ মাস আগেই বাপ্পি লাহিড়ীর সঙ্গে তাঁর পরের ছবির স্ক্রিপ্ট নিয়ে আলোচনা সেরে ফেলেছেন। ছবির নাম ‘ডিস্কো ডান্সার’। স্ক্রিপ্ট রাইটার রাহি মাসুম রাজা। ছবির প্রযোজক-পরিচালক দুই-ই বব্বর সুভাষ।
লন্ডনে বেনেডিক্টের সঙ্গে দেখা হতে বাপ্পি লাহিড়ীই প্রস্তাব দেন, একটা নতুন ছবি আসছে। তুমি কাজ করবে? বেনেডিক্ট প্রস্তাব শোনামাত্র রাজি হয়ে যান। মুম্বইয়ে ফিরে বাপ্পি লাহিড়ী এর পর একদিন বব্বর সুভাষের সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে যান বিজয়কে। একেবারে প্রায় নতুন আনকোরা গায়ককে দিয়ে গাওয়াবেন কিনা সে ব্যাপারে তখনও কিন্তু কিন্তু ছিল বব্বরের। তা ছাড়া ছবিতে একটা গান গাওয়ার ব্যাপারে কথা দিয়ে রেখেছিলেন কিশোর কুমারও। তবে বব্বরের ভরসা ছিল ‘বাপ্পিদার’ উপর।
পরে বিজয় এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, মুম্বইয়ের কাফে প্যারেডে এইচএমভি স্টুডিওয় যেদিন প্রথম গান রেকর্ডিং হয় সেদিন যেন তাঁর হাত পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। ‘আই অ্যাম এ ডিস্কো ডান্সার’ গানটা রেকর্ড হবে। বাপ্পি লাহিড়ী সুর করে ফেলেছেন। স্টুডিওয় পৌঁছে বিজয় দেখেন যন্ত্রশিল্পী, কোরাস গায়ক-গায়িকা মিলে প্রায় একশ জন রয়েছেন। মিঠুন চক্রবর্তী সাহস জুগিয়ে বলেন, ভয় নেই ব্রাদার। শুধু গলায় একটু দম চাই। সমস্ত এনার্জি ঢেলে দিও।
বিজয়ের কথায়, “সেদিন এটুকু বুঝেছিলাম যে আমার সেরাটা ঢেলে দিতে হবে। সকালে রেকর্ডিং শুরু করে শেষ হয়েছিল অনেক রাতে।”
বব্বরের পরিচালনায় ডিস্কো ডান্সার রীতিমতো আন্দোলিত করে তুলেছিল বক্স অফিস। ভারতের বাজারে তো বটেই সোভিয়েত রাশিয়া, চিন, তুরস্ক সহ পশ্চিম এশিয়ায় বিপুল বাণিজ্য করেছিল সেই ছবি।
বব্বর সুভাষ তার পর আর ফিরে তাকাননি। সেই এক কেমিস্ট্রিতে তৈরি করে গেছেন একটার পর একটা ছবি। তাঁর প্রযোজনা, বাপ্পি লাহিড়ীর সুর, আনজানের লিরিক্স আর রাহি মাসুম রাজার স্ক্রিপ্ট। হিরো মিঠুন চক্রবর্তী আর তাঁর কণ্ঠে অন্তত একটা বা দুটো গান সেই বিজয় বেনেডিক্টের। কসম প্যায়দা করনে ওয়ালে কি, ডান্স ডান্স, কম্যান্ডো—সব হিট।
ডিস্কো ড্যান্সার ছবিতে বিজয় বেনেডিক্টকে দিয়ে একটাই গান রেকর্ড করিয়েছিলেন বাপ্পি লাহিড়ী। ওই ছবিতে বাপ্পি লাহিড়ীর গাওয়া গানও ছিল। সোলো গেয়েছিলেন ‘ইয়াদ আ রাহা হ্যায়’ গানটি। আর ঊষা উত্থুপের সঙ্গে ডুয়েট গেয়েছিলেন—‘কই ইয়াহ আহা নাচে নাচে- আউয়া আউয়া’। ছবিতে সুরেশ ওয়াদিকারের গাওয়া গানটিও সুপারহিট হয়েছিল—‘গোরো কি না কালো কি দুনিয়া হ্যায় দিলওয়ালো কি’। বরং তুলনায় কিশোর কুমারের গাওয়া গানটি ততটা হিট করেনি। কিশোর গেয়েছিলেন—‘জারা মুড়কে’ গানটি। ডিস্কো ডান্সারে বিজয় বেনেডিক্ট ছাড়াও আর একটি কম পরিচিত মুখকে দিয়ে গান গাইয়েছিলেন বাপ্পি লাহিড়ী। তিনি নান্দু ভেন্ডে। ডিস্কো ড্যান্সারে তাঁর গাওয়া গান ‘কৃষ্ণা ধরতি পে আজা’ গোল্ড ডিস্ক পেয়েছিল।
তবে সব গানের সেরা হয়ে উঠেছিল ‘আই অ্যাম এ ডিস্কো ড্যান্সার’। সেই গানের সাফল্য নিয়ে আপ্লুত ছিলেন মিঠুনও। বব্বর-বাপ্পি লাহিড়ীও বুঝে গেছিলেন রসায়ন জমে গেছে। মিঠুনের সঙ্গে বব্বরের পরের ছবিই ছিল ‘কসম প্যায়দা করনে ওয়ালে কি’। ৮২ সালে ‘ডিস্কো ডান্সার’ মুক্তি পাওয়ার মাত্র ২ বছরের মধ্যেই মুক্তি পেয়েছিল ‘কসম প্যায়দা করনে ওয়ালে কি’। সেই গানও আর ভারতের স্থল সীমান্তে বাঁধা পড়ে ছিল না। রাশিয়া ও পশ্চিম এশিয়ায় সেই গানও ছিল বাম্পার হিট।
তবে বাপ্পি লাহিড়ীর টিপিক্যাল কৌশল ছিল। বেনেডিক্টকে দিয়ে ওভার ডু করাননি। ডিস্কো ড্যান্সারের মতই পরের ছবিতে একটাই গান ছিল বেনেডিক্টের। আর সেটাই সবচেয়ে হিট।
পরে ‘ডান্স ডান্স’ ছবিতে বেনেডিক্ট গেয়েছিলেন দুটি গান—‘ডান্স উইথ পা পা পা’ আর ‘হালওয়াওয়ালা আ গায়া’। এর পর কম্যান্ডো ছবিতেও বেনেডিক্টকে দিয়ে গাইয়েছিলেন বাপ্পি লাহিড়ী।
ভাই মারা যাওয়ার পর বেনেডিক্ট অবশ্য নিজেই ক্রমশ বলিউড থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। গান অবশ্য ছাড়েননি তিনি। কিন্তু ধর্মীয় গানে নিজেকে উজাড় করে দিতে শুরু করেন বেনেডিক্ট। তবে রয়ে গিয়েছে আশির দশকের তাঁর সেই অবিষ্মরণীয় সব গান। যেগুলো আজও কিংবদন্তি।