ইউরোপীয় ও আমেরিকার উপরেও হিন্দি ছবির আন্তর্জাতিক বাজার নির্ভর করে মূলত আরব দুনিয়ার উপর।
শেষ আপডেট: 8th April 2025 12:52
দ্য ওয়াল ব্যুরো: জন আব্রাহাম অভিনীত 'দ্য ডিপ্লোম্যাট' দেশে মাঝারি মানের সাফল্য ঘরে তুললেও আরব দুনিয়ায় এই ছবি নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ায় মনে মনে খুব কষ্ট পেয়েছেন অভিনেতা। একটি সাক্ষাৎকারে জন মুখ খুলেছেন এনিয়ে। কারণ ইউরোপীয় ও আমেরিকার উপরেও হিন্দি ছবির আন্তর্জাতিক বাজার নির্ভর করে মূলত আরব দুনিয়ার উপর। পাকিস্তান, সৌদি, আমিরশাহি সহ গোটা আরব দুনিয়ায় হিন্দি ছবির কদর শীর্ষে। সেই মুলুকে ডিপ্লোম্যাট নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রযোজকদের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। দেশের বাজারে তেমন হইচই ফেলতে ব্যর্থ অভিনেতা জন আব্রাহাম নিজেই কারণ ব্যাখ্যা করেন সাক্ষাৎকারে।
গত মার্চ মাসে হলে মুক্তি পায় ডিপ্লোম্যাট। তার পর থেকে ধীরগতিতে ব্যাট চালিয়ে কয়েক সপ্তাহ ধরে চলছে। আব্রাহামের কথায়, সিনেমাটি কবে রিলিজ করেছে কেউ জানত না। এই ছবির সঙ্গে যুক্ত কারওরই সাফল্যের বিষয়ে ভরসা ছিল না। তা সত্ত্বেও আমি আমি দর্শক ও সমালোচকদের জানাই যে, তাঁদের জন্যই এই ছবি প্রাণ পেয়েছে। আমি সবসময় বলে থাকি, একটি ছবির মূল্যায়ন সবথেকে ভালোভাবে করেন দর্শকরাই।
তবে আরব দুনিয়া এই ছবিকে নিষিদ্ধ করে খুবই কষ্ট পেয়েছেন জন। তাঁর কথায়, মানুষ খুবই ছোট দৃষ্টির। এটা কখনই পাকিস্তান-বিরোধী ছবি নয়, সেভাবে তৈরি করাও হয়নি। সর্বোপরি আমরা ছবিতে এও দেখিয়েছি যে, পাকিস্তানের বিচার বিভাগ অত্যন্ত সৎ। আমরা একজন সৎ পাক আইনজীবীকে তুলে ধরেছি এবং নিরপেক্ষ একজন বিচারকের কথা। এমনকী যে পুলিশ কর্মীরা আমাদের সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলেন, তাঁরাও ভালো মানুষ ছিলেন বলে দেখানো হয়েছে। তাঁরাই অন্য লোকেদের সঙ্গে লড়াই করে বাঁচিয়েছেন। কাউকে ছোট করা আমাদের ছবির বিষয়বস্তু ছিল না, দুঃখপ্রকাশ করে বলেন জন আব্রাহাম।
কেন বিতর্ক?
ছবিতে দেশের জাঁদরেল এক রাষ্ট্রদূত জেপি সিংয়ের দৃঢ়, মানবিক ও জাতীয়তাবাদী চরিত্রকে উজ্জ্বলতর করে তোলার চেষ্টা হয়েছে। সেই সঙ্গে তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী প্রয়াত সুষমা স্বরাজের তাৎক্ষণিক দৃঢ়চেতা সিদ্ধান্ত, পাকিস্তানে ঘর বাঁধার স্বপ্নপূরণে গিয়ে আটকে পড়া উজমা আহমেদের জীবন ও নারীর সম্মান কীভাবে রক্ষা করেছিল, তা তুলে ধরা হয়েছে। সিনেমার কাহিনি সেই রাষ্ট্রদূত জেপি সিংয়ের জীবনের উপর নির্ভর করেই একটি জীবনীচিত্র হিসেবে নির্মাণ করেছেন পরিচালক। যার মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছেন জন আব্রাহাম।
২০১৭ সালের উজমা আহমেদ মামলা ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশকেই নাড়িয়ে দিয়েছিল। যার অন্যতম কারিগর ছিলেন জেপি সিং। উজমা ছিলেন দিল্লির এক যুবতী। অনলাইনে পরিচয় হওয়া এক যুবক তাহের আলির সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে পাকিস্তানে আটকে পড়েন। শুধু আটকে পড়াই নয়, বিপজ্জনকভাবে টোপে ফেঁসে গিয়ে মারাত্মক পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। উজমার অভিযোগ, তাহের তাঁকে মাথায় বন্দুক ধরে বিয়ে করতে বাধ্য করে। তাঁকে বন্দি করে রাখা হয়।
উজমার সঙ্গে তাহের আলির প্রথম দেখা হয় মালয়েশিয়ায়। তাহের ছিল পাকিস্তানি নাগরিক এবং সেখানেই তাহের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন উজমা। কিন্তু, তাঁর যুবতী মন যে সংসারের স্বপ্ন দেখছিল, তা চুরমার হয়ে যায় তাহেরের সঙ্গে পাকিস্তানে চলে আসার পর। উজমার দুঃস্বপ্নের জীবন শুরু হয় সেদিন থেকেই। পাকিস্তানে আসার পর উজমা জানতে পারেন তাহের বিবাহিত। তার চারটি সন্তানও রয়েছে। তা সত্ত্বেও তাহের তাঁকে জোর করে বিয়ে করে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে। বিয়ের পর থেকেই শুরু হয় দৈহিক-মানসিক নির্যাতন। পালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ঘরে বন্দি করে রাখাও।
প্রাণের তোয়াক্কা না করে সাহসের পরিচয় দিয়ে উজমা একটি মফসসল এলাকা থেকে পালিয়ে ইসলামাবাদে চলে আসেন। সেখানে পৌঁছেই সটান চলে যান ভারতীয় হাইকমিশনের অফিসে। কিন্তু, কোনও পাকিস্তানি বিবাহিত নারীকে দূতাবাসে ঠাঁই দেওয়া সহজ কথা নয়। আইনি ছাড়াও আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে পররাষ্ট্রীয় দূতাবাস আসলে নিজ দেশেরই ভূখণ্ড বলে সেদেশেও বিবেচিত হয়। তাই দূতাবাসের দরজায় শরণ নেওয়ার জন্য এসে পড়লেও প্রথম অবস্থায় তাঁকে আশ্রয় দেওয়া নিয়ে কূটনৈতিক জটিল ধন্দ সৃষ্টি হয়। কারণ তাঁকে আশ্রয় দেওয়ার অর্থ চরবৃত্তির অভিযোগ ওঠা।
সেই অবস্থায় ডেপুটি হাইকমিশনার জেপি সিংয়েরই বুদ্ধিতে কূটনৈতিক কর্মী এক দম্পতিকে উজমার আত্মীয় সাজিয়ে তাহির আলির সঙ্গে যোগাযোগ করানো হয়। তাকে টোপ দেওয়া হয় যে উজমাকে দূতাবাসে ঢোকার অনুমতি দিলে তাকে হাত ভরে টাকা দেওয়া হবে। তাহির সহজেই সেই টোপ গিলে ফেললে উজমা ভারতীয় দূতাবাসের আশ্রয়ে সেখানে শরণার্থী হিসেবে স্থান পান। আধা সামরিক বাহিনী তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়ে নেয়। জেপি সিং তখনই ফোন করেন তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে। সুষমাও এক মুহূর্ত না ভেবে উজমাকে 'ভারতের মেয়ে' সম্বোধন করে তাঁর নিরাপত্তা ও দেশে ফিরিয়ে আনার সব দায়িত্ব দিয়ে দেন সিংকে। আর ভাবার কিংবা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় নেননি জেপি।
কিন্তু, সেই শান্তি মোটেই স্থায়ী হল না। পাকিস্তান সরকার ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগের বস্তা খাড়া করল এবং অন্যদিকে তাহির আলে ফাঁদের কথা টের পেয়ে উজমার বিরুদ্ধে ইসলামাবাদ হাইকোর্টে মামলা দায়ের করল। জেপি সিং একযোগে উজমার নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক লড়াই চালিয়ে যেতে থাকলেন। পাকিস্তানের বিদেশ মন্ত্রককে বারবার করে পরিস্থিতি বোঝানোর চেষ্টা করতে থাকেন এবং উজমার ভারতীয় হওয়ার সমস্ত নথি-দলিল-দস্তাবেজের কপি তাঁদের সামনে হাজির করলেন। উজমার অধিকার রক্ষার জন্য সেদেশের সরকারের সঙ্গে প্রাণপণ লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন।
তাহের আলি আদালতে আর্জি জানায়, উজমা ভারতীয় দূতাবাসে লুকিয়ে রয়েছেন। তিনি তাঁর স্ত্রী এবং তাঁকে শারীরিক হাজিরার আবেদন জানান আদালতে। এদিকে ভারতীয় দূতাবাসের সাহায্যে উজমাও পাল্টা একটি নালিশ জানান আদালতে। সেখানে জোর করে বিয়ের অভিযোগের সঙ্গেই ভারতে ফেরার আবেদন জানান তিনি। এই গুরুত্বপূর্ণ আইনি লড়াইয়ে সিং সর্বশক্তি দিয়ে উজমাকে সাহায্য করে গিয়েছিলেন। সিং নিজে উজমার আইনির লড়াই দেখভাল করার জন্য পাক আইনজীবীদের নিয়োগ থেকে শুনানির সময় তাঁর সঙ্গে হাজির থাকতেন। যাতে উজমার নিরপেক্ষ বিচার পেতে কোনও অসুবিধা না হয়।
বেশ কয়েক সপ্তাহ আদালতের চৌকাঠে ঘষাঘষির পর ইসলামাবাদ হাইকোর্ট উজমার পক্ষে রায় দেয়। তাঁকে ভারতে ফেরত চলে যাওয়ারও অনুমতি দেয় আদালত। ২০১৭ সালে ২৫ মে জেপি সিংয়ের দেখভালের মধ্য দিয়েই পাঞ্জাবের ওয়াঘা সীমান্ত দিয়ে ভারতে ফিরে আসেন উজমা আহমেদ। দেশে ফিরে উজমা সাংবাদিকদের সামনে বলেছিলেন, পাকিস্তান হল এক মৃত্যুফাঁদ। সেখানকার মেয়ে-বউদের দুর্দশা বর্ণনা করে বলেছিলেন, সেখানে পশুর মতো আচরণ করা হয় মেয়েদের সঙ্গে। এক-একটি ঘরে চার-পাঁচজন করে বেগম থাকে। বিশেষ করে অত্যাচার করা হয় সম্বন্ধ করা বিয়েতে যে মেয়েরা অন্য দেশ থেকে সেখানে আসেন তাঁদের উপর।