শেষ আপডেট: 12th November 2021 16:40
'পথের পাঁচালী' ছবি তৈরির কাজ চলেছিল আড়াই বছর ধরে। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত প্রথম ঐতিহাসিক ছবি 'পথের পাঁচালী'। সেই চলচ্চিত্র নির্মাণের গল্প নিয়েই এবার ছবি করতে চলেছেন পরিচালক অনীক দত্ত। ছবির নাম 'অপরাজিত'। এই ছবিতে সত্যজিৎ রায়ের ভূমিকায় জিতু কমল। চরিত্রের নাম অপরাজিত রায়। জিতুর 'সত্যজিৎ রায়' লুক এখন এতটাই চর্চায় যে লোকে তাকে বলছে 'সত্যজিতু'। এ ছবি হতে চলেছে জিতু কমলের কেরিয়ারে বাঁকবদল ছবি।জিতু কমলের সত্যজিৎ লুক নিয়ে চলছে সোশ্যাল মিডিয়ায় জল্পনা-কল্পনা, চিত্রসমালোচক থেকে দর্শকদের মধ্যে উন্মাদনা তুঙ্গে। আলাদা করা যাচ্ছেনা আসল সত্যজিৎ রায় আর জিতু কমলের সত্যজিৎ রায় লুককে। একদম অবিকল!
কিন্তু যাকে ঘিরে এত উত্তেজনা, সেই জিতু কমল পাল কি বলছেন, কি ভাবছেন, কি করছেন এখন?
অনীক দত্ত-র 'সত্যজিৎ', জিতু কমলের সঙ্গে আড্ডায় শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ...
জিতু, তোমার 'সত্যজিৎ রায়' লুক দেখে তো ইন্ডাস্ট্রি থেকে আমজনতার মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে! ইন্টেলেকচুয়াল থেকে মেনস্ট্রিম, সবার চোখেই এখন তুমি হিরো হয়ে উঠেছ। মানিকবাবু রূপে তোমার ছবি ভাইরাল। কেমন লাগছে?
জিতু - কালকে সকালে আমার ছবি বেরিয়েছে, সেই ছবি ভাইরাল, ভালো কথা। কিন্তু এগুলো আমায় খুব একটা নাড়া দেয়না। এরকম আমি একদম ছোটো থেকেই। ফিল্ম বল, সিরিয়াল বল, পুরস্কার বা সাকসেস বল, যাই করি সেখানে আমায় ঘিরে কে কত আলোচনা করল সেসব আমি দেখিনা। আমি দেখি শুধু আমার পারফরমেন্স। এই ছবিটার ক্ষেত্রেও আমি পারফর্ম করতে ব্যস্ত থাকতাম। আজকেও যখন আমার ছবি ভাইরাল, তখন আমি আমার ঘরে একান্তে চরিত্রটার মধ্যেই ডুবে আছি।
সত্যজিৎ রায় হওয়ার অফারটা কীভাবে এসেছিল তোমার কাছে?
জিতু- পরিচালক অনীক দত্ত একদিন আমাকে ফোন করে বললেন 'তুমি তোমার অভিনয়ের একটা ভিডিও ক্লিপ পাঠাবে আমায়!' তখন উনি আমায় বলেননি ফোনে সত্যজিৎ রায়ের চরিত্রের জন্য আমাকে ভাবছেন। তো যথারীতি ওঁকে ক্লিপ পাঠালাম। তখন আমার মেগা সিরিয়ালের সঙ্গে একটা নন-ফিকশন কাজের চাপ চলছিল। তার মাঝেই একদিন আমাকে লুক টেস্টের জন্য ডেকে পাঠালেন অনীকদা। লুক সেটের যে ছবি ওঠে সেগুলো সব আর্টিস্টই দেখেন কেমন হল। কিন্তু সেটাও আমি দেখিনি। আর জানিওনা যে সত্যজিৎ রায় ভেবে পোশাক পরিয়ে আমার লুক সেট হচ্ছে। এমনি কোনও চরিত্র ভেবেছি। আমার অভিনয়জীবনে দুজন পরিচালককে দেখলাম যারা মুখেও যা কাজেও তাই। একজন গৌতম মুখোপাধ্যায়, যার হাত ধরে আমার অভিনয় জগতে আসা। তারপর এই অনীক দত্ত-কে দেখলাম, যার মুখ এবং মন প্রায় এক সুতোয় বাঁধা। এরকম মানুষ দেখতে পাওয়া খুব কঠিন। ওঁর মনের ভিতর যেটা চলছে সেটা ওঁর মুখে প্রকাশ পেতে শুরু করে। আমার লুকগুলো যখন উনি ল্যাপটপে দেখছেন তখন ওঁর মুখের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হচ্ছিল। আমি ছবিগুলো তখন দেখিনি, বাড়ি ফিরে এসেছি। রাত্রে উনি আমাকে ছবিগুলো পাঠান এবং বলেন ছবিগুলো বড় স্ক্রিনে দেখলে ভালো হয়। তো আমি স্মার্ট ভিউতে আমার টিভিতে ছবিগুলো দেখার পর অনীকদাকে বললাম "কোথায়! আমার নিজের ছবি কিছু পাঠিয়েছ? দেখছি না তো! এ তো সত্যজিৎ রায়ের ছবি।" তখন অনীকদা বলছেন "ওগুলো তোমারই ছবি।"
আমি চমকে গেছিলাম রাত্রি সাড়ে দশটার সময়। এটাই আমার প্রথম রিয়্যাকশন ছিল। কিন্তু দুর্দান্ত ভালো বলে লাফিয়ে ওঠা এগুলো কখনও হয়না আমার দ্বারা। তখন অনীকদা বললেন "তুমি করছ সত্যজিৎ রায় চরিত্রটা। তার জন্য তুমি নিজে সময় বের কর। সিরিয়ালে বল। আমার ছবির জন্য সময় বের কর।" যে চ্যানেলে সিরিয়াল করি সেই চ্যানেলের প্রযোজক আমাকে বললেন যে অবশ্যই আমি যেন এই অন্যধারার কাজটা করি। এই সুযোগ সবাই পায়না। ডেট এডজাস্ট করে দিচ্ছি। তারপর ফিল্মের প্রযোজকের সঙ্গে কথা হল। প্রথম ভাগের শ্যুটিং শুরু হল। আমি সত্যজিৎ রায়ের চরিত্রে রূপদান করলাম। ছবিতে যদিও আমার নাম অপরাজিত রায়। সব আর্টিস্টরাই কেমন শট দিল সেটা একবার দেখেন। আমি আজও অবধি সেটা দেখিনি। নিজেকে পুরোপুরি পরিচালক অনীক দত্তর ওপর ছেড়ে দিয়েছি। আমি চাইছি এই স্বপ্নের কাজটার মধ্যে থেকে যেতে। অন্য কাজে দেখি, কিন্তু এই ছবিতে আমি কী কেমন করলাম সেটা দেখব না। এটাই হয়তো আমার অস্ত্র হয়ে উঠছে এই আইকনিক চরিত্রে রূপদান করতে। আমার বডি পুরো ফেলে দিয়েছি অনীক দত্তর ওপরে। আমার ওজন একটু বেশি, সেটাও কমাতে হয়েছে সত্যজিৎ রায়ের চরিত্র করতে আর অনীক দত্তের ঘাড়ের উপর পড়ব বলে। উনি আমার শিক্ষক, উনিই আমার পথপ্রদর্শক।
এই ছবিতে তোমার চরিত্রটা তো আবির চট্টোপাধ্যায়ের করার কথা ছিল প্রথমে। ডেট প্রবলেমের জন্য আবির করতে পারলেন না। সেটা নিয়ে তোমার চাপ ছিল?
জিতু- দেখো, আবিরদার এই চরিত্রটা করার কথা ছিল, সেটা আমি জানতে পেরেছি মিডিয়া মারফৎ। আমি অনীকদার থেকে শুনিনি। আবিরদা আমার সিনিয়র। আবিরদার বাড়িতেও যাতায়াত আছে আমার। খুব ভালো অভিনেতা তো বটেই, আর একজন গুণী মানুষও। আবিরদার বাবা ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যায় আর মা রুমকি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার পারিবারিক সম্পর্ক। আমার সিনিয়রের থেকেও বন্ধু বেশি ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যায়। আবিরদা এই রোলটা করলেও একই রকমের রিয়্যাকশান পেত, যেটা আমি এখন পাচ্ছি। আবিরদা করছে তা আমি জানতাম না। আমি সত্যজিৎ রায়ের রোল করছি, তার জন্য তিন চারটে ডেট দিতে হবে অনীকদাকে, এটাই জানতাম। পরে যখন শুনলাম গোটা ছবিটাই আমায় করতে হবে আমার পক্ষেও ডেট দেওয়া মুশকিল হয়ে পড়ছিল। যেহেতু আমি টিনেজার নই, সাংসারিক মানুষ, আর যে মেগা সিরিয়ালগুলো এতদিন করে এসেছি তাদের উপরও আমার দায়বদ্ধতা আছে। ছবি করছি বলে সিরিয়ালের প্রতি দায়িত্ব অবহেলা করতে পারিনা।
টিনেজার তো নই, সংসারটাও চালাতে হয়, তাই ছবি করছি বলেই সিরিয়াল ছেড়ে দেব ভাবতে পারিনা। সবটা গুছিয়ে যে করতে পারছি সেটা ভগবানের আশীর্বাদ।
[caption id="attachment_2390000" align="aligncenter" width="480"]
জিতু-নবনীতা, সেলেব দম্পতি[/caption]
যখন আবির ফ্যানরা শুনল আবির 'সত্যজিৎ' হচ্ছেননা তখন তারা হতাশ হয়েছিল। কিন্তু তারাও এখন জিতুকে রায়সাহেব রূপে দেখে বেশি উচ্ছসিত! কী বলবে?
জিতু- এ ব্যাপারটা আমি বলতে পারবনা। কারণ সত্যজিৎ রায় রূপে আবিরদার লুকটা আমি দেখিনি। আমার নিজের লুকটাও বললাম শট দেবার সময় দেখিনি। আমি শুধু পারফর্ম করতে ব্যস্ত থাকি। আমি আবিরদা-দের দলে মানে ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যায়ের নাট্যদলেও থিয়েটার করেছি। রবীন্দ্রনাথের 'গোরা'। আমাকে সবাই এখনও বলেন সত্যজিৎ রায় যে আর্বান স্টাইলের বাংলা বলতেন সেটা আমার কথাতেও রয়েছে। কিন্তু 'গোরা' করতে গিয়ে একটু রুরাল স্টাইল বাংলা বলতে হয়েছিল। ফাল্গুনী চ্যাটার্জি, অনীক দত্ত এনাদের গাইডেন্স পেয়েছি বলেই কঠিন চরিত্র করতে পারছি।
জিতু কি এই কঠিন চরিত্র চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিচ্ছে?
জিতু- সত্যজিৎ রায়ের ভূমিকায় কাজ করা যে কারোও কাছে স্বপ্ন। আর যখন শুনলাম গোটা ছবিটাই আমাকে ঘিরে, তখন আরও ভীষণ সিরিয়াস হয়ে গেলাম। তবে আগাগোড়াই কঠিন চরিত্র করতে আমার ভালো লাগে। আমি উনিশ বছর বয়সে বুড়ো কাবুলিওয়ালা রহমতের চরিত্র করেছিলাম। সিরিয়ালেও 'মল্লার' নামের যে চরিত্রটা করেছিলাম তখন আমার পঁচিশ বছর বয়স অথচ চরিত্রটা করেছিলাম সাতচল্লিশ বছরের। যে তিনটে ছেলেমেয়ের বাবা। পরবর্তীকালে সেই মেয়েটি আমার হিরোইন হয়েছে।
'অপরাজিত' ছবিতে সত্যজিৎ রায়ের সমগ্র ব্যক্তিগত জীবন থাকবে, না শুধু 'পথের পাঁচালী' মেকিং ঘিরে চিত্রনাট্য?
জিতু- শুরুর সত্যজিৎ। 'পথের পাঁচালী' শুরু ও তৈরির গল্প। কেমন করে এই ঐতিহাসিক ছবি তৈরি হল, তার গল্প দেখানো হবে ছবিতে। তখন তো সত্যজিৎ রায়কে কেউ চিনত না। সত্যজিৎ রায়কে প্রথম ছবি 'পথের পাঁচালী' করতে যে স্ট্রাগল, ভালবাসা, প্রেম, ধাক্কা, হতাশা সবকিছু সহ্য করতে হয়েছে সেইটা ঘিরেই গল্পটা। সেইসময়ে তাঁর কিছু পারিবারিক সম্পর্ক থাকবে। আমরা ছবির প্রথম ভাগটা বীরভূমে শ্যুট করেছি। এখনও পরের পর্ব বাকি। অনীক দত্তর রিসার্চ আর সত্যজিৎ রায়ের সুযোগ্য পুত্র সন্দীপ রায়ের টিপসে ছবিটা হচ্ছে। আরও একটা চমকপ্রদ বিষয় পুরো ছবিটাই সাদা-কালোতে হবে।
[caption id="attachment_2390007" align="aligncenter" width="504"]
কমবয়সে সত্যজিৎ[/caption]
একই সাথে মেনস্ট্রিম 'হয়তো তোমারই জন্য' সিরিয়াল করছ, আবার তার সাথে 'অপরাজিত'র সত্যজিৎ! দুটো সামলাচ্ছ কীভাবে? এটাও তো বড় চ্যালেঞ্জ!
জিতু- আমার ৭-৮ রাত ঘুম নেই। ঘুম উড়ে গেছে। এটা তো শুধু স্ক্রিপ্ট নয় সেই মানুষটার ব্যক্তিত্ব, গাম্ভীর্য, ম্যানারিজম সবার চেনা, যা বাঙালিকে সমৃদ্ধ করে। সেইটা তুলতে তো বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। অন্যদিকে সিরিয়ালে গিয়ে বড় জাংক সংলাপ বলতে হচ্ছে। সিরিয়াল আমার পায়ের তলার মাটি শক্ত করেছে, এতকিছু দিয়েছে। তাই একটা ভালো ছবি করছি বলে সিরিয়ালটা ছেড়ে দিতে পারিনা। তবে আমি এনজয় করছি বেসিকালি দুধরনের কাজ একসঙ্গে করাটা।
এত অবিকল সত্যজিৎ রায় জিতু হয়ে উঠল কীভাবে? নিজেই করেছ নাকি ছবি শুরুর আগে ওয়ার্কশপ করান অনীকদা?
জিতু- অনীকদা দেখলাম সংবাদমাধ্যমকে আমার প্রশংসা করে বলছেন জিতু নিজেই সত্যজিৎ রায় হয়ে ওঠা খুব ভালো রপ্ত করেছে। কিন্তু আমি আসলে অনীকদাকেই ফলো করেছি। ওঁর সঙ্গে কাজ করে আমি বুঝেছি সর্বস্ব দিয়ে ছবিটা করছেন উনি। ওঁর জীবনের স্বপ্ন এই ছবিটা। 'ভূতের ভবিষ্যৎ','বরুণবাবুর বন্ধু' অনেক ছবিই উনি করেছেন, কিন্তু সবকটা ছবির পেছনে উনি সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে এই ছবিটা করবার কথা ভেবে গেছেন। সত্যজিৎ রায়কে উনি যাপন করেন। রায়সাহেবকে নিয়ে পড়াশুনো করে, রিসার্চ করে অনীক দত্ত নিজেই সত্যজিৎ রায়ের অনেক ম্যানারিজম রপ্ত করে ফেলেছেন। আমি তো অনীক দত্তকে দেখে দেখেই এই ম্যানারিজমগুলো তুলে ফেলেছি। এটা অনীকদা নিজেও জানেননা। আজ প্রথম এই সাক্ষাৎকারে বললাম।
[caption id="attachment_2389995" align="aligncenter" width="600"]
পরিচালক অনীক দত্ত[/caption]
সত্যজিৎ রায়ের শ্যুটিংয়ের ভিডিও কিছু আমি দেখছিলাম তখন ওঁর কথা বলার স্টাইল, উচ্চারণ দেখে ভাবছিলাম এটা আমি আগে কোথাও দেখেছি। পরে বুঝলাম অনীক দত্তই তো এই স্টাইলে কথা বলেন। আমি চোখের সামনে সত্যজিৎ রায়কে দেখিনি, কিন্তু অনীক দত্তকে দেখেছি। ওঁর উচ্চারণ ফলো করেছি। (সত্যজিৎ রায়ের মতো উচ্চারণ করেও দেখালেন জিতু, যা শুনে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল)। আমি জাস্ট নিজের নোটবুকটা নিয়ে অনীক দত্তর বাড়িতে গিয়ে বসে পড়তাম। উনি যা যা করতেন সারাদিন, সে বাড়ির পরিচারিকার কাছে ব্রেকফার্স্ট চাওয়া বা স্ত্রী-র সঙ্গে কথা বলা, আমি সবটা অবজার্ভ করে গেছি। অনীকদা বলছেন, জিতু বাড়িতে সত্যজিৎ রায়ের ম্যানারিজম প্র্যাকটিস করেছে কিন্তু আসলে সেইটা নয়। আমি ওঁর থেকেই পেয়েছি এগুলো। আমার গালে শুধু প্রস্থেটিক মেকআপ হয়েছে। আর কোনও মেকআপ নেই। আমার থুতনিতে দাগ আছে এমনিতেই, কপালে ভাঁজ আমার আছে, সেগুলো কোনওভাবে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে মিলে গেছে। সেটার জন্য নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি।