
ছোটবেলার গ্যাসবেলুন থেকে মেয়েবেলার প্রথম ক্রাশ, পুজোর একান্ত আড্ডায় চিত্রাভিনেত্রী অপরাজিতা আঢ্য (Aparajita Addy)। সঙ্গে কথায় শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।
পুজো মানে অপরাজিতার কাছে কী?
পিতৃপক্ষ পর্যন্ত মানুষের জীবনে অনেক স্ট্রাগল চলে। অনেক ঝামেলা, অশান্তি পোহাই আমরা সারাবছর ধরে, যার বিনাশ হয় মাতৃপক্ষ বা দেবীপক্ষের আবাহনে। সব শ্রেণির মানুষ আনন্দে মেতে ওঠেন। পুজোয় এই যে একটা আনন্দের বাতাবরণ তৈরি হয়, সেই পজিটিভ এনার্জিটা নিয়ে আমরা আবার একটা বছর কাটিয়ে দিতে পারি। পুজো হচ্ছে মানুষের বাঁচার একটা রসদ। আড়ম্বরের বাইরে আসল পুজোর মন্ত্র এটাই আমার কাছে।
অপরাজিতা তো দেবী দুর্গার আরেক নাম। অনেকের মনে মা দুর্গা মানে অপরাজিতা আঢ্যর মুখটাই মনে পড়ে। দূরদর্শনে মহালয়ার প্রভাতী অনুষ্ঠান মহিষাসুরমর্দিনী করেছিলেন আপনি। তার কোনও স্মরণীয় স্মৃতি আছে?
আমায় দুর্গা আর কালী দুটোই সাজতে হয়েছিল। দুর্গার সময় প্রচুর লড়াই করার দৃশ্য ছিল অসুরের সঙ্গে। কিন্তু দুর্গার পর যখন কালী সাজানো হল আমাকে তখন বারবার আমার গা ছড়ে ছড়ে লাল হয়ে যাচ্ছিল। এমনকি রক্ত বেরোচ্ছিল। কীভাবে গা ছড়ে রক্ত বেরোচ্ছিল আমি জানি না। স্কিনের কোনও অসুবিধে ছিল না। একেবারেই অলৌকিক! আজও ভাবলে রোমাঞ্চিত হই। দুর্গা বা কালী সাজার পরে আমার ভিতর ভীষণ দৃঢ় একটা স্পিরিট কাজ করছিল। কালো মেক আপ, চুলে জটা বাঁধা, তখন আমার অনেক চুলও ছিল… সেই আলাদা এনার্জিটা সাধারণ কোনও শক্তি ছিল না। তাই হয়তো দর্শকের অতটা ভাল লেগেছিল। কে যেন আমাকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছিল অমন শক্তিশালী চরিত্র।
সেরার সেরা পুজোকে সম্মান জানাতে পুরস্কারের ডালি সাজাচ্ছে ‘দশভুজা সম্মান’
মা দুর্গার প্রতিমামুখ কিন্তু বাস্তবেও অপরাজিতার সঙ্গে খুব মিলে যায়!
যত কাজ করেছি আমার সবকটি চরিত্রের অন্তরালে দেবী দুর্গাকেই পোর্ট্রে করা হয় সবসময়। আজ পর্যন্ত যত সিরিয়াল, ছবি করেছি সেই সব মূল চরিত্রে আমার মধ্যে দর্শক দেবীকেই খুঁজে পেয়েছে নানা ভাবে। আমার অভিনীত ‘কুরুক্ষেত্র’ সিরিয়ালে অনন্যা যে চরিত্র, সে স্বামীর দ্বারা অত্যাচারিত, কিন্তু পরে সেই দশভুজার মতো অসুর স্বামীকে শাস্তি দিচ্ছে। সে আজ আর অবলা নেই। ভীষণ হিট সিরিয়াল ছিল ‘কুরুক্ষেত্র’। এখনও রিপিট টেলিকাস্ট হয়।তারপর ‘মা’ সিরিয়ালের প্রতিমা রায়চৌধুরী যে অন্ধ একজন মহিলা অথচ কতটা তাঁর মনের জোর। ‘জল নূপুর’-এর পাড়ি-র মধ্যেও ঈশ্বরের একটা অপার্থিব শক্তি আছে। ‘প্রাক্তন’-এর মলির মধ্যেও একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। যে খুব সহজে জীবনের অনেক সমস্যাকে মেনে নিতে পারে। শরীরের কষ্টের থেকে মনের কষ্ট কম কিছু নয়। অথচ যে অন্যের দিকে আঙুল না তুলে জীবনের স্বাভাবিক নিয়ম বলে কষ্টটাকে মেনে নিতে পারে সেই কিন্তু আসলে সুপার। মলি তাই এত মানুষের পছন্দের চরিত্র। আবার ‘চিনি’-তে যে চরিত্রটা করেছি সে যতই চেঁচামেচি করুক সে একজন মা। মায়ের উপর যতই আমরা রাগারাগি করি, কথা না শুনি, বিরক্ত হই, মা শেষমেশ মা-ই হন। আর মায়ের মধ্যেই সর্বদা থাকেন ভগবান।
ছোটবেলায় হাওড়ার পুজোর স্মৃতি?
হ্যাঁ, হাওড়ার মেয়ে আমি। ছোটবেলায় বাবার কাঁধে উঠে ঠাকুর দেখতে যেতাম হাওড়ার অন্নপূর্ণা ব্যায়াম সমিতি আর জাতীয় সেবাদলের পুজোতে। বাড়ি ফেরার সময় গ্যাসবেলুন কিনে হাত করে নিয়ে আসতাম। আর প্রায়ই অসাবধানতায় হাতের মুঠোটা খুলে গেলে ফস করে গ্যাস বেলুনটা উড়ে যেত। কী কাঁদতাম বেলুন উড়ে গেলে। আহা রে! এখন ভাবলে নিজেরই কত কষ্ট লাগে। আজকাল গ্যাসবেলুনওয়ালাদেরও আর দেখতে পাই না। ছোটবেলার সঙ্গেসঙ্গে তাঁরাও যেন হারিয়ে গেছে।
বিয়ে তো কম বয়সে হয়ে গেছিল, ‘পুজোর প্রেম’ কেমন ছিল?
পুজোতে প্রেমের কোনও ব্যাপার ছিল না। কারণ যে পাড়ায় থাকতাম সেখানে সবই বাবার বন্ধু, দাদার বন্ধু। দাদার বন্ধু আর বান্ধবীর দাদা খুব সাঙ্ঘাতিক জিনিস মেয়েদের জীবনে জানো তো! হা হা হা… ( হেসে উঠলেন অপরাজিতা তাঁর প্রাণখোলা হাসিতে)। প্রেম করছি দেখলেই বাড়িতে খবর চলে যাবে। তবে হ্যাঁ, বান্ধবীরা যখন পুজোয় একসঙ্গে বেরোতাম তখন ছেলেরা গুজগুজ ফুসফুস করত পেছনে। সেটা খুব খারাপ লাগত না। আমার যাকে খুব ভাল লাগত, একটি ছেলে ছিল, তার বাড়ির গলির সামনে দিয়ে চোদ্দোবার হেঁটে যেতাম, সে আবার আমার পেছন পেছন যেত। সেটুকুই একটা ভাল লাগা ছিল। আমাদের তো এত সাহস ছিল না প্রেম করার বা ছেলেদের সঙ্গে কফিশপ, রেস্টুরেন্টে ঘুরতে যাবার। ভাল লাগাটা আমাদের জীবনে এত সীমিত ছিল যে আমরা খুব কমেই সুখী ছিলাম জানো তো!
পুজোটাও তো এখন অনেক বদলে গেছে!
পুজোটা এখন অনেক বেশি বাণিজ্যিক। আগে পুজো মানে একটা মনের ভাল লাগা ছিল। তখন পুজোয় সাজাগোজার থেকেও বড় কথা ছিল সকালবেলা শিউলি ফুল কুড়োতে যাওয়া, স্থলপদ্ম প্যান্ডেলে নিয়ে গিয়ে মালা গাঁথব, অপরাজিতা ফুলের মাথা গাঁথা, তারপর ষষ্ঠীর দিন এক রকম ভাবে ফল কাটা, সপ্তমীর দিন আরেক রকম ভাবে ফল কাটা। এসব ছোটবেলা থেকে শিখেছি। পাড়ার দাদারাও তখন শেখাতেন এসব। আমি পাড়ার পুজো প্যান্ডেলে একটা কাজের দায়িত্ব পাব, সেটাই ছিল দারুণ উন্মাদনার ব্যাপার। ঠিক সরস্বতী পুজোয় স্কুলে কোনও কাজের দায়িত্ব পেলে যেমন ভাল লাগত।আর আমি যেহেতু একান্নবর্তী পরিবারের মেয়ে তাই আমি ছোটবেলা থেকে ঘরের কাজ সব করতে পারি। শুধু পুজো বলে নয়, মানে ধরো পাড়ায় কারও বিয়েতে গায়ে-হলুদের হলুদ বাটতে হবে, বলল যে ওই অপরাজিতাকে ডাক, ও খুব তাড়াতাড়ি অনেকটা হলুদ বেটে দেবে।
নাচও তো অপরাজিতার ছোটবেলার ভালবাসা। পুজোয় ফাংশান করতেন?
নাচ ছোট থেকেই শিখেছি। তবে এখনকার মতো তখন পুজোয় এত অনুষ্ঠান হত না। আমাদের সময় সেরকম ছিল না। হলেও কালী পুজোর পরে হত। আর পুজোটা পুজো নিয়েই মেতে থাকতে ভাল লাগত। আর তার ওপর ফাংশান করতে যাওয়া নিয়ে বাড়ি থেকে অনেক রেস্ট্রিকশনও ছিল। এখানে নাচতে যাবে না, ওখানে নাচতে যাবে না। সে অনেক ব্যাপার ছিল। এখনকার মতো তো আর নয়। তবে হ্যাঁ কিছু তো করেছি। অনেক বেছেবুছে করতে হত।বিয়ের পর তো পুজো বেহালায়?
১৯৯৭ সালে বিয়ে। তার পর আজ চব্বিশ বছর বেহালাতেই। তখন তো বেহালায় এসে প্রথম থিমের ঠাকুর দেখা শুরু করলাম। বেহালায় তখন রমরম করছে থিমের ঠাকুর। বড়িশা সহযাত্রী, শ্রীসঙ্ঘ, আদর্শ পল্লী– সে সব দারুণ এক্সাইটমেন্টের ব্যাপার ছিল। ১৯৯৭, ১৯৯৮, ১৯৯৯ খুব ঠাকুর দেখেছি। ২০০০ সাল থেকে তো আমিই ঠাকুরের বিচারে বিচারক হয়ে যেতাম। তারপর নিজেই দুর্গা হয়ে অভিনয় করলাম দূরদর্শনে এবং সেটা মানুষ আজও মনে রেখেছে।এবার পুজোর প্ল্যান কী?
এবারে পুজোর কোনও প্ল্যান নেই। এ বছর তো কোভিডে আমার শ্বশুরমশাই মারা গেলেন। গতবছর থেকে যা যাচ্ছে আমাদের উপর দিয়ে। গতবছরও পুজোটা খারাপ কেটেছিল। আমাদের ষষ্ঠীর দিন কোভিড ধরা পড়ল। শ্বশুরমশাই, জেঠ-শাশুড়ি, পিসে-শ্বশুরমশাই মারা গেছেন পরপর। আমাদের সামনের বাড়ি যে ছেলেটি আমাদের বেহালার পাড়ার পুজোর উদ্যোক্তা ছিল, সে কোভিডে মাত্র চুয়াল্লিশ বছর বয়সে মারা গেছে।
আর এ বছর তো আমাদের কিছু পুজোর জিনিস ধরতেও নেই, পুজো করতেও নেই। আমাদের পাড়ার দুর্গাপুজোয় আমার শাশুড়িমা সিংহভাগ কাজ করেন। এবার ওঁর মন খুব খারাপ তাই বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে রাশিয়া চলে গেছেন বেড়াতে। লক্ষ্মী পুজোর আগে ফিরবেন। পুজোতে আমি বাড়িতেই থাকব। আমার কাকাশ্বশুর অসুস্থ, বাড়িতে তো একজন কাউকে থাকতেই হবে। এবার কিছু কেনাকাটাও করিনি। প্রতিবার আমাদের বাড়ির লক্ষ্মী পুজো সবার সেরা আকর্ষণ হয় কিন্তু এবার হয়তো খুব ছোট করেই হবে। ঘরোয়া ভাবে নিজেদের মতো করে মা লক্ষ্মীর পুজো করব।প্রাক্তন সিনেমার মলির মতোই বাস্তবের অপরাজিতাও খুব আন্তরিক। এত বড় নায়িকা হয়েও নেই কোনও স্টারডমের অহংকার। আজও সবাইকে একসাথে নিয়ে বাঁচতে ভালবাসেন অপরাজিতা আঢ্য।