পতি-পত্নী অউর ও
শেষ আপডেট: 24 April 2025 21:12
ওয়াক্ত নে কিয়া ক্যায়া হাসিন সিতম, তুম রহে না তুম, হাম রহে না হাম...
ব্যর্থ প্রেমের সংজ্ঞা এ ছাড়া আর কী বা হতে পারে? পরিবারের অমতে বিয়ে, অথচ ভাগ্যের কী নিদারুণ পরিহাস! মৃত্যু ঘিরেছিল চুপিসারে। সম্পর্কের রসায়নও তলিয়ে যায় অন্ধকারে।
‘বিগেস্ট ওয়েডিং এভার’
গুরু দত্ত ও গীতা দত্ত--কোঙ্কনি পরিবারের ছেলে ছিলেন গুরু দত্ত। জন্মসূত্রে নাম বসন্ত কুমার শিবশঙ্কর পাদুকোন। অন্যদিকে গীতা ছিলেন বাঙালি কায়স্থ পরিবারের মেয়ে। গুরু দত্তের ছোট বোন, চিত্রশিল্পী ললিতা লাজ়মির কথায়, "গীতাদিদির তখন মোটে আঠেরো। প্রায় ন'শোটি গান গাওয়া হয়ে গিয়েছে তখনই। বিরাট তারকা। গলায় মধু যেন ঝরে পড়ছে। ডাগর চোখ, আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন লিমুজিন চেপে। এসেই ঢুকে পড়লেন রান্নাঘরে। বসে গেলেন তরকারি কাটতে।"
প্রেমটা যেন শুরু হয়েছিল ওভাবেই। বছর তিনেক পর বিয়ের কথা ভাবতেই গীতা (রায়)-এর পরিবারের মাথায় হাত! বাঙালি মেয়ে কিনা শেষে দক্ষিণীর গলায় মালা দেবে! নইব নইব চ! বাড়ি থেকে শুরু হয় সম্বন্ধ দেখা। ঠিকও হয় একজন। গীতাও নাকি নিমরাজি ছিলেন। ওদিকে গুরু দত্তের মনে তখন বিষাদের স্যাক্সোফোন। গীতার কাছে ছুট্টে যেতেই ফিরিয়ে দিতে পারলেন না তিনি। সালটা ছিল ১৯৫৩। ধুমধাম করে হল বিয়ে। লতা মঙ্গেশকর থেকে মহম্মদ রফি, বৈজয়ন্তীমালা-- কেছিলেন না সেখানে! বাঙালি বৌ সেজে বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন গীতা। তখন তিনি মোটে ২১। আর একজন ২৭-এর তরতাজা যুবক।"
চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়
প্রেমিক আর স্বামীর বড় ফারাক, প্রেয়সী আর স্ত্রীর মধ্যেও মিল আছে কি? গীতা ছিলেন সদ্য যৌবনা ঝর্ণা। অন্যদিকে গুরু দত্ত নিমজ্জিত থাকতেন নিজের মধ্যেই। বিয়ের কিছু দিন পরেই গুরু দত্ত নিজের হোম প্রোডাকশন ছাড়া স্ত্রীর অন্যত্র গাওয়া নিষিদ্ধ করলেন। ওদিকে গীতার অপর নামই তো 'চলমান চাকা'। সে চাকার পায়ে শিকল দিলে গতি তো স্তব্ধ হবেই! সুরকারের দাক্ষিণ্যে, লোকে বলে বিশ্বাসঘাতকতায়, ভ্যাম্পের বদলে হিরোইনের কণ্ঠের গান পেতে শুরু করলেন আশা। আর ‘সিনিয়র’ গীতার কপালে নর্তকীর গান।
পতি-পত্নী অউর ও
এমনই এক সময়ে সংসারে আচমকাই প্রবেশ দিঘল চোখের সেই নারীর, যার সৌন্দর্য সে সময় হার মানাত সদ্য ফোটা গোলাপ রাজিকেও-- ওয়াহিদা রহমান। সংবাদপত্রের পেজ-থ্রি দখল করে নিচ্ছে গুরু-ওয়াহিদার রগরগে প্রেমের গুঞ্জন। গীতার কানে আসছিল সবটাই। সংসারে সাপ হয়ে প্রবেশ করল স্বামী-স্ত্রীর অত্যাধিক মদ্যপান। গুরু চেয়েছিলেন ওয়াহিদার গলায় গান করুন গীতা। গীতা শুনেই গেলেন রেগে! গুরু দত্তের ছায়াসঙ্গী লেখক-পরিচালক আব্রার আলভি একবার এক ঘটনার কথা উল্লেখ করেন। ওয়াহিদার নাম দিয়ে ‘খুব দরকার, অমুক জায়গায় এলে ভাল হয়’ বলে এক চিঠি আসে গুরু দত্তের কাছে। গুরু জানান। আর যেতেই! হায় রে, বেরিয়ে এলেন খোদ গীতা। চিঠিটা যে তিনিই লিখেছিলেন স্বামীকে। সম্পর্ক আরও তিক্ত হয়।
কাগজের ফুল নাকি ভুল?
কাট টু 'কাগজ কি ফুল'। ছবিতে গুরু দত্তই ছিলেন নায়ক। ছবির প্লট-- স্ত্রীকে ভুলে নবাগতাকে মন দিয়েছেন অভিনেতা। আয়রনি-- সেই নবাগতার চরিত্রে আবার ওয়াহিদা। ইচ্ছে ছিল না, তবু জোরাজুরিতে ওই ছবিতে গীতা গাইলেন, 'ওয়ক্ত নে কিয়া কেয়া হসিন সিতম!' গুরু দত্ত কোথায় যেতেন কী করতেন, সব কিছুর হিসেব রাখতে শুরু করেন গীতা। মনের মধ্যে অজানা ভয়। অনেকেই বলে ওয়াহিদার সঙ্গে প্রেম ছিল না গুরুর। ছিল তাঁকে জানার ইচ্ছে। ললিতা আজমির কথায়, "গীতা একসময় সন্তানদের নিয়ে চলে যায়। দুই বার নিজেকে শেষ করার চেষ্টা করেছিলেন গুরু দত্ত। দ্বিতীয়বার মুম্বইয়ের নানাবতী হাসপাতালে ভর্তিও ছিলেন। কোমা থেকে যখন বের হলেন মুখ দিয়ে বের হয়েছিল একটাই শব্দ, 'গীতা'। ললিতার দাবি, গুরু-গীতার এই বৈবাহিক সম্পর্ক খারাপ হওয়ার নেপথ্যে ওয়াহিদা দায়ী ছিলেন না। দায়ী ছিল বিশ্বাস ভাঙা, দুই বিপরীত মেরুর মানুষের ভিন্ন দিকে অবস্থান।
শেষের সে দিন...
লোকে বলে, গুরু দত্ত আত্মহত্যা করেছিলেন। প্রমাণও তাই বলে। তবে ললিতা মনে করেন, আত্মহত্যা নয়! গুরু বুঝতেই পারেননি ওটি তাঁর শেষ মদের গ্লাস। তাঁর কথায়, "সেদিন সন্ধেবেলাতেও গীতার সঙ্গে কথা বলে গুরু দত্ত। সন্তানদের তাঁর কাছে পাঠাতে বলে। গীতা রাজি হয়নি। আব্রার গুরুকে বলেছিল, মদের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ না মেশাতে। শোনেনি। তাই করে। খালি পেটে ওই 'বিষ' খেয়ে নেয়। আর ওঠেনি।"
পরদিন সকালে পরিচারক দরজা ভেঙে উদ্ধার করে নিথর দেহ। ওয়াহিদা সে সময় দিলীপ কুমারের সঙ্গে শুটিংয়ে মাদ্রাস গিয়েছিলেন। শোনা মাত্রই দৌড়ে আসেন সেখানে। মেকআপ তোলার সময়ও পাননি। আর গীতা? গুরু দত্তকে নিয়ে যাওয়ার ঠিক দশ মিনিট আগে ঢোকেন তিনি। মেয়ে নীনা বারবার বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে যাচ্ছিল, 'পাপা ওঠ, ওঠ না'। নীনার তখন মাত্র দুই।
অশান্তি ছিল। ছিল অভিমান। কিন্তু ভালবাসার কাছে এ সবই পরাজিত হয়। গুরুর মৃত্যুর পর বিধবাবেশ ধারণ করেন গীতা। বেশিরভাগ সময়ই কাটত মদ্যপ অবস্থায়। কোকিল কণ্ঠীর গলাও যেন আর সঙ্গ দিচ্ছিল না তাঁর। ১৯৭২ সালের ২০ জুলাই। সুর নয়, সেদিন গলা দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল গীতার--সিরোসিস অব লিভারে মাত্র ৪১ বছর বয়সে গীতা দত্তও চলে যান নীরবেই। শেষ হয়, অভিমানের অধ্যায়।