গুলশন কুমার
শেষ আপডেট: 5 May 2025 15:26
দ্য ওয়াল ব্যুরো: সাফল্যের মতোই আকস্মিক ছিল তাঁর মৃত্যু। বলিউড সংগীত সাম্রাজ্যের রাজা গুলশন কুমার যেন নিজের জীবনের শেষ দৃশ্যে অভিনয় করছিলেন, কিন্তু এবার তা পর্দায় নয়, গোটাটাই ছিল বাস্তব। ১৯৯৭ সালের ১২ আগস্ট, মঙ্গলবার সকালটা ছিল অন্য দিনের মতোই। টি-সিরিজের প্রতিষ্ঠাতা ও সংগীতের সম্রাট, ৪২ বছর বয়সী গুলশন কুমার মুম্বইয়ের লোখান্ডওয়ালার বিলাসবহুল বাংলো থেকে প্রতিদিনের মতো পুজো করার জন্য বেরিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল তাঁর পুজোর থালা, হাতে একটি ফাইল। তবে সেই দিনটি ব্যতিক্রমী ছিল—এই প্রথম তিনি তাঁর নিরাপত্তারক্ষী ছাড়াই বেরিয়েছিলেন, কারণ সেই ব্যক্তি ছিলেন অসুস্থ।
শিবমন্দিরের পথে... কিন্তু গন্তব্য ছিল মৃত্যু
সকাল ১০টা ১০ মিনিটে মেরুন রঙের মারুতি এস্টিমে করে তিনি পৌঁছন লোখান্ডওয়ালার প্রাচীন শিবমন্দিরে, যা তিনি নিজেই কয়েক বছর আগে মার্বেল দিয়ে নতুন করে নির্মাণ করেছিলেন। প্রতিবেশী বস্তির মানুষজন তাঁকে রোজ সকালে ও সন্ধ্যাবেলা মন্দিরে আসতে দেখতেন। কিন্তু সেই দিন, গুলশন কুমারের প্রতিদিনের এই ধর্মাচরণ ছিল এক চূড়ান্ত ফাঁদ। তিন যুবক—যারা আগেই তাঁকে অনুসরণ করে তাঁর রুটিন বুঝে নিয়েছিলেন— মন্দিরেই অপেক্ষা করছিলেন। তাদের মধ্যে একজনের লম্বা চুল ও নীল জিন্স তাকে আলাদা করে চিহ্নিত করলেও, বাকিরা বস্তির সাধারণ মানুষের মতোই মিশে গিয়েছিল ভিড়ে।
“বহুত পূজা করলি, এখন ওপরে গিয়ে কর।”
সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে পূজা শেষে যখন তিনি মন্দিরের সিঁড়ি দিয়ে নেমে গাড়ির দিকে ফিরছিলেন, তখনই ঘটে সেই ভয়াবহ ঘটনা। হঠাৎ এক যুবক পিস্তল দেখায় তাঁকে। চমকে উঠলেও গুলশন কুমার প্রশ্ন করলেন, “ইয়ে কেয়া কর রাহে হো?” উত্তর এল নির্মম এক বাক্যে— “বহুত পূজা করলি, এখন ওপরে গিয়ে কর।” এই কথাটিই ছিল তাঁর জীবনের শেষ শোনা শব্দ। তারপরই চলল গুলি। প্রথম গুলি কপাল ছুঁয়ে বেরিয়ে গেলেও তিনি পড়ে যান। উঠে পালাতে চাইলেও বাকি দুই আততায়ী .৩৮ রিভলভার দিয়ে তাঁর ঘাড় ও পিঠে একে একে ১৬টি গুলি চালায়।
গুলশন কুমার প্রাণ বাঁচাতে ছুটলেন পাশের বস্তির দিকে, কিন্তু ভাগ্য তাঁর সহায় ছিল না। প্রথম দু’টি ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যায় তাঁর মুখের সামনে। অবশেষে একটি কমন বাথরুমের কাছে গিয়ে পড়ে যান, যেখানে একটি দেবী মায়ের প্রতিমা আঁকা ছিল টাইলসে। দেবীর পায়ের কাছেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মানুষটি—ঠিক যেন কোনও ট্র্যাজিক সিনেমার দৃশ্য। সময় তখন সকাল ১০টা বেজে ৪২ মিনিট।
পালানোর দৃশ্যও যেন সিনেমার মতো
তিন আততায়ী নিশ্চিত হলেন যে তাঁদের লক্ষ্য সফল হয়েছে, তারপর পাশের একটি ট্যাক্সি থেকে চালককে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যায়। পুলিশের মতে, এরা ছিল নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত খুনি—গাড়ি না রাখার কৌশলও ছিল পরিকল্পিত।
হুমকির ফোন, প্রত্যাখ্যান, এবং বিপদ
গুলশন কুমার আগে থেকেই জানতেন, তিনি আন্ডারওয়ার্ল্ডের হিট-লিস্টে রয়েছেন। দাউদ ইব্রাহিমের ঘনিষ্ঠ আবু সালেম ১০ কোটি টাকার প্রোটেকশন মানি চেয়েছিল। প্রথম কিস্তি দেওয়ার পর, দ্বিতীয় কিস্তি চাওয়া হলে তিনি তা অস্বীকার করেন এবং বলেন, "আমি আমার ধর্ম পালন করছি, তোমরা তোমার কাজ করো।" এটাই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় ভুল।
পুলিশ জানায়, তিনি মুম্বই পুলিশের কাছে কখনওই সুরক্ষা চাননি, বরং উত্তরপ্রদেশ পুলিশেই সন্তুষ্ট ছিলেন। তাঁর ভাই ও সহকর্মীরা অবশ্য দাবি করেন, কোনও টাকা দেওয়া হয়নি। তবে হুমকির ফোন যে এসেছিল, তা সবাই স্বীকার করেন।
সংগীতজগতের নায়ক, কিন্তু ব্যক্তিত্বে বিতর্কিত
গুলশন কুমার ছিলেন এক অদম্য উদ্যোক্তা, যিনি হিন্দি সংগীত জগতে এনেছিলেন এক নতুন ধারা। ছিলেন ব্যবসায়ী—প্রয়োজনে উপহার দিতেন, আবার দরকার ফুরোলেই ছেঁটে ফেলতেন কর্মীদের। তাঁর সাবেক কর্মীদের অনেকেই বলেন, ‘ওর মধ্যে নৈতিকতা ছিল না।’
শেষ কথা
সংগীত এবং মাফিয়া—এই দুই জগতের অদ্ভুত ছেদবিন্দুতে দাঁড়িয়ে ছিলেন গুলশন কুমার। তাঁর উত্থান যেমন সিনেমার মতো, তেমনই মৃত্যুও যেন সিনেমার শেষ দৃশ্য। তবে বাস্তবের এই ট্র্যাজেডি বলিউডকে কাঁপিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।