শেষ আপডেট: 19th September 2023 13:37
'বন্দ দেব গজানন বিঘ্ন বিনাশন।
নমঃ প্রভু মহাকায় মহেশ নন্দন।।
সর্ববিঘ্ন নাশ হয় তোমার শরণে।
অগ্রেতে তোমার পূজা করিনু যতনে।।' (Uttam Kumar Ganesh Puja)
বাঙালিরা নাকি হালফিলে নকল করেছে মহারাষ্ট্রের গণেশ চতুর্থী উৎসবকে (Ganesh Chaturthi), এমন কথা হামেশাই শোনা যায়। আসলে গণেশ পুজো বলতে বাঙালির কাছে ছিল পয়লা বৈশাখের হালখাতার উৎসব। মাঘ মাসে গণেশ পুজোর তিথি বাংলা ক্যালেন্ডারে চিরকাল থাকলেও সে পুজো কোনকালেই কোথাও সাড়ম্বরে তো দূর, অনাড়ম্বরেও পালিত হতে দেখা যায়নি। যদিও মহারাষ্ট্রে বরাবরই গণেশ চতুর্থী বাঙালির দুর্গোৎসবের মতোই বড় করে পালন করা হয়। সেই পুজোই হাল আমলে কলকাতা ছাপিয়ে পৌঁছে গেছে গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে। তবে অনেকেই জানেন না, বাংলা তথা কলকাতায় গণেশ চতুর্থীতে প্রথম সাড়ম্বরে পুজো করার প্রথা চালু করেন যিনি, তিনি মহানায়ক উত্তমকুমার। বাঙালির গণেশ চতুর্থীর প্রথম রূপকার তিনিই।
উত্তমকুমার ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন গণেশের বড় ভক্ত। তাঁর এবং সুপ্রিয়াদেবীর সেই গণেশ নিত্যপুজো পেত বাড়িতে। শুধু তাই নয়, দিন শুরু হওয়ার আগে স্নান করে শুচিবস্ত্র পরে প্রতিদিন গণেশ পুজো করতেন মহানায়ক। রোজ ফুল-মালা-লাড্ডুর বন্দোবস্ত থাকত তাঁর গণপতির জন্য। মহানায়ক উত্তমকুমার নাকি খিদিরপুরের গার্ডেনরিচ এলাকার সতীশ ময়রার মিষ্টি খেতে বড়ই ভালবাসতেন। তাই তাঁর গণেশ পুজোতে সতীশ ময়রার দোকান থেকেই লাড্ডু যেত।
স্বহস্তে গণেশের গণেশের নিত্যপুজো করতেন মহানায়ক (mahanayak)। পুরোহিত দিয়ে নয়, সকল ব্যস্ততার মাঝেও রোজ নিজেই বসতেন পুজোয়। পুজো সেরে উত্তমকুমার চলে যেতেন ভবানীপুরের বাড়িতে মা চপলা দেবীকে প্রণাম করতে। তারপর যেতেন শ্যুটিংয়ে। এই ছিল উত্তমকুমারের প্রতিদিন সকালের রুটিন।
গণেশ চতুর্থীর দিন প্রতিষ্ঠিত গণেশকে সমারোহে পুজো করতেন উত্তমকুমার। তবে উত্তম যে গণেশ মূর্তির পুজো করতেন, তাঁর সাজ ছিল পুরোদস্তুর বাঙালিয়ানায় ভরপুর, যাঁর গায়ে সাদা পৈতে, সাদা ধুতি। শোনা যায়, গণপতি বাপ্পার এই সাজ স্বপ্নে দেখেছিলেন মহানায়ক। তাই কোনওভাবেই বম্বের নকল করে মাড়োয়ারি সাজের গণপতি মূর্তি ঘরে আনেননি তিনি।
তাঁর গণেশ চতুর্থীর পুজো ছিল একেবারেই অনন্য। আর সেখানেই উত্তম একেবারে স্বতন্ত্র। নিজের বাঙালি শিকড়, রীতিনীতি তিনি ভুলে যাননি।
গণেশ পুজোর ভোগের আয়োজন ও বহু পদে রান্নার দায়িত্ব সামলাতেন সুপ্রিয়া দেবী (Supriya Devi)। এদেশিদের সমস্ত নিরামিষ রান্না ভোগে দিতেন উত্তমকুমার। ইন্ডাস্ট্রির প্রচুর লোক ও বন্ধুবান্ধবরা আসতেন তাঁর এই পুজোতে। পুজো শেষ হবার পর বসত ঘরোয়া গানের জলসা। বড় বড় শিল্পীরা কতজন গান গেয়েছেন সেই আসরে। বলাবাহুল্য, সেই আসরে মধ্যমণি ছিলেন উত্তমকুমারই। তিনি নিজেও হারমোনিয়াম টেনে একের পর এক রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে বসে যেতেন। ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত বাঙালিবাবু মহানায়কই হতেন সেদিনের সেরা আকর্ষণ।
উত্তমকুমারের নিজের ভাইঝি, তরুণ কুমারের মেয়ে ঝিমলি বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, 'জ্যাঠা (উত্তমকুমার) ময়রা স্ট্রিটে গণেশ চতুর্থীর দিন বড় করেই গণেশ পুজো করতেন। আর সব পুজোর আগেই তো গণেশ পুজো করতে হয়। তবে মা-বাবা গেলেও আমি কখনও জ্যাঠার গণেশ পুজোতে যাইনি। আমরা তখন ছোট। তাই বাড়ির বাইরে সব অনুষ্ঠানে আমাদের পাঠানোর খুব একটা চল ছিল না। যদিও আমরা না গেলেও জ্যাঠা সমস্ত ভোগ প্রসাদ আমাদের বাড়ির সবার জন্য পাঠিয়ে দিতেন।
তবে জ্যাঠার এই গণেশ মূর্তি আমি দেখেছি অনেকবার। কারণ অন্য সময় কয়েকবার জ্যাঠা আর সুপ্রিয়াদেবীর ময়রা স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে আমি গেছি, মূলত বাবার সঙ্গেই। তখন দেখেছি জ্যাঠা গণেশ মূর্তির নিত্যপুজো করতেন। এই পুজো করার ভক্তি জ্যাঠার মধ্যে চিরকাল ছিল। উত্তমকুমার (Uttam Kumar) আর সুপ্রিয়াদেবী পরে লক্ষ্মীপুজোও শুরু করেন ওখানে। তবে জ্যাঠা আগে নিজের বাড়ির লক্ষ্মীপুজো সেরে তারপর ওখানে যেতেন। জ্যাঠা মারা যাওয়ার পর সুপ্রিয়াদেবী একা আর কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো বড় করে করতেন না।
কিন্তু জ্যাঠার গণেশ মূর্তিকে সুপ্রিয়াদেবী চিরকাল নিত্য পুজো করেছেন। ময়রা স্ট্রিটের বাড়ি ছেড়ে দেবার পর অনেকবার বাড়ি বদল করেন সুপ্রিয়াদেবী। মারুতি বিল্ডিং থেকে কতবার বাড়ি পাল্টে শেষমেশ বালিগঞ্জের সরকারি আবাসন। সব জায়গাতেই ওই গণেশ মূর্তিকে নিত্য পুজো করতেন উনি। সেভাবে আর বড় করে করতে না পারলেও সুপ্রিয়াদেবী নিত্য পুজো দিতে কখনও ভোলেননি। জ্যাঠার ইষ্টদেবতাকে সেই সম্মান, শ্রদ্ধা চিরকাল দিয়েছিলেন সুপ্রিয়া দেবী।'
উত্তমকুমার আজ নেই, নেই সুপ্রিয়া দেবী (Supriya Devi), নেই তাঁদের সেই ময়রা স্ট্রিটের বাড়ি। কিন্তু আকাশে-বাতাসে রয়ে গেছে উত্তমকুমারের গণেশ আরাধনার স্মৃতিকথা। কালের স্রোতে সব ঘটনাই মুছে যায়, কমে যায় স্মৃতি টিকিয়ে রাখার মানুষ। তবু বাঙালির গণেশ চতুর্থীর প্রথম সূচনা করেন উত্তমকুমারই।
নীরবে প্রয়াত সত্যজিতের শিল্পমন্ত্রী, তরুণ মজুমদারের শিষ্য অভিনেতাকে মনে রাখেনি প্রায় কেউই