Latest News

হোয়েন আই স ইউ: যন্ত্রণার শিল্প যখন সিনেমা

হিন্দোল ভট্টাচার্য

দেওয়ালে যখন পিঠ ঠেকে যায়, যন্ত্রণা যখন জীবনের প্রতিদিনের রক্তমাখা বিষয় হয়ে ওঠে, তখন সম্ভবত জীবনের অন্ধকার আকাশ নক্ষত্রহীন আর শিল্পের আকাশে সূর্যোদয় হয়। অন্তত এই সময়ের কবিতা এবং চলচ্চিত্রের আকাশে প্যালেস্তাইনের এক একটি সৃজনশীলতা দেখলে তেমনটাই মনে হয়। তাঁদের যুদ্ধবিধ্বস্ত জীবনে, অপমানে জর্জরিত প্রতিটি মুহূর্ত গভীর জীবনদর্শনের ইঙ্গিতবহ হয়ে থাকে। অবশ্যই এই ইঙ্গিত কারো কারো কাছে ধরা পড়ে, সকলের কাছে সমানভাবে স্পর্শযোগ্য হয় না। কিন্তু যদি আমরা আলোচনা করি আপাতত প্যালেস্তাইনের চলচ্চিত্র নিয়ে তাহলে আমাদের ভাবতেই হবে, কী গভীর অন্তদৃষ্টি নিয়ে তিনি তাঁর এই ছবিগুলিকে নির্মাণ করে চলেছেন। অ্যানমেরি জাকির এমন একজন পরিচালক, যাঁর চলচ্চিত্র মানেই, এক অন্য প্রেক্ষিত থেকে দেখা।
ইজরায়েল তখন ছিনিয়ে নিয়েছে প্যালেস্তাইনের অনেক জায়গাই। যুদ্ধ করছেন প্যালেস্তাইনের বিপ্লবীরা। সেই যুদ্ধে বহুদিন ধরেই একটি কিশোর ছেলের বাবা নিরুদ্দিষ্ট। ধরেই নেওয়া যায় ছেলেটি মারা যাবে। কিন্তু ছেলেটি তার বাবার কাছে ফিরতে চায়। ছেলেটির তার এই বাবার কাছে ফিরে যাওয়াটা একপ্রকার প্যালেস্তাইনের সব হারানো মানুষজনের তাদের শিকড়ের কাছে ফিরে যাওয়ার মতোই। কিন্তু কীভাবে যাবে সে? জর্ডনের এক ক্যাম্পে সে থাকে তার মায়ের সঙ্গে। আর স্বপ্ন দেখে, একদিন না একদিন সে তার বাবার কাছে ফিরে যাবেই। প্রতিদিন ক্যাম্পে আসে লোকবোঝাই লরি। ছেলেটি খোঁজে তার বাবাকে। কিন্তু বাবা আর আসে না। ছেলেটি একদিন মাকে প্রশ্ন করে তার বাবা কোথায়। কীভাবে সেখানে যাওয়া যাবে? তার মা তাকে বলে খুব রোদে একটা লাঠি মাটিতে লম্বা করে বসালে যে দিকে ছায়া সেদিকে তার বাবা আছেন। একদিন সকালে সকলে যখন ঘুমোচ্ছে, তখন ছেলেটি সেই ছায়া দেখে সেই ছায়া ধরে হাঁটতে শুরু করে এবং রাতে তাকে অচৈতন্য অবস্থায় উদ্ধার করে ফিদায়েঁদের দল। এরা বিপ্লবী। এরাও যুদ্ধ করে প্যালেস্তাইনের মূল অংশ ফিরে পাওয়ার আশায়।ছেলেটি মিশে যায় এই সব বিপ্লবীদের সঙ্গে। ট্রেনিং করে। জীবনটাই পালটে যায় তার। আর তাকে খুঁজতে খুঁজতে হাজির হয় তার মা। তিনিও ক্যাম্পে ছেলের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। বিপ্লবীদের মতো পোশাক করে থাকেন। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন ক্যাম্পে ফিরে যাবেন ছেলেকে নিয়ে। কিন্তু ক্যাম্পের থেকে এই জঙ্গলের জীবন ভালো লাগে তাঁরও। কিন্তু ছেলেটির মন বসে না। ছেলেটিকে তো ফিদায়েঁ হতে হবে। ছেলেটিকে যেতে হবে তার বাবার কাছে। একদিন সকালে সে ক্যাম্প ছেড়ে চলে যায়। সীমান্তের কাছে লুকিয়ে থাকে। তাকে খুঁজতে খুঁজতে এক বিপ্লবী এবং ছেলেটির মা আসে সেই সীমান্তের কাছে। দেখে দূর থেকে ছেলেটি বসে আছে সীমান্তের কাছে।ছেলেটি সীমান্ত পেরোনোর কথা ভাবছিল, এমন সময় তার চোখ পড়ে যায় দূরে অপেক্ষারত তার মা এবং সেই বিপ্লবীর দিকে। বিপ্লবীটি তাকে ইশারা করে ফিরে আসতে। কিন্তু তা দেখে জেদে অবিচল ছেলেটি আগুপিছু কিছু না ভেবেই দৌড়তে শুরু করে সীমান্তের দিকে। আর তা দেখে ছেলেটির মাও ছুটতে শুরু করে। সীমান্তের দিকে যেদিকে গোধূলি, সেদিকে ছেলেটির মা দৌড়তে দৌড়তে ছেলেটির হাত ধরে। কিন্তু ফিরে আসে না। দৌড়তে থাকে সীমান্তের দিকে। এখানেই দৃশ্যটি স্থির হয়ে যায়। ছবিটি শেষও হয়ে যায় আমাদের সামনে এক গভীর ইঙ্গিত রেখে যে, এই লড়াই, এই দৌড়, এই আত্মত্যাগ এবং শিকড়ের জন্য এই আকুতি শেষ হয়নি।শুধু গল্পটিই তো এখানে বিষয়বস্তু নয়, আর কবিতার মতো সিনেমাও বর্ণনা করে বা ব্যাখ্যা করে বোঝানো সম্ভব নয়। সিনেমাটি না দেখলে কারও পক্ষে সিনেমাটি সম্পর্কে অনুভব করাই অসম্ভব। কিন্তু আসল কথা হল, ছবিটির পরতে পরতে ভালোবাসা, যন্ত্রণা, অপমান, শূন্যতা এবং অনিশ্চয়তা। অনিশ্চয়তাকে যে কী অসাধারণ ভাবে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব দুশ্চিন্তার মধ্যে, তা যেন শেখালেন এই ছবিতে রুবা বিয়াল, শেখালেন ছেলেটির মায়ের চরিত্রে। আর ছেলেটি (তারেক)-র চরিত্রে যে অভিনয় করেছে, সেই মাহমুদ আসফার তো তুলনাই নেই।পরিচালনার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, এই ছবিটি বড় মমতা দিয়ে করা। বিপ্লব, লড়াই, যুদ্ধ সব কিছুর প্রসঙ্গ আছে, কিন্তু সবই যেন খুব বিষণ্ণ। যেন, এ সব না হলে, যদি মানুষে মানুষে এই যুদ্ধ না হত, এত দেওয়াল তৈরি না হত, যদি মানুষে মানুষে ভালোবাসা অনেক বিস্তৃত হত, শ্রদ্ধাবোধ থাকত, সম্মানবোধ থাকত, তাহলে যে পৃথিবীটা তৈরি হত, সেদিকে নির্ভার হয়ে চলে যাওয়া যেত। কিন্তু অবধারিতভাবেই এরা সকলেই যন্ত্রণার দিকে চলেছে, যেখানে শুধুই বুলেটের দাগ। বর্তমান গাজায় থাকেন, এমন একজন আরবি কবির কলমে একটি কবিতাই মনে পড়ে এখানে। থমথম করছে যখন আকাশ, বাতাস। পুরো কবিতাটি তুলে দেওয়া মনে হয় যুক্তিসঙ্গত হবে-
মাথার উপর সকাল ভেঙে পড়ল
আকাশটাকে ভেঙে ভেঙে টুকরো করে রাখা ছিল
ছোটো ছোটো শিশুদের পা
দ্রুত ঘুরে গেল আকাশের দিকে
পাশাপাশি সময় নিজেকে গুছিয়ে
তাদের চোখের পাতা বন্ধ করে দিল
একটি শিশুর মতো, যার প্রতিটি শব্দ
চোখের পাতার নীচে ধূসর হয়ে আছে
মাথার উপরের ছাদ দুমরে মুচরে
পাথর পড়ছে যেন ঝরনা
আর এই ঝরা আকাশের নীচে
একটি ছবি ফ্রেমশুদ্ধ ঝুলছে শূন্য থেকে
সেই ফ্রেমের মধ্যে আমাদের মুখের
এক একটি বোবা ভাস্কর্য আঁকা
আমরা একা একাই বুড়ো হচ্ছি আজ রাতে
সময়কে সেলাই করে পরে আছি শরীরে
গিলে নিচ্ছি সন্ত্রাস, যা আমাদের ছোটো ছোটো
শিশুদের গলা বেয়ে নামছে ধীরে ধীরে
এই মরচে পড়া ঠোঁটগুলিকে
কে মেরামত করবে, তুমি জানো?  ( ভোর, রাওয়াল হুসেন)

ছবিটির নাম হোয়েন আই স ইউ (When I Saw You)। নামটিও প্রতীকী। (যদিও আরবি ভাষার প্রকৃত নাম সম্পর্কে কিছু বলতে আমি অক্ষম)

 

হিন্দোল ভট্টাচার্য কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক। ‘জগৎগৌরী কাব্য’-এর জন্য পেয়েছেন বীরেন্দ্র পুরস্কার (২০০৯) এবং ‘যে গান রাতের’ কাব্যগ্রন্থের জন্য পেয়েছেন বাংলা অকাদেমী পুরস্কার (২০১৮)

You might also like