শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
হবুচন্দ্র রাজা গবুচন্দ্র মন্ত্রী'
পরিচালনা - অনিকেত চটোপাধ্যায়
শ্রেষ্ঠাংশে - শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, খরাজ মুখোপাধ্যায়, অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়, শুভাশীষ মুখোপাধ্যায়
সংগীত - কবীর সুমন
প্রযোজনা- দেব এন্টারটেনমেন্ট ভেঞ্চার
'সে এক ভারী আজব দেশ, রাজা মন্ত্রী আছেন বেশ'... রাজ্যের নাম বোম্বাগড়। সে রাজ্যের রাজা হবুচন্দ্র আর রানি কুসুমকুমারী।
হবুচন্দ্রের নতুন মন্ত্রী গবুচন্দ্র। হবুচন্দ্র-গবুচন্দ্র দুজনে মিলে বোম্বাগড়ের রাজ্যপাট ঢেলে সাজাচ্ছেন। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের রূপকথার গল্প অবলম্বনে তৈরি এই ছবি 'হবুচন্দ্র রাজা গবুচন্দ্র মন্ত্রী'।
দেব-এর প্রযোজনায় অনিকেত চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনার এই ছবিতে রাজনৈতিক গল্প নতুন মাত্রা পেল রূপকথার মোড়কে। এ ছবি যেমন ছোটদের ভাল লাগবে, তেমন বড়দেরও মন ভরাবে। হ্যাঁ 'হবুচন্দ্র রাজা গবুচন্দ্র মন্ত্রী' শুধু রূপকথার ছবি নয়, এ ছবি রাজনৈতিক ছবি। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার চোখে আঙুল দিতেই এই ছবি বানানো হয়েছে তা কিন্তু নয়। ছবিটা দেখলেই বোঝা যায় যুগে যুগে এই ছবি প্রাসঙ্গিক। আজ থেকে কুড়ি বছর পরও এই ছবির রাজনৈতিক বার্তা প্রাসঙ্গিক থাকবে। তখনও বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে এই ছবিটিকে সার্থক স্যাটায়ার ছবি মনে হবে। 'হবুচন্দ্র রাজা গবুচন্দ্র মন্ত্রী'র সার্থকতা এখানেই।
আবার রাজনৈতিক ছবি বলেই যে ছবিটা কঠিন আবদ্ধে ঘুরপাক খেয়েছে তা একেবারেই নয়। অনিকেত চট্টোপাধ্যায়ের 'হবুচন্দ্র রাজা গবুচন্দ্র মন্ত্রী' দেখতে দেখতে খুব মনে পড়বে সত্যজিৎ রায়ের 'হীরক রাজার দেশ'-এর কথা। কিংবদন্তি পরিচালকের সঙ্গে কোনও তুলনা টানছিনা, কিন্তু 'হীরক রাজার দেশ'-এর চার দশক পর এমন একটি রাজনৈতিক স্যাটায়ার বাংলা ছবি নির্মাণ হল। যেটা সবার দেখার ছবি, সবার ঝোঝার মতো ছবি, সব বয়সের ছবি, সব শ্রেণির জন্য ছবি। সত্যজিৎ যুগের পর অনীক দত্ত বাদে এমনভাবে বাংলা ছবি আর কেউ বানায়নি, যা বানালেন অনিকেত চট্টোপাধ্যায়।
বোম্বাগড়ের রাজা হবুচন্দ্র আবিষ্কার করেন তাঁর প্রদেশে আসা নতুন মানুষ গবুচন্দ্রকে। তিনি আদেশ দেন এই নতুন লোকটিকে তাঁর রাজসভায় ধরে নিয়ে আসার জন্য। যেমন আদেশ তেমন কাজ। এসে উপস্থিত হন গবুচন্দ্র। গবুচন্দ্র এসেই বুদ্ধিতে বাজিমাৎ করে রাজা-রানির মন জয় করে ফেলেন। রাজ্যপাট, ধন-সম্পত্তি, হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া আরও আরও শ্রীবৃদ্ধি করার পরামর্শ দেয় গবুচন্দ্র।

গবুকে পরীক্ষা করেন রাজা, আর সব পরীক্ষায় অভাবনীয় সাফল্য লাভ করেন গবু। রাজার মন্ত্রীত্ব পুরস্কার হিসেবে পায় গবুচন্দ্র। রাজা বরখাস্ত করে দেন পিতৃসম বৃদ্ধ এতদিনের মন্ত্রীকে। গবুই হয়ে ওঠেন যেন রাজার চালক। রাজা 'হবু' নামেই, রাজা আদতে রাজমন্ত্রী গবু। কিন্তু টুকে পাশ করা ছাত্র আর মেধাবী ছাত্রের পাশ করায় তো তফাত থাকেই। ছবির পরতে-পরতে নড়তে থাকে ধর্মের কল।
মোহ, লোভ, পাপের ফল যে শেষমেষ শাস্তি আর লজ্জা তাই যেন এই ছবি দেখায়।
সততার জয় দিনের শেষে ঠিকই হয় তা প্রমাণ করে এই গল্প।

গবুচন্দ্র ছবির সহ-অভিনেতা না ভিলেন তারজন্য ছবিটা তো দেখতেই হবে। আরও দেখতে হবে বলিষ্ঠ অভিনেতাদের অভিনয়ের সাক্ষী থাকতে। নায়ক 'দেব' বা রাজনৈতিক মুখ 'দেব' সবার প্রিয়। কিন্তু প্রযোজক দেব 'হবুচন্দ্র রাজা গবুচন্দ্র মন্ত্রী' ছবিতে যে কাস্টিং রেখেছেন তা আরও একবার প্রমাণ করল দেবের শুভবুদ্ধি। হবুচন্দ্র রাজার ভূমিকায় শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় চরিত্রের মান রেখেছেন। একদম পারফেক্ট। যে কিনা সোজাসরল রাজা, দয়ালু রাজা অথচ কিছুটা লোভীও। সেই লোভের ফলও তিনি পান। আসলে সঠিক বন্ধু, পরামর্শদাতা আমাদের জীবনে খুব জরুরি। দিনের শেষে রাজা হবুচন্দ্র সেটা বোঝেন। শাশ্বত ভিন্নধর্মী অভিনেতা হিসেবে এ যুগের বাংলা ছবিতে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা, অন্যদিকে এ কালের সুপারস্টার নায়ক দেব এ ছবির প্রযোজক। দেব নিজের স্টারডম খাটিয়ে নিজেই হবুচন্দ্রের চরিত্রটি করতে পারতেন, কিন্তু সুচারুভাবে চরিত্রটি তুলে দিয়েছেন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের হাতে।

অন্যদিকে খরাজ মুখোপাধ্যায়ের বহুদিনের আফশোশ ছিল তাঁর অনেক চরিত্র জনপ্রিয় হলেও ছবির পোস্টারে তিনি কখনও জায়গা পাননা। যদিও খরাজকে তাঁর গুরু রবি ঘোষ শিখিয়েছিলেন
"তুই তোর ধর্মটা পালন করে যা, ফল পাবি"। গবুচন্দ্র রূপে ছবির পোস্টার জুড়ে খরাজ এ ছবিতে। ছবির শেষ দৃশ্যে খরাজের অভিনয় ভোলার নয়। সারা ছবি জমিয়ে রেখেছেন খরাজ।
পুরোনো বৃদ্ধ মন্ত্রীর ভূমিকায় শুভাশীষ মুখোপাধ্যায়। যার জন্য ভাল চরিত্র খুব কম লেখা হয়েছে বাংলা ছবিতে। এই বৃদ্ধ বিবেচক মন্ত্রীর শান্ত অভিনয়ে মাত করলেন শুভাশীষ। যখন অতীতের মন্ত্রীকে রাজা তাড়িয়ে দিচ্ছেন তখন শুভাশীষ ছলছল চোখে একবার পেছন ফিরে দেখছেন রাজপ্রাসাদটাকে। যে দৃশ্যে শুভাশীষের অভিনয় তুলনাতীত।

অর্পিতা চট্টোপাধ্যায় যেমন সুদর্শনা তেমনই মোহময়ী রানি কুসুমকুমারীর ভূমিকায়। শাশ্বত-অর্পিতার জুটি মন ভরিয়েছে দর্শকের।

তবে এ ছবির আসল জুটি শাশ্বত-খরাজ। যদিও তাঁরা দুই মেরুর, দুই উদ্দেশ্যে এক হয়েছেন।
ত্রিকালদর্শী গুরুদেবের ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেছেন বরুণ চন্দ। যিনি এই ছবির আসল চাবিকাঠি। তবে সেই 'সীমাবদ্ধ' থেকে শোনা বরুণ চন্দের নিজের কণ্ঠ দর্শক মিস করল এ ছবিতে।

অনিকেত চট্টোপাধ্যায়ের এই রাজনৈতিক স্যাটায়ার ছবি তাঁর নির্মিত সেরা ছবির তালিকায় থাকবে। কিছু সূক্ষ্ম দুর্বল দিক পরিচালনায় থাকলেও ছবিটি রয়ে যাবে।
দেবের প্রযোজনায় এই ছবির সংগীত পরিচালক রূপে কাজ করলেন কবীর সুমন। রয়েছে তাঁর নিজ কণ্ঠে গানও, যা বড় পাওনা। তবে ছবির চিত্রনাট্য-সংলাপ যতটা জোরালো, ততটা জোরালো নয় ছবির মিউজিক। কবীর সুমনের মিউজিকে যেন জরা স্পর্শ করেছে। ছবির গানগুলো শুনলেই বোঝা যায় কতটা গভীর গবেষণা, তবু ছবিতে গানের প্রয়োগ সেভাবে মন ছোঁয়না। গান সুপারহিট হলে ছবিটার সাফল্য আরো অনেক বেশি হত। 'সেদিন চৈত্র মাস'-এর সুমনকে পেলামনা।
তবে স্বর্গীয় গায়ক প্রতীক চৌধুরীর শেষ প্লেব্যাক কাজ হিসাবে রয়ে যাবে এই ছবি। বোম্বাগড়ের জাতীয় সঙ্গীত বেশ গেয়েছেন স্বর্ণদীপ মিত্র। রাঘব চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠে মানিয়েছে 'বোম্বাগড়ের ঝড়' গানটি।
আর ট্রেলারে তো মন ভরিয়েছিল স্বর্গীয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠ। ছবির শুরুতে স্বর্গীয় শিল্পীদের শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাতে দেব ভোলেননি।

প্রতিটি চরিত্রের পোশাক-পরিকল্পনা অনবদ্য, যেন রূপকথার রাজ্য থেকে উঠে এসেছে।
সবচেয়ে বড় কথা স্টার না নিয়েও শুধু ভালো চরিত্রাভিনেতাদের নিয়েও যে ভালো ছবি হয়, তা করে দেখালেন অনিকেত ও দেব। আমাদের টলিউডেও বলিষ্ঠ অভিনেতা আছেন, কিন্তু পেশার তাগিদে তাঁদের অকিঞ্চিৎকর চরিত্র করতে হয়। এ ছবি যদি টেলিভিশনে মুক্তি না পেয়ে সিনেমাহলে মুক্তি পেত তাহলেও প্রেক্ষাগৃহ ভরাত। বিশেষকরে ছোটোরা সিনেমাহলে পছন্দের ছবি পেত। বক্সঅফিসেও হিট করার মতো ছবি। কারণ ছবিটির গল্পের বুনোট অনবদ্য।
তবে বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে ছোটদের জন্য টেলিভিশন প্রিমিয়ার বড় সিদ্ধান্ত। আট থেকে আশির মন ভরাবে 'হবুচন্দ্র রাজা গবুচন্দ্র মন্ত্রী'।
সুস্থ রুচির বাংলা ছবির স্বার্থে, বাংলা চলচ্চিত্রে বাঙালিয়ানা ধরে রাখতে দেবের শুভ প্রচেষ্টা এভাবে বাংলা ছবিকে বিশ্বের দরবারে এগিয়ে দিক।
পুজোয় মন ভরানো ছবি 'হবুচন্দ্র রাজা গবুচন্দ্র মন্ত্রী'। সহজ কথায় অনেক বড় কথা বলা যায় এই ছবি তেমন ছবি।