Latest News

কিডনি বেচার গল্প নিয়ে ‘সাহেব’ বানাতে চাননি বিজয় বসু, অথচ সেই ছবি হিট করে হিন্দি রিমেকও হল

শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

‘একটা কাপ একটা শিল্ড মেডেল একটা ও ছাড়ব না,
এই জীবনের কোন খেলায় কোনোদিনও আমি হারব না।’

সত্যি, সাহেব কোনও দিনও হারেনি। সে ফুটবল খেলা হোক বা জীবনের খেলায়। বিজয় বসুর ছবি ‘সাহেব’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮১ সালে। ২০২১ সালে ‘সাহেব’ চল্লিশটি বসন্ত পেরিয়ে গেল। ‘সাহেব’ ছবির নামভূমিকায় তাপস পাল। এই চরিত্র তাপস পালকে ‘ফিল্মফেয়ার’ জয়ী করে। সেই তাপস সাহেব আর আমাদের মধ্যে আর নেই। তিনি ভুল পদক্ষেপে তলিয়ে গেলেও আজও তাপস পাল মানেই বাঙালিদের কাছে সাহেব। নিখাদ বাঙালিয়ানার ছবি ‘সাহেব’, তাই আজও বারবার আমাদের দেখতে ভাল লাগে। চলচ্চিত্রে এমন ম্যাজিক তৈরি করতেন বিজয় বসু, অথচ এই পরিচালককে আজ আর কেউ মনে রাখেনি। নেই তাঁর কোনও ছবি।

তবে ‘সাহেব’ ছবির শুরু থেকে যিনি, যাঁর উদ্যোগে বলতে গেলে ‘সাহেব’ ছবি তৈরি হয়, তিনি সাহেবের মাতৃসমা বড়বৌদি মাধবী মুখোপাধ্যায়।

‘সাহেব’ ছবির ৪০ বছরের জন্মদিনে সাহেব তৈরির গল্প শোনালেন কিংবদন্তী মাধবী মুখোপাধ্যায়।

‘সাহেব’ ছবিটা শুরু হল কীভাবে?

এই ‘সাহেব’ প্রথমে রেডিওয় হয়েছিল, নাটক হিসেবে। রঞ্জন রায়ের লেখা। বেতার-নাটকটা শুনে আমার ভাল লাগে। শ্যামল চট্টোপাধ্যায় নামে যে ভদ্রলোক ছবিটা প্রযোজনা করেছিলেন, তাঁকে আমি বললাম। তিনি ছবি বানানোর অফারটা দিলেন বিজয় বসুকে। বিজয়বাবু বললেন ‘না না এই কিডনি বেচার গল্প ভালো লাগছে না। ছবি করব না।’

সাহেব একজন ভিক্টিমের গল্প, দর্শক পছন্দ করবে না। আগে তাই ছিল। কিন্তু বিজয় বাবু আমাকে খুব ভালবাসতেন, স্নেহ করতেন। আমি বিজয়বাবুকে বললাম ‘এই সাহেবটা আপনি করুন। ভাল লাগবে। খারাপ হবে না।‘ তখন বললেন, ‘বলছ!’

শুরু হল সাহেব তৈরি করার পরিকল্পনা।

সাহেবের আইকনিক কাস্টিং তাপস, উৎপল দত্ত, মহুয়া আর আপনি। বিজয় বাবু গোড়াতেই কি আপনাদের ভাবেন?

সাহেবের যখন কাস্টিং হল, তখন প্রোডিউসার বললেন ‘না না উৎপল দত্ত বাবার চরিত্রে নয়, অন্য কাউকে নিন।’ বিজয় বাবু বললেন ‘না আমার পছন্দ উৎপল দত্ত।’ তার সঙ্গে আমিও বললাম উৎপল দত্তর মতো আর্টিস্ট হয় না। তার পর তো তাপস, মহুয়া, আরও যাঁরা করেন সব ঠিক হল চরিত্রানুযায়ী।

তাপসের মাতৃসমা বৌদি আপনি সিনেমায়। শ্যুটিংয়ের কোনও গল্প মনে পড়ছে?

সাহেবের যখন শ্যুটিং হচ্ছে সেই সময় তাপস বিএ পাশ করল। ছবিতে দেখানো হয় ফুটবল পাগল সাহেব বিএ পাশ করতে পারে না, বারবার ফেল করে। কিন্তু ওই ছবির সময়েই তাপস বাস্তবে গ্র্যাজুয়েট হয়। আমায় তাপস দিদি বলে ডাকত। আমায় প্রণাম করে বলল ‘দিদি আমি বিএ পাশ করেছি।’

আমি জানতাম তাপস খেতে ভালবাসে। আমি বললাম ‘তুমি কী খাবে বলো? কোন খাবার খেতে চাও?’

তাপস বলল ‘আমি চাইনিজ খাবো।’

চাইনিজ অর্ডার যখন দিলাম তখন প্রযোজক এসে বললেন, ‘আপনি কেন খরচ দেবেন আমি খাবার খরচা দেব।’ আমি বললাম ‘না, এটা আমার আর তাপসের দিদি-ভাইয়ের সম্পর্ক। আমিই চাইনিজের টাকা দেব।’

উৎপল দত্ত, বিজয় বসুর ‘ফরিয়াদ’ ছবিতে ভয়ংঙ্কর ভিলেন বরেন মল্লিক। আবার কি ভীষণ বিপরীত স্নেহশীল পিতা ‘সাহেব’-এ। এই বৈপরীত্য একই পরিচালক একই অভিনেতার মধ্যে ফুটিয়ে তোলেন। এই ছবিতে আপনার আর উৎপল দত্তর শ্বশুর-বউমার কেমিস্ট্রি দারুণ ছিল না?

বিজয় বাবু খুব ভাল পরিচালক ছিলেন। আবার উৎপল বাবুও অসাধারণ অভিনেতা। উৎপল বাবুর একটা কথা বলি মনে পড়ছে, আমার একটা দোষ বলো বা গুণ বলো ছিল যে আমি একটা বই নিয়ে শ্যুটিংয়ে যেতাম। শ্যুটিং ব্রেকে যখন লাইটিং ইত্যাদি হচ্ছে আমি তখন বই পড়তাম। সেই নিয়েও আমায় কথা শুনতে হয়েছে। অনেকেই বলেছেন ‘এই যে আপনি বই পড়ছেন আপনার চরিত্রটা নিয়ে ভাববেন কখন?’ ইত্যাদি। স্ক্রিপ্ট তো আগেই পেয়ে যেতাম, তৈরি থাকতাম। কোন সিন হবে দেখেও নিতাম। তাই চুপ করে বসে থাকতে আমার ভাল লাগতনা। তবু অনেকের থেকেই আমায় কথা শুনতে হয়েছে বই পড়া নিয়ে। একদিন দেখলাম উৎপল বাবুও বই পড়ছেন। আমার দেখে কী আনন্দ হল বলার কথা না। আমি একলা নই, আর একটা মানুষও আছেন।

আর একদিনের ছোট্ট ঘটনা বলি, আমরা সবাই শ্যুটিংয়ে ‘প্যাক আপ’ বললে খুব খুশি হই। সাহেবে উৎপল বাবুর হাফ ডে শ্যুটিংয়ের পর বিজয়বাবু বললেন আপনার আজ প্যাক আপ হয়ে গেছে। উৎপল বাবু ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন ‘প্যাক আপ মানে? আপনি আগে আমাকে বলেননি কেন? আপনার এইটুকু সময় লাগবে। তাহলে আমার অন্য কাজ ছিল করতে পারতাম।‘

উৎপল দত্ত মানুষটা কাজ ছাড়া কিছু ভাবতেন না। এক মুহূর্ত নষ্ট করতেন না।

সাহেবের অনেক আগেই, আমি আর উৎপল বাবু একসঙ্গে জাতীয় পুরস্কার পাই। আমি উর্বশী পুরস্কার আর উৎপল বাবু ভরত পুরস্কার। উনি বাইরে পুরস্কার নিতে গিয়েও বই কিনতে বইয়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছেন। ওঁকে পণ্ডিত বলা যায়। আঠেরো ধরনের ভাষা জানতেন উনি। সিপিএম পার্টিও যে দাঁড়িয়েছিল সেখানেও উৎপল দত্তর অনেক অবদান। সেই হিসেবে উনি কোনও মূল্য পাননি।

আপনার একটা সংলাপ ছিল সাহেবে, ‘আমার তিনটি অপোগণ্ড সন্তান। শ্বশুরমশাই, দেওর সাহেব আর ননদ বুল্টি।‘ মনে পড়ে?

হা হা হা, ঠিক ঠিক। তবে তিনটি নয় চারটি। কারণ পরিচালক বিজয় বসুর খাওয়া-দাওয়ার দেখভালও করতাম আমিই।

বিজয় বাবু আমার প্রযোজনায় ছবিও করেছেন, ‘সুবর্ণলতা’। তো উনি কিছু খেতেন না। বলতেন ‘খেয়ে কাজ করতে আমার ভাল লাগে না মাধবী।’ আমি বললাম ‘তাহলেও আপনাকে খেতে হবে।‘ তখন বিজয় বাবুর জন্য হরলিক্স, টোস্ট, ফল আর একটা ডিম আনিয়ে খাওয়াতাম। তাও ফল খেতেন না। আমায় বলতেন ‘তুমি ভীষণ অবাধ্য মেয়ে।’ আমি তবু রোজ বলতাম, ‘খেয়েছেন তো?’ আমার দিকে টেরিয়ে তাকিয়ে বলতেন ‘হ্যাঁ খেয়েছি।’

তার পর ওঁর আর একটা অভ্যাস ছিল বলি, যখন উনি আমার ছবি ‘সুবর্ণলতা’ করেন তখন উনি উত্তর কলকাতা থেকে ট্রামে করে আসতেন। আমি আপত্তি করে বলি, ‘শুনুন, আপনি শ্যুটিংয়ের দিন ট্রামে করে আসবেন না। ট্যাক্সিতে চলে আসবেন।‘ তখন উনি গালে হাত দিয়ে বললেন ‘তোমার কী মনে হয় মাধবী, আমি ছবি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছি না!’ এই বলে একটা ডায়রি দেখালেন সেখানে ওঁর হাতের লেখা এত ছোট তাই পড়া যেত না, কিন্তু সব সিন উনি ওই ছোট ডায়েরিতে লিখে রাখতেন। ছবি নিজে এডিটও করতেন। তাও আমি ছবির প্রযোজিকা বলে ওঁকে ট্যাক্সি ভাড়া দিয়ে দিই।

আমার ওই মানুষটার প্রতি এত শ্রদ্ধা যে বলার কথা না। এত ভাল মানুষ আর পাব কিনা জানি না।

আর একটা মজার কথা মনে পড়ছে। বিজয় বাবুর ‘খনা বরাহ’ ছবি দেখতে আমায় ডেকেছেন। তখন তো হলে এসি থাকত না। কোন হাউস মনে পড়ছে না, কিন্তু আমার ছোট্ট মেয়েকে সাথে করে নিয়ে গেছিলাম। মেয়ে গরমে এত ঘেমে গেছিল, তখন তাকে জামা খুলেই হলে বসিয়েছিলাম।

বিজয় বসুর ‘রাজা রামমোহন’ জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল। ওঁর খ্যাতনামা ছবি ‘ভগিনী নিবেদিতা’। উত্তম-সুচিত্রা জুটির সবচেয়ে গ্ল্যামারাস ছবি ‘নবরাগ’ও বিজয় বাবুর। আবার সুচিত্রা সেনকে ক্যাবারে ডান্সারের ভূমিকায় নিয়ে বানালেন উনি ‘ফরিয়াদ’। ‘আরোগ্য নিকেতন’, ‘বাঘিনী’, ‘সাহেব’ তো আছেই। এত ভার্সেটাইল পরিচালককে কজন চেনে আজ? ওঁর নামই লোক মনে রাখেনি।

ওঁর চিন্তা-ভাবনা ভাল ছিল। রামমোহন রায় করে জাতীয় পুরস্কার সোনার মেডেল পেয়েছিলেন উনি। বিজয় বাবুর তুলনা নেই। ১৯৮৫ সাল বোধহয়, বিজয় বাবু যখন চলে গেছেন শুনলাম তখন ওঁর বাড়ি আমি আর অরুন্ধতী দেবী গেছিলাম। অরুন্ধতী দেবীকে নিয়ে বিজয় বাবুই বানান ‘ভগিনী নিবেদিতা’। অরুন্ধতী দেবীও খুব শ্রদ্ধা করতেন ওঁকে। বিজয় বসুর শেষযাত্রায় আর তো কাউকে দেখিনি। আমরা দুজনেই শুধু সেদিন বিজয় বাবুর বাড়ি গেছিলাম। তখন তো উনি চলেই গেছেন। শুইয়ে রেখে দিয়েছে। চোখে চশমা দেওয়া। হৃদরোগ গোছের কিছু হয়েছিল। অবিবাহিত ছিলেন উনি। এই তো ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা। তবু বিজয় বাবু যেসব ছবি করেছেন সেগুলো আজও আলোচিত সে তুলনায় প্রাপ্য সম্মান উনি পাননি।

সাহেব তো হিন্দিতে রিমেক করেন অনিল গাঙ্গুলী। আপনার রোলটা রাখী গুলজার করেছিলেন। ‘মহানগর’এর হিন্দি ‘হাম কদম’-এও আপনার রোল করেন রাখী গুলজার।

মহানগরের হিন্দি আমি দেখিনি। হিন্দি করেছে সেটা নিয়ে আমার বলার কিছু নেই। কিন্তু তখন বাংলা ছবি থেকে হিন্দি ছবি হত। একটা বাংলা ছবি কতটা সাফল্য পেলে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে সেটা হিন্দি হয়। হিন্দির মান নিয়ে কিছু বলতে চাই না। আমার ‘ছদ্মবেশী’রও হিন্দি হয়েছে। ‘সাহেব’ ছবিটা এত সুপারহিট হল, তারও হিন্দি হল।

সাহেবের বড় বৌদি যেন একা হাতে সংসার সামলানো দশভুজা আবার ‘সুবর্ণলতা’ ও মেয়েদের আদর্শ। আপনার অবাক করা অভিনয়।

আমি ছ’বছর বয়স থেকে অভিনয় করছি। এখন আশি হতে চলল। যাদের সঙ্গে করেছি তাঁরা সব দিকপাল। ছবি বিশ্বাস, অহীন চৌধুরী, নরেশ মিত্র, শিশির কুমার ভাদুড়ি– তাঁদের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছি। আমার কোনও কৃতিত্ব নেই। আর সিনেমায় অভিনয় না করে শুধু ফিল করতে হবে, এগুলো শিখিয়ে দিয়েছেন ঋত্বিক ঘটক, সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন। তাই আমি অভিনয় জানি না, ফিল করতে পারি।

চল্লিশ বছর পর আমরা যখন ‘সাহেব’ ছবি নিয়ে গল্প করছি, কী মনে হচ্ছে আপনার ফিরে দেখায়?

বিজয় বাবুর মতো মানুষকে মিস করছি। মহুয়ার মতো ভাল অভিনেত্রীকে কত আগেই তো হারিয়েছি। মহুয়া আমায় মা বলে ডাকত। তাঁকে শেষ দেখাও দেখতে পেলাম না। হসপিটালে গেছিলাম, রত্না ঘোষাল বলল ‘মাধবীদি মহুয়ার বারণ ওঁকে যেন কেউ না দেখে।’ ভাজাভাজা হয়ে গেছিল মহুয়ার শরীরটা আগুনে। ভাবতে পারি না আজও।

আর তাপস তো ভুল পদক্ষেপে রাজনীতিতে গিয়ে শেষ হয়ে গেল। ওকে ভুবনেশ্বরে অত মাস যে একা একটা ঘরে রেখে দিল সেই একাকীত্বেই শেষ হয়ে গেল। নিজের প্রতি নিজের একটা ঘৃণা এসে গেল তাপসের। পার্টিতে না গেলে তাপস বেঁচে থাকত। তাপস খারাপ অভিনেতা ছিল না।

তাপস মহুয়া দুজনেই আশির দশকে কত হিট ছবি, হিট গান দিয়েছে। অনেক কিছু করার ছিল ওঁদের। এই মানুষগুলোকে ভীষণ মিস করি আজকের দিনে।

You might also like