শর্মিলা ঠাকুর
শেষ আপডেট: 12th April 2025 14:02
দক্ষিণ কলকাতার পাঁচতারা রেস্তরাঁয় যখন তিনি ঢুকছেন, চারপাশে ক্যামেরার ঝলকানি! লোকে লোকারণ্য। ব্যাঙ্কের কর্মচারী থেকে পথচারী হামলে পড়ছে, একচিলতেও যদি দেখতে পান তাঁকে। রিঙ্কুদিকে। তিনি যখন গাড়ির দরজা এলিয়ে পা রাখলেন লম্বা রাস্তাতে, তাতেই যেন গ্রীষ্মের ভ্যাপসা বিকেলে এক পশলা শান্তি। হালকা হাসিতে এতক্ষণের অপেক্ষা কোথায় যে হারিয়ে গেল...।
একপাশে ঋতুপর্ণা ধরলেন হাত। অন্যপাশে হাঁটছিলেন পরিচালক সুমন ঘোষ। ধীর পায়ে পৌঁছলেন রেস্তরাঁর বেসমেন্টে। সজ্জিত পোডিয়ামে আবার ভিড় বাড়তে থাকল। সাংবাদিক থেকে রেস্তরাঁর কর্মচারী, এমনকী যাঁরা লাইটের কাজ গোছাচ্ছিলেন, তাঁদের চোখ বড় বড়, এক হাতের দূরত্বে তখন ‘অপর্ণা’!
একজন বলেই ফেললেন, ‘কাশ্মীর কি কলি, কী অপরূপ আজও!’ এ কথা হয়তো তাঁর কান অবধি পৌঁছয়নি, কিন্তু এ সত্য তিনি শুনেছেন বহুবার, নিশ্চয়ই। চেয়ারে বসলেন শর্মিলা (Sharmila tagore), এক পাশে সুমন অন্য পাশে ঋতু। ঋতুর পাশে ইন্দ্রনীল। সাংবাদিকদের একগুচ্ছ প্রশ্ন শুরু হয়ে গিয়েছে। পুরনো স্মৃতি, প্রিয় শহর, সত্যজিতের ‘নায়ক’, একাকিত্ব। ‘পুরাতন’ থেকে নতুনত্বে ঢুকে পড়েছে এআইয়ের চ্যাটজিপিটিও। এর ফাঁকে প্রশ্নের সুযোগ এল ‘দ্য ওয়াল’-এর কাছে।
শর্মিলা ঠাকুর, স্বনামধন্য। আভিজাত্যর তর্জমা হতেই পারে শর্মিলা! অপরূপ সৌন্দর্যেরও। পর্দায় যখন-যখন তিনি এসছেন, বুকের ঢিপঢিপ বেড়েছে, যখন তিনি হাসছেন, তখন মনে হিল্লোল আর ঠিক যখন যখন দু’ফোটা জল চোখ বেয়ে নেমে আসছে, সব অশান্ত! শুধুই বিরহে বিভোর। মানিকবাবুর হাত ধরে ছবিতে এলেন। প্রথম ছবি থেকেই তিনি মধ্যমণি, অপু যখন-যখন পর্দায় এসেছে, ঠিক তখন তখন হন্যে হয়ে ‘অপর্ণা’কে খুঁজেছেন দর্শক। ‘দেবী’ হলেন, তারপর ‘মালা’, ‘রেণু’ কিংবা ‘অলোকা’। কিন্তু যখন তিনি হলেন ছায়াসূর্যর ‘ঘেঁটু’, তখনই ঠিক ‘সুন্দরী’ তিনি আর থাকলেন না। ঠিক এটাই ছিল প্রশ্ন।
প্রশ্ন: ছায়াসূর্য ছবিটি যখন আপনি করছেন, যদি খুব না ভুল করি ১৯৬৩-৬৪। আপনার তখন মাত্র ১৮। ততদিনে আপনি সত্যজিৎ রায়, তপন সিংহ, অজয় করের মতো প্রবাদপ্রতিম পরিচালকের ছবিতে অভিনয় করে ফেলেছেন। এমন একটি ছবি যে চরিত্রে আপনি একেবারে ডিগ্ল্যামারাস, আপনার গায়ের রং চাপা, পাশাপাশি সে সময়ে যে সকল ছবি হচ্ছে, তার গল্পে নায়িকারা তখন পরিপাটি, এককথায় বিদূষী, একেবারে শুরুর পর্যায়ে এমন এক ছবিতে সম্মতি দিলেন, এটাকে কি গল্পের প্রতি বিশ্বাস না পরিচালকের প্রতি? কেরিয়ারের শুরুতে এমন এক ছবি, এটা তো এক সাহসের পদক্ষেপ!
View this post on Instagram
সময় নিয়ে প্রশ্ন শুনলেন তিনি। তারপর বললেন, ‘আমার কেরিয়ার শুরুর তখন চার বছরও হয়নি। প্রথমত পরিচালকের জন্যই, কিন্তু পার্থ (পার্থ প্রতিম চৌধুরি, পরিচালক, ছায়াসূর্য) যখন আমাকে গল্পটা শোনাল, গোটা স্ক্রিপ্টই আমার ভাল লেগেছিল।’ কিন্তু পার্থবাবুর ও যে সেই ছবিতেই প্রথম ফিল্মজগতে পদার্পণ...পাশে বসা ঋতুপর্ণা বললেন, ‘অনেক ভাল পরিচালক ছিলেন তিনি, যে যে ছবি করেছেন উনি।’ তারপর আবার বললেন শর্মিলা, ‘যখন স্ক্রিপ্ট আমরা পড়ি বা বোঝায়, তখন আমরা বুঝতে পারি, যে এর মধ্যে কিছু ট্যালেন্ট আছে কি না। এটা আসলে একটা ভিস্যুয়াল মিডিয়াম তো। যখন ওঁরা আমায় পড়ে শোনায়, একটা ভিস্যুয়াল চোখের সামনে আসে। সবাই মনে হয়, যখন স্ক্রিপ্ট শোনে, ভিস্যুয়াল দিয়েই তাঁরা ভাবে। তাই ওঁর (পার্থ) যে বলার ধরণ বা প্রকাশ করার ব্যাপার ছিল, সেটা উনি করতে পেরেছেন। আর আমার গল্পটা খুব ভাল লেগেছিল। আমার এখনও মনে আছে। যখন সিন করেছিলাম। তারপর ওর ‘শুভা ও দেবতার গ্রাস’ ছবিতে শুভার পার্ট করেছিলাম, মূক-বধিরের চরিত্রে। তাই ওঁর সঙ্গে কাজ করতে আমার ভীষণ ভাল লাগত।’
শর্মিলা ঠাকুর। আলোর মালায় মোড়া ‘শর্মিলা’ (Sharmila tagore) শুধু একটি নাম নন—তিনি এক সময়ের অনুপম কবিতার মতো। চোখের আলোয়, অভিব্যক্তিতে ছিল সেই সময়ের ছন্দ। ষাট-সত্তরের রুপোলি পর্দায় তিনি ছিলেন সেই আধুনিকতা, যেখানে শাস্ত্রীয় সৌন্দর্য আর পাশ্চাত্য বৈভবের ঘটেছিল মেলবন্ধন।
আজও শর্মিলা অনন্ত সৌন্দর্যের এক পরিভাষা, নীরব অথচ তাঁর অভিনয় গভীর। নায়িকা নন, সময়ের এক স্নিগ্ধ সাক্ষী। যাঁর অস্তিত্ব ছুঁয়ে আছে এক পরিমিতি বোধ, এক মুগ্ধতা, যা বাংলার সংস্কৃতিকে আজও সমৃদ্ধ করে চলেছে। সেদিনের পোডিয়ামের সেই আলো, সেই উজ্জ্বলতা যেন ছিল চিরকালের। শর্মিলার।