
আরবি শিকড়, ভারতীয় মন
১৯২৫ সালের ১৮ই অক্টোবর পুণেতে জন্মগ্রহণ করেন ইব্রাহিম আলকাজি। কিন্তু ইব্রাহিমের বাবা সৌদি আরবীয় বণিক হামাদ বিন আলকাদি। তিনি তাঁর জীবনের বেশিরভাগ অংশ ভারত, তুরস্ক, কুয়েত, বাহরিন এবং লেবাননে ঘুরে বেরিয়েছেন ব্যবসার কাজে। মারাঠি, গুজরাটি, আরবী এবং ইংরেজিতে পারদর্শী ছিলেন তিনি। বিয়ে করেন কুয়েতের নিসার পরিবারের কন্যাকে। বিয়ের পরেই পুণেতে বাস, সেখানেই জন্ম প্রথম সন্তানের। ইব্রাহিম আলকাদি। আসল পদবী এই আলকাদিই ছিল। কিন্তু এদেশে আলকাদিকে আলকাজি বলে উচ্চারণ করা হয়। তাই ইব্রাহিমও আলকাজি পদবীতেই খ্যাত হন পরবর্তী কালে।
পুরুষ হয়েও আলকাজি কিশোর বয়সে নাচ শিখতেন। যে ঘরে তাঁর পারিবারিক পঠন-পাঠন হত, সেখানেই তিনি নাচের অনুশীলন করতেন। আরবি পরিবারে মেয়েদের নাচই ছিল অপরাধযোগ্য, পুরুষদের নাচার কথা তো কেউ ভাবতেও পারত না। কিন্তু আলকাজি প্রথম থেকেই ছকভাঙা। তাই ভারতীয় সঙ্গীত শিখতে নাড়া বাঁধলেন একজন হিন্দু পণ্ডিত সঙ্গীতসাধকের কাছেও। শিখলেন পিয়ানো বাজানোও।
নয় ভাই-বোন ছিলেন আলকাজিরা। দেশভাগের পর সকলেই পাকিস্তানে গিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করেন। কিন্তু ভারতেই থেকে গিয়েছিলেন আলকাজি। মুম্বাইয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের এই ছাত্র সুলতান ‘ববি’ পদমসীর থিয়েটার গ্রুপ কোম্পানিতে যোগ দেন চল্লিশের দশকের গোড়ায়। এরপর লন্ডনে গিয়ে রয়্যাল অ্যাকাডেমি অফ ড্রামাটিক আর্টসে যোগ দেন তিনি।
আলকাজি ও নেহেরু সাক্ষাৎ
আলকাজি লন্ডনে থাকতেন পড়াশোনার সূত্রে। তখনই তিনি গ্রীক, মিশরীয়, আশেরিয়ান, সুমেরীয়, আধুনিক এবং সূক্ষ্ম শিল্প নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। সারাবিশ্বের থিয়েটার জগতের প্রতিভাদের জীবন সম্পর্কে পড়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করেন তিনি। লন্ডন থিয়েটার কোম্পানির কাছ থেকে একটি প্রস্তাবও পেয়েছিলেন সেখানে কাজ করার জন্য, কিন্তু তিনি শেষমেশ মুম্বইয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন ১৯৫৪ সালে।
ইব্রাহিম বলেছিলেন, “আমি ভারতীয় থিয়েটারের জন্য মন দিয়ে কাজ করতে চাই এবং ভারত ও ভারতীয়দের জন্য নতুন আঙ্গিকের কেরিয়ার গড়তে চাই। এ জন্য লন্ডনে পড়তে যাওয়া কিন্তু লন্ডনে থেকে যাওয়া আমার ইচ্ছে নয়।” ইব্রাহিম যখন লন্ডনে ছিলেন, তখন তাঁর সঙ্গে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর আলাপ হয়। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহরু তখন বিট্রেন গেছিলেন অফিসিয়াল ভ্রমণে। তখনই নেহরু ইব্রাহিমের উৎসাহ এবং অধ্যবসায় দেখে মুগ্ধ হয়ে থিয়েটার গ্রুপ প্রতিষ্ঠার জন্য পড়াশোনা শেষ করে দিল্লিতে ফিরে আসতে বলেছিলেন তাঁকে। নেহরুর এই প্রস্তাব ইব্রাহিমকে আরও বেশি করে দেশমুখী করে তোলে।
প্রধানমন্ত্রী ইব্রাহিমকে প্রতিশ্রুতি দেনস উন্নত প্রযুক্তির সঙ্গে একটি থিয়েটার তৈরি করে দেবেন। সেইসঙ্গে একটি থিয়েটার লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন, যা ভারতীয় থিয়েটারকে সমৃদ্ধ করবে।
ইব্রাহিম দিল্লিতে ফিরে আসেন। নেহেরুও তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেন। জাতীয় নাটক কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতীয় শিক্ষা মন্ত্রকের কাছ থেকে একটি আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন আলকাজি, যা পরবর্তীতে তিন বছরের প্রশিক্ষণের সুযোগ এবং বিভিন্ন নাট্যকলার শংসাপত্র দিত।
ইব্রাহিমের কার্যকলাপ
লন্ডনের ‘রয়্যাল একাডেমি অফ ড্রামাটিক আর্টস’-কে মডেল করে ১৯৫৯ সালে জাতীয় থিয়েটার স্কুল (ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা) প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতে। ইব্রাহিম আলকাজিকে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তবে তিনি প্রথমে এই প্রতিষ্ঠান চালানোর ব্যবস্থাপনা ও অভিজ্ঞতার অভাব আছে বলে দাবি করে প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তবে দু’বছর পরে তিনি তাঁর মতামত পরিবর্তন করেন এবং পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
এর পরে তিনি দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে (১৯৬২ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত) দক্ষতার সঙ্গে এই পদ সামলেছেন। এছাড়াও বোম্বাই প্রগ্রেসিভ আর্টিস্টস গ্রুপের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন আলকাজি। তিনি জাতীয় অ্যাকাডেমি অফ ড্রামাটিক থিয়েটারের পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ওম পুরি, নাসিরুদ্দিন শাহ, মনোহর সিংহ এবং আরও অনেক প্রখ্যাত থিয়েটার অভিনেতাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন ইব্রাহিম। তিনি ছিলেন আমাদের চিরপরিচিত নামী অভিনেতাদের প্রকৃত গুরু।
ভারতে নাট্যদল ও নাট্য অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে জানতে চাইলে ইব্রাহিম আলকাজি বলেছিলেন, “আমার লক্ষ্য ভারতে থিয়েটারের শিকড়কে শক্তিশালী করার জন্য একটি থিয়েটার গ্রুপ তৈরি করা। আমি এমন প্রতিভা আবিষ্কার করতে চেয়েছিলাম, যা আমাকে দেব প্যাটেল, ফিরোজ কুপার, হামাদ সিয়ামি, ডেরেক জেফরিস, ওশা আমাইন, জারসন ডিকন, এবং মনোহর প্যাটেলের মতো লোকদের খুঁজে দিয়েছে।”
পুরস্কারও মেলে অনেক
ইব্রাহিম আলকাজি ভারত সরকারের থেকে পদ্মশ্রী, পদ্মভূষন,পদ্মবিভূষণ এবং নৃত্য ও সংগীত নাটক অ্যাকাডেমির পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। তিনি কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি পান। পাশাপাশি মধ্যপ্রদেশ সরকারের কালিদাস পুরস্কার, টাইমস ফোরাম এবং মুম্বইয়ের ট্যালেন্টের লিভিং ওয়েলথ অ্যাওয়ার্ড এবং ২০০৮ সালে দিল্লি সরকার দ্বারা লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন।
আলকাজি যেন ভারতীয় থিয়েটারের সমার্থক
ইব্রাহিম আলকাজি নির্মিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ব্লাইন্ড এরা, ব্ল্যাক ডে, এ রেইন ডে, ক্লোজড, তুঘলক, অন্ধযুগ ইত্যাদি। তাঁর ‘ব্লাইন্ড এরা’ নাটকটি ভারতীয় থিয়েটারে বিপ্লব ঘটিয়েছিল এবং বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। একসময়ে ইব্রাহিমের নাম যেন ভারতীয় থিয়েটারের সমার্থক হয়ে ওঠে। তাঁর আরবি শিক্ষক এবং তাঁর পিতার হাত ধরে তিনি ভারতীয় এবং আরবি সংস্কৃতির মিশ্র শিক্ষা অর্জন করেছিলেন, তা তাঁর নাটকে ভীষণ ভাবে প্রভাব ফেলে।
তাঁর সাংস্কৃতিক উন্মুক্ততা, সহনশীলতা যেন থিয়েটারের অন্দরে জাতিগত পার্থক্যের বাধাগুলি ভেঙে দিয়েছিল। তাঁর অবদান ভারতীয় নাটকের প্রেক্ষাগৃহ ছাপিয়ে পৌঁছে যায় সামগ্রিক শিক্ষায়, চেতনায়। তাঁর কাজ থিয়েটার পেশায় যুক্ত এবং জনসাধারণের কাছে এক নতুন সচেতনতা, এবং শৈল্পিক দায়বদ্ধতার বোধ তৈরি করে।
আর্টিস্ট, সংগ্রাহক, বহুমুখী প্রতিভা
শুধু নাটক নয় ভিজ্যুয়াল আর্টের ক্ষেত্রেও নান্দনিক প্রয়াসের প্রবর্তক তিনি। সংগ্রাহক হিসেবেও তাঁর অবদান কম নয়। নয়াদিল্লিতে আর্ট হেরিটেজ গ্যালারির পরিচালক হিসেবে মকবুল ফিদা হুসেন, তায়ব মেহতা এবং আকবর পদমসির মতো আধুনিক শিল্পীদের প্রথম প্রচারকদের মধ্যে ছিলেন আলকাজি। ‘আলকাজি ফাউন্ডেশন অফ আর্টস’-এ নতুন ছবি শেখানো ও সংরক্ষণও তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজগুলির মধ্যে অন্যতম।
পরিবার রেখে গেলেন
আলকাজি বিয়ে করেন রোশন আলকাজিকে, যিনি তাঁর নাটকের জন্য পোশাক পরিকল্পনা করতেন। রোশন-ইব্রাহিমের দুই সন্তানও থিয়েটার শিল্পী। প্রথম সন্তান অমল আল্লানা একজন থিয়েটার পরিচালক এবং ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার প্রাক্তন চেয়ারপার্সন। দ্বিতীয় সন্তান ফয়জল আলকাজিও একজন থিয়েটার ডিরেক্টর।