এসফিএফ-হইচই ছবি এবং...
শেষ আপডেট: 4th March 2025 20:38
শুক্রবার। পাঁচতারা হোটেলের সন্ধে। জমজমাট সভাঘর। রেড কার্পেটে পা রাখছেন জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। আলাদা আলাদা ডায়াসে তখন একের পর এক ক্যামেরা ফ্ল্যাশ, বুম মাইক হাতে ছোটাছুটি ইউটইউবার থেকে সাংবাদিক। প্রত্যেকের মুখে হাসি। শুভেচ্ছা বার্তায় ভরিয়ে দিচ্ছে পূর্ব ভারতের সবচেয়ে বৃহৎ প্রযোজনা সংস্থাকে। কেন হবে না! প্রতি বছর এমন এক দিন আসে মাত্র একটি বার।সিনেমহল থেকে আম আদমি মুখিয়ে থাকে এমন এক দিনের অপেক্ষায়।
২০১৮ সালে সেই শুরু, প্রতি বছর এমন একটি দিনে এমন আসর বসে। পোডিয়ামের ব্যাকড্রপের আলোয় ফুটে ওঠে পোস্টারগুলো। প্রথম লুক কিংবা টিজার।
২০১৮ সালে ‘এসফভিএফ’ (SVF, hoichoi) স্টোরিজের ঘোষণায় ছিল ২৫টি ছবি। প্রায় ১০০ কোটির বাজেট। ঠিক ছিল আগামী ৩ বছরে অর্থাৎ ২০২০ সালের মধ্যে ২৫টি ফিল্ম মুক্তি পাবে প্রেক্ষাগৃহে। বাংলা ছবির নামজাদা সব পরিচালকদের ছবি। অঞ্জন দত্ত থেকে সৃজিত মুখোপাধ্যায়, কমলেশ্বর থেকে অপর্ণা সেন, রাজ চক্রবর্তী কে ছিলেন না সেই মঞ্চে। কিন্তু...
View this post on Instagram
কিন্তু ছবি ঘোষণার রমরমা যতটা ছিল, তার থেকে খানিক কমই ‘মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি’র সংখ্যা। মুক্তি পায়নি রাজ চক্রবর্তীর ছবি ‘টং লিং’। ২০১৮ সালের মার্চে শুরু হওয়ার কথা ছিল ছবি। লীলা মজুমদারের গল্পের অবলম্বনে তৈরি হতো ছবি। কিন্তু পরিবারের তরফ থেকে সংবাদমাধ্যমকে জানানো হয়, ‘আমরা কাউকে স্বত্ব দিচ্ছি না। এটা সম্পূর্ণ ভাবেই আমাদের পারিবারিক সিদ্ধান্ত।’ থমকে গেল রাজের ড্রিম প্রোজেক্ট। শুধু এটা নয়, রাজের আরেকটি ছবিও হয়নি। ‘সিরাজদৌল্লা’। রাজের আরেকটা স্বপ্নভঙ্গ! দ্য ওয়াল-এর তরফে প্রশ্ন করা হয়, ঠিক কী কারণে হল না ‘টং লিং’ কিংবা ‘সিরাজদৌল্লা’? রাজ বললেন, ‘এক একটা ছবি নিয়ে বলি। প্রথমেই বলি, ‘টং লিং’। সত্যি ওটা আমার ড্রিম প্রোজেক্ট ছিল। ভীষণভাবে চেয়েছিলাম, ছবিটা হোক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গল্পের স্বত্ব পেলাম না। তাই ছবিটা হল না। দ্বিতীয়, ‘সিরাজদৌল্লা’ চেয়েছিলাম, একটু বিরাট করে ছবিটা হোক। বড় বাজেটের ছবি। কিন্তু সেটা নিয়ে একটা ক্রাঞ্চ হয়েছে। তাই সেই ছবিটা আটকে গেল!’ রাজের ছবি ছাড়াও ঘোষণা হয়, অঙ্কুশকে নিয়ে তৈরি হবে দুটি ছবি। ছবির নাম ঠিক ছিল না। তার মধ্যে একটি মাত্র ছবি (ভিলেন) মুক্তি পায় ২০১৮ সালে, পুজোয়। (SVF, hoichoi)
২০২০ সাল। তখন কোভিডের ভরা মরশুম। হইচইয়ের বয়স সবে চার। ঠিক সে সময়ে গোটা ‘হইচই’ অ্যানাউন্সমেন্ট হল একেবারে ভার্চুয়ালি। একাধিক সিরিজের ঘোষণা হল সেবারও। কত কী ঠিক হল! কিউ করবেন ‘ঠাকুরমার ঝুলি’। সৌরভ চক্রবর্তী করবেন ‘লাল মাটি’। মৈনাক ভৌমিক আনছেন, ‘ললিতা’। রুদ্রনীল ঘোষের পরিচালনায় ‘গঙ্গা’। অর্জুন-রাইমা-মধুমিতা অভিনীত ‘দেবদাস ও একটি খুনের গল্প’, এবং পরমব্রত অভিনীত ওয়েব ফিল্ম ‘কলকাতা আন্ডারগ্রাউন্ড’। এছাড়াও ‘ভাল থাকিস বাবা’ ও ‘চৌরঙ্গি’। এতগুলো কনটেন্ট আজও সত্যিকারের নিঁখোজ।
২০২১-এ কোভিডের প্রকোপ রয়েছে, সে সময়ে। সিনেমার ক্ষেত্রে খানিক ব্যাকফুটেই বাংলা বাজার। আর অন্যদিকে এসভিএফের সিনেমা রাজত্বে ২৫ বছর! মার্চ মাসে আবার এক বিরাট আয়োজন। অতএব বিরাটভাবে একগুচ্ছ ছবির ঘোষণা। ‘গোলন্দাজ’, ‘ট্যাংরা ব্লুজ’, ‘সাইকো’ (পরে নাম বদলে হয় ‘মুখোশ’), ‘কাকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’, এবং ‘শঙ্কু আর ফেলুদা’। মুক্তির মুখ দেখল না সন্দীপ রায়ের ছবি ‘শঙ্কু আর ফেলুদা’। ২০২০ সালে সত্যজিৎ রায়ের জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে ঠিক ছিল ফেলুদা এবং প্রফেসর শঙ্কু- দুটি গোয়েন্দা চরিত্র থাকবেন একই ছবিতে। তবে একই ছবিতে থাকলেও একই ফ্রেমে থাকবেন না এই দুই আইকনিক চরিত্র। ছবির দুই ভাগে দেখা যাবে তাঁদের। কিন্তু আজও সে ছবির ভবিষ্যৎ অন্ধকার। সম্প্রতি এক সংবাদ মাধ্যমে সন্দীপবাবু অবশ্য বলেছেন, ‘যেমন ভেবেছিলাম একই ছবির প্রথমার্ধ্বে একটি ছোট শঙ্কুর গল্প ও দ্বিতীয়ার্ধ্বে ফেলুদার গল্প দেখানো হবে দর্শককে, ঠিক তেমনভাবেই। তবে একটু সময় লাগবে। পরিকল্পনা করাই রয়েছে।’ অন্যদিকে, হইচইয়ের আসন্ন ওয়েব সিরিজের ঘোষণা করলেন পরিচালকরা। ভিডিওবার্তায় জানালেন, নিজেদের ছবির বিষয়ে। অঞ্জন দত্ত বললেন ‘খ্যাপা শহর’ নিয়ে। ঘোষণা হয় ত্রৈলোক্য সিরিজ নিয়েও। সেই সিরিজ নিয়ে ফের ঘোষণা হয় ঠিক তার পরের বছরও। জানা গেল অরিন্দম শীল করবেন পরিচালনা। কিন্তু বছরের পর বছর ঘুরে গেলেও হয়নি সেই সিরিজ। (SVF, hoichoi)
২০২২-এ হইচইয়ের সিজন সিক্স! নতুন ঘোষণায় ওয়েব সিরিজ ‘যোগসূত্র’—পরিচালক সৌরভ চক্রবর্তী। আবারও ঘোষণা হয় অরিন্দম শীলের ওয়েব সিরিজ ‘ত্রৈলোক্য’র। অভিনয়ে জানা যায় জয়া আহসান রয়েছে। পরিচালক ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রফেসর ভূতনাথ’ এবং রাজ চক্রবর্তীর ‘ডি এম মল্লিকা’। ওটিটির পর্দায় ঠাঁই পায়নি একটিও। রাজ তাঁর সিরিজ প্রসঙ্গে বলেন, ‘কথা হয়েছিল, ঠিকই। কিন্তু কিছু কারণে তা হয়নি। তাই আমি ‘আবার প্রলয়’ তৈরি করি। ঠিক একই বছরে এসভিএফের ঘোষণায় মোট আটটি ছবির ঘোষণা হয়, যা মুক্তি পায় পরবর্তী এক বছরে। সৃজিত থেকে জয়দীপ, অরিন্দম শীল থেকে ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি নিয়ে প্রশংসা এবং সমালোচনা দুইই হয়েছিল। (SVF, hoichoi)
২০২৩ সাতে পা হইচইয়ের। রাহুল মুখোপাধ্যায়ের ওয়েব সিরিজ ‘দেবী’র ঘোষণা করা হয়। বাণী বসুর উপন্যাস অবলম্বনে অরিত্র সেনের সিরিজ ‘একুশে পা’। ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টশনে নাম ছিল পরমব্রতর। অভ্রজিৎ সেন পরিচালিত আরও এক সিরিজ ‘ডাকঘর-২’। দেবালয় ভট্টাচার্য পরিচালিত ‘মধ্যরাতের অপেরা’র ঘোষণাও করা হয়। এবং সৌকর্য ঘোষালের ‘পক্ষীরাজের ডিম’। কিন্তু শেষমেশ গল্প যে তিমিরে সেই তিমিরেই। মুক্তির মুখ দেখেনি কোনোটিই। অন্যদিকে এসভিএফ-এর সঙ্গে জুড়ে যায়, জিও স্টুডিয়োজ। ঘোষণা করা হয়, ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ‘বগলা মামা’, সৃজিত মুখার্জির ‘দশম অবতার’, সুমন ঘোষের ‘কাবুলিওয়ালা’, অর্ন মুখোপাধ্যায়ের ‘অথৈ’ এবং রাজ চক্রবর্তীর ‘সন্তান’ ছবিগুলোর। ২০২৩ এবং ২০২৪ জুড়ে মুক্তি পায় সবকটি ছবি। (SVF, hoichoi)
একসঙ্গে চারটি ছবির ‘শুভ মহরৎ’ ২০২৪ সালে! পরিচালকের তালিকায় জয়দীপ মুখোপাধ্যায়, রাজ চক্রবর্তী, সৃজিত মুখোপাধ্যায়, দেবালয় ভট্টাচার্য। চারটি ভিন্ন স্বাদের ছবির ঘোষণা। তার মধ্যে দুটি ছবির ঘোষণা ছিল পুরনোই। তার মধ্যে দুই পরিচালকের ছবি এখনও দর্শকদের মুখোমুখি দাঁড়াতেই পারেনি। শুভশ্রী অভিনীত একটি দেবালয়ের থ্রিলার ছবি এবং জয়দীপের ‘রাশিয়ায় একেন’!
গতকাল অর্থাৎ ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এ একগুচ্ছ নতুন বাংলা কনটেন্টের ঘোষণা। নাম দেওয়া হল‘গল্পের পার্বণ ১৪৩২’। এসভিএফ এবং হইচই-এর যৌথ উদ্যোগে ২৬টি নতুন কাজের ঘোষণা! নির্ঝর মিত্রের পরিচালনায় আবির চট্টোপাধ্যায়, অনির্বাণ ভট্টাচার্য এবং শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবির ‘চোর পুলিশ ডাকাত বাবু’। ঋত্বিক চক্রবর্তী অভিনীত ‘গোরা-ই গন্ডগোল’। পরিচালক জয়দীপ মুখোপাধ্যায় এবার একেনবাবুকে নিয়ে পাড়ি দেবেন বারাণসীতে। রাশিয়ায় যাওয়া আর হল না। পরিচালনায় পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় ‘কুমিরডাঙা’। শ্রীজিৎ এবং সৌভিকের যৌথ পরিচালনায় ‘কাদের কুলের বৌ’। পাশাপাশি হইচইয়ের ১৩টি ওয়েব সিরিজ!
বচ্ছরকার শুধু রিলিজের ঘোষণা শুনেই কি তৃপ্ত বাঙালি? প্রেক্ষাগৃহ কিংবা হইচইতে আদপে সেই কনটেন্টের ঠাঁই আদৌ হবে? একদিকে যখন একের পর এক স্বনামধন্য কলাকুশলীরা বলছেন, ‘মাত্র এই কটি সিনেমা হয়েছে এ বছর’, কিংবা ‘বাংলা ছবি ধুঁকছে’ কিংবা ‘বাংলা ছবির পাশে দাঁড়ান’, ঠিক এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে শুধু ছবির নাম, কে-কে রয়েছেন আর কে তৈরি করছেন সেই ছবি? তা জেনে এবং কবে তা মুক্তি পাবে তা ‘না জেনেই’, ক্ষান্ত থাকবে বাঙালি দর্শক?
প্রশ্নগুলো অজানা। তার উত্তর জানতে এসভিএফ প্রযোজনা সংস্থার সঙ্গেও যোগাযোগ করে ‘দ্য ওয়াল’। একাধিক হোয়াট্সঅ্যাপ থেকে ফোন কলের জবাব মেলেনি।
উত্তর এলে এই প্রতিবেদনে তা তুলে ধরা হবে।
পুনশ্চ: তিন-তিনবার ইশা সাহা অভিনীত ‘ইন্দু-৩’ আসছে বলে ঘোষণা করা হয়। গতকালই ছিল শেষ ঘোষণা।