দেবশঙ্কর-দেবেশ। গ্রাফিক: শুভ্র শর্ভিন
শেষ আপডেট: 8th January 2025 15:47
দেবশঙ্করের (Deb Shankar haldar) অনেকগুলো জন্মদিনে ওঁর সঙ্গে কাটিয়েছি। প্রতিবছর চেষ্টা করি, ওর সঙ্গে রাত বারোটা অবধি থেকে, শুভেচ্ছা জানিয়ে বাড়ি ফিরতে। গত বছরও একসঙ্গে ছিলাম, এ বছর হলো না। তবে রাত বারোটা কুড়িতে ফোন করে শুভেচ্ছা জানিয়েছি।
ভাল মনের মানুষরা, ভাল অভিনেতা হতে পারে, আমি বিশ্বাস করি। দেবশঙ্কর সেই দুর্লভ ক্ষমতার অধিকারী। ও একাধারে ভাল মনের মানুষ এবং ভাল অভিনেতা। আমি-দেবশঙ্কর একসঙ্গে কাজ করছি দু’দশক। তিন দশকের পথে এগোচ্ছি।
যা হয়েছে, নির্দেশক দেবেশ (Debesh chattopadhyay) এবং অভিনেতা দেবশঙ্করের বোঝাপড়া এখন এমন, যে আমার নির্দেশ করার প্রয়োজন পড়ে না, আর অভিনেতাও ঠিক আমার মতো করে ফেলে। আমি যদি শুধু বলি, দেবশঙ্কর... কথা শেষ হয় না, ও বলে, ‘বুঝে গিয়েছি’। ও যদি আমার দিকে তাঁকিয়ে বলে, ‘দেবেশ বলছি কী...’ আমি বলি, বুঝে গিয়েছি।
আমাদের যোগাযোগ স্তর এমন পর্যায় পৌঁছেছে, একে অন্যের চোখের দিকে তাকালে বুঝতে পারি দু’জন কী চাইছি...। সম্পর্কের ভিত কতটা শক্তপোক্ত যে এমন এক যোগসূত্র তৈরি হয়েছে। দেবশঙ্করের অনেকগুলো গুণ একের পর এক লিখে েযতে পারি, শেষ হবে না। তবে একটি বিশেষ গুণ যার জন্য দেবশঙ্কর ভীষণ চর্চিতও বটে, তা হল স্ক্রিপ্ট মুখস্থ রাখার ক্ষমতা। ও একই সঙ্গে একাধিক নাটকের (প্রায় ১০-১২) গোটা সংলাপ মনে রাখতে পারে। শুধু ওর নিজের বলা সংলাপ নয়, সহঅভিনেতাদেরও। গোটা স্ক্রিপ্ট ওর মুখস্থ। আমি সিম্যান্টিক মেমরি নিয়ে কাজ করি। যখন আমি রিসার্চ শুরু করি, কগনিটিভ নিউরোসায়েন্স এবং থিয়েটারের তখন ওর সংলাপ মুখস্থ রাখার ক্ষমতা নিয়ে গোটা একটা সাক্ষাৎকার নিই। আমার প্রকাশিত বইতে বিস্তারিতভাবে তা নিয়ে লেখাও রয়েছে। একটা বিজ্ঞানসম্মত দিকও রয়েছে। শুধু সংলাপ নয়, দেবশঙ্কর অনুভূতি ও মনে রাখে টুকরো-টুকরো ঘটনার মাধ্যমে।
একটি উদাহরণ দিয়ে লিখছি। ‘নাচনি’ নাটকের এক দৃশ্যে দেবশঙ্কর, মঞ্চ থেকে লাফ মেরে নিচে নামত। অডিটোরিয়াম থেকে এক্বেবারে অ্যাকাডেমির বাইরে বেরিয়ে যেত। তারপর আবার যখন মঞ্চে ফিরত, তখন দেখা যাচ্ছে মঞ্চে একটি মৃত্যু ঘটেছে। দেবশঙ্কর যখন মঞ্চে উঠত, তখন ওর হৃদয় ছিন্নভিন্ন, ভেঙে পড়েছে, মর্মাহত।
আমি ওকে সেই সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করি, এই যে তুমি একেবারে বাইরে চলে গেলে, একাডেমির বাইরে, একটা অন্য জগত তোমার সামনে, চিৎকার-চেঁচামেচি, তারপর আবার গ্রিন রুমের দরজা দিয়ে ঢুকে, তুমি মঞ্চে ঢুকছো। এই এত কিছুর মাঝে তোমার অর্থাৎ অভিনেতা দেবশঙ্করের মানসিক প্রস্তুতিটা ঠিক কী?
ও আমায় যা বলেছিল, তা শুনে স্তম্ভিত হতে হয়, দেবশঙ্কর বলেছিল ‘নাচনির সেট তৈরি হয়েছিল বাঁশ দিয়ে। অ্যাকাডেমির এসির বাতাস বাঁশগুলোকে আরও ঠান্ডা বরফের মতো করে দিত। আমি যখন ওটা ধরতাম, হাত কাঁপত আমার। ওই শীতল অনুভূতি আমার মায়ের মৃত্যুর স্মৃতিগুলো ফিরিয়ে আনত। ওটার পরই আমার মধ্যে মানসিক পরিবর্তন ঘটত।’ বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই, একজন অভিনেতা এই অনুভূতির মাধ্যমে একটা গোটা দৃশ্য বুনে ফেলতে পারে, কী মাপের অভিনেতা দেবশঙ্কর হালদার!
আর সংলাপ, দেবশঙ্কর (Deb Shankar haldar) সংলাপ মনে রাখে, বিভিন্ন ঘটনার উপর ভিত্তি করে। আরেকটা উদাহরণ লিখছি।
ও আমার সঙ্গে একাধিক নাটকে অভিনয়ে করেছে। ও মঞ্চে আসে, দাঁড়ায়, একটা আলোর দিকে তাকায়, আমায় জিজ্ঞেস করে, ‘এই আলোটাই ছিল?’ আমি জবাবে বলি, হ্যাঁ। আমি জানি ওর ততক্ষণে সব মনে পড়ে গিয়েছে। ওর মুখ দিয়ে নির্দিষ্ট সংলাপটাই বেরোবে। দেবশঙ্কর সংলাপের প্রেক্ষিতে সংলাপ মনে রাখে না। ও সংলাপ মনে রাখতে আলোকসজ্জা মনে রাখে। ও সংলাপ মনে রাখতে মিউজিক মনে রাখে। নাটকের সমস্ত উপাদানের মাধ্যমে সংলাপ মুখস্থ রাখে!
আমার সঙ্গে দেবশঙ্কর সাতটি নাটকে কাজ করেছে। ওই সাতটি নাটকই দেবশঙ্কর না থাকলে হতো না। আমি ওকে কখনও ‘দ্য দেবশঙ্কর হালদার’ বলে এই সাতটি নাটকে নিইনি। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, দেবশঙ্কর বাংলা তথা ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা। ভাল থেকো দেবশঙ্কর। সবাইকে নিয়েই ভাল থেকো।